ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৯ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

কৈশোর থেকে উত্তরণ (৮ নবেম্বরের পর) তিনি অনেক দিন বেঁচে ছিলেন এবং আমার প্রথম নির্বাচনী সভায় বৃদ্ধ বয়সে পাড়ার একটি সভায় উপস্থিত হন। আফতাবুর রাজা চৌধুরী একজন ছোটখাটো মিরাসদার ছিলেন এবং তার মামলা প্রায় প্রতিরোজই একটি থাকত। তার উকিল ছিলেন আমার আব্বা। সেজন্য তাকে আমরা খুব বেশি চিনতাম। তিনি শিক্ষক হিসেবেও বিভিন্ন বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতেন। ব্রজেন্দ্র কুমার ভট্টচার্য ছিলেন ড্রইং-এর শিক্ষক আর তাকে আমি সবিশেষ ভয় পেতাম। একদিন তার ক্লাস পালিয়েছিলাম, তবে ধরা পড়িনি। আবদুর রহমান স্যার ছিলেন পোশাকদুরস্ত মানুষ এবং খুব ভাল শিক্ষক। ঠিক তেমনি ছিলেন কেতকী রঞ্জন দেব, যিনি যে কোন বিষয় অত্যন্ত সুন্দরভাবে পড়াতেন। সুরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য নাটকীয় কায়দায় বাংলা পড়াতেন ও দেব-দেবীর কাহিনী আসলেই ভাবে গদগদ হয়ে অন্য জগতে চলে যেতেন। আবদুল গনি সাহেব শব্দ বিশারদ ছিলেন আর ইংরেজী শব্দের প্রতিশব্দ অনবরত খুঁজতে থাকতেন। নাসির উদ্দিন আহমদ ছিলেন কাপড়ে-চোপড়ে সাহেব। মোস্তাকিম আলী ছিলেন শিল্পী বিশেষ। তার হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। বুরহান উদ্দিন আহমদ আমার ভাই ও আমাকে সবিশেষ পাত্তা দিতেন। তিনি কিছুদিন আমার আব্বাকে পড়িয়েছিলেন। আবদুল গফফার দত্ত চৌধুরী ছিলেন খামখেয়ালি শিক্ষক; কিন্তু তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ কবি, গীতিকার ও লোকসাহিত্য সংগ্রাহক। বিজ্ঞানে চারু চন্দ্র ভট্টাচার্য খুব ভাল শিক্ষক ছিলেন, তবে ছাত্রদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেন। ঠিক উল্টো ছিলেন পরবর্তীকালের বিজ্ঞান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। বীরেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন নিয়মের মানুষ আর দুষ্ট ছেলেরা তাকে খুব বিরক্ত করত। তিনি প্রায়ই হতাশায় বলতেন যে, দুষ্ট ছেলেরা তাকে অভিশপ্ত জীবনযাপনে বাধ্য করত। সানওয়ার বখত চৌধুরীকে ছাত্ররা খুব ভয় করত তার কড়া মেজাজের জন্য। হোস্টেল সুপার হিসেবে তিনি দেখা দেন ¯েœহময় অভিভাবকরূপে। মোহাম্মদ সিকন্দর বখত ইতিহাস পড়াতেন এবং তিনি সম্ভবত চেহারার সাদৃশ্যের কারণে শিবাজী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি আব্বার সহপাঠী হিসেবে আমাদের কাছের লোক ছিলেন। কিছুদিনের জন্য আব্বার বন্ধু উকিল জমশেদ আলী চৌধুরীর ভাই গওসুল হোসেন চৌধুরী আমদের শিক্ষক হয়ে আসেন। তবে তিনি অল্পদিন পর চলে যান। পরবর্তীতে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে তিনি হন আমার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠজন। ১৯৪৫ সালেই আমি কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সদস্য হয়ে যাই এবং ১৯৪৬ সালের পর আমার পড়াশোনার পরিধি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এ সময় দু’টি বই আমার ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। একটি ছিল ‘জীবন জেগেছে যার’, যে গ্রন্থটির লেখকের নাম আমি বহু চেষ্টা করেও উদ্ধার করতে পারিনি। আর একটি ছিল ‘ঝিন্দের বন্দী’, যে গ্রন্থটি সে সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। আমার মনে হয় চারটি বছর আমি ব্যাপকভাবে পড়াশোনা করি এবং আমার মনন ও মানস গঠনে এ সময়টি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐ সময়ই একজন পড়ুয়া এবং ভাল ছাত্র হিসেবে আমি বেশ পরিচিত হয়ে যাই। একই সময়ে ইংরেজী বইও পড়তে শুরু করি। যে ইংরেজী গ্রন্থ আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে সেটি ছিল ঐবহৎু ঋরবষফরহম-এর ‘ঞড়স ঔড়হবং’ দুই খ-ের একটি উপন্যাস। একই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঞ্চয়িতা ও কাজী নজরুল ইসলামের ‘সঞ্চিতা’ ছিল আমার সব সময়ের দু’টি প্রিয় বই। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ এবং নজরুলের ‘ব্যথার দান’ও তখন আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। মুসলিম সাহিত্য সংসদ ছাড়াও ওই সময়ে সাহিত্য পরিষদের কার্যক্রমে আমি ব্যাপকভাবে অংশ নিতে শুরু করি। কোন কোন সময় শুধু আমার প্রবন্ধ বা লেখা নিয়েই সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হতো। আমার ওপর তখন দু’জন শিক্ষক আবদুল গনি এবং সেকেন্দর বখ্্ত যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেন। আবদুল গনি ইংরেজী ও অঙ্কের এবং সেকেন্দর বখ্্ত ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। এছাড়াও বয়স্ক শিক্ষক আজিজ বখ্্ত চৌধুরীকে খুব মনে পড়ে। যেহেতু তিনি জমিজমা নিয়ে অনেক মামলায় জড়িত ছিলেন এবং তার উকিল ছিলেন আমার আব্বা, তাই তার উপদেশ সব সময় মানতে হয়। ব্রাহ্ম সমাজের নেতা চৌহাট্টার বাবু সুধীরেন্দ্র নারায়ণ সিংহ মজুমদার সে সময় ছিলেন আমার একজন পৃষ্ঠপোষক। চলবে...
×