ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কালীপূজা ও সর্বজনীনতা

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ১০ নভেম্বর ২০১৫

কালীপূজা ও সর্বজনীনতা

যিনি ব্রহ্ম, তিনি শক্তি ও মহামায়া। তাঁর কৃপা পেতে হলে আদ্যাশক্তিরূপিণী তাঁকে প্রসন্ন করতে হবে। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। যে যুগে আমরা বাস করছি, দুর্ভাগ্যবশত তা স্বার্থপরতা, হিংসা, মিথ্যাচরণ ও সংঘর্ষে আন্দোলিত। সুস্থ চিন্তাশীল, হৃদয়বান মানুষ সন্ত্রস্ত, সংক্ষুব্ধ। এমতাবস্থায় ঘন মেঘের আঁধার ভেদ করে শারদ-সূর্যের মতোই সংশয়দীর্ণ হৃদয়ে দিব্যোজ্জ্বল আত্মপ্রকাশ করছেন জগন্মাতা মহাশক্তি দেবী কালী। কাশীতে শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যদর্শন, শ্মশানে মা কালী জীবের কর্মবন্ধন খুলে দেন ও শিব ব্রহ্মমন্ত্র দেন। আমরা রোমাঞ্চিত হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পুষ্পাঞ্জলি লয়ে তাঁর শ্রীচরণ দর্শনের প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ। তাঁকে কেন্দ্র করে আমাদের অন্তরে আজ অপরিমেয় আনন্দ-অনুভূতির উদ্ভাস। আমরা দেবী কালীর শ্রীচরণে সদা প্রার্থনারত- তিনি আমাদের অন্তরের আসুরিক শক্তিকে বিনাশ করে শুভ শক্তির উদ্বোধন করুন। আমরা যেন সাম্য, মৈত্রী, অহিংসা ও পরার্থপরতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তাঁর সুসন্তানরূপে পরিচয় দিতে পারি। নিছক উৎসব- আড়ম্বরে মত্ত না হয়ে আমরা যেন আমাদের অন্তরে এ মহাশক্তির উদ্বোধনে নিয়ত ব্যাপৃত থাকতে পারি। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- মায়ের কাছে প্রতিনিয়ত অকুণ্ঠ শরণাগতিই আমাদের শান্তি দিতে পারে। তাঁর জন্যই তাঁকে ভালবাসÑ ভয়ে বা কিছু পাওয়ার আশায় নয়। তাঁকে ভালবাস, কারণ তুমি সন্তÍান। ভাল মন্দে- সর্বত্র তাঁকে সমভাবে দেখ। যখন আমরা তাঁকে এ রূপে অনুভব করি, তখনই আমাদের মনে আসে সমত্ব ও চিরশান্তি- এই মায়ের স্বরূপ। যতদিন এ অনুভূতি না হয়, ততদিন দুঃখ আমাদের অনুসরণ করবে। সর্বজনীনতার অঙ্গ হিসেবে কুমোর তার জানা বিদ্যা দিয়ে সুন্দর মূর্তি গড়ে দেয়। ঢাকী তার সুমধুর ঢাকের বাদ্যে আবালবৃদ্ধবণিতা সকলকে মোহিত করেন। তাঁতী তার নিজ তাঁতে সুন্দর কাপড় বোনে সকলের জন্য। সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানও হয়। হিন্দুর পূজা পদ্ধতি মূলত ব্রহ্মসাধনেরই একটি সহজতর প্রক্রিয়া বিশেষ। স্বতঃবিক্ষিপ্ত মনকে একটি ক্রিয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এক কেন্দ্রিক করার সুচতুর কৌশল ভিন্ন অন্য কিছুই নয়। শাস্ত্রে আছে- ‘দেবো ভূত্বা দেবং যজেৎ’- দেবতা পদবাচ্য হয়ে দেবতার পূজা করতে হয়। পূজা পদ্ধতির ক্রমিক অনুশীলন সাধককে সামান্য স্তর থেকে তাকে দেবত্বের স্তরে উন্নীত করে। মনকে সাময়িক বিষয় উপকরণের ওপর থেকে সরিয়ে নিয়ে বিষয় বিশেষে নিবদ্ধ করে। মনের এই নির্মল বা শুদ্ধ স্তরে পরমাত্মার প্রতিবিম্ব পড়ে। শাস্ত্র বলেছে- সেই সদ্বস্তু শুদ্ধমনের গোচর, সেই শুদ্ধমন, শুদ্ধবুদ্ধি, শুদ্ধ-আত্মা একই। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, উপাসনা একটি স্বতন্ত্র দর্শন। আমাদের অনুভূত বিবিধ ধারণার মধ্যে শক্তির স্থান সর্বপ্রথম। প্রতি পদক্ষেপে এটা অনুভূত হয়। অন্তরে অনুভূত শক্তি-আত্মা এবং বাইরে অনুভূত শক্তি-প্রকৃতি। এই দু’য়ের সংগ্রামই মানুষের জীবন। আমরা যা কিছু জানি বা অনুভব করি, তা এ দুই শক্তির সংযুক্ত ফল। মানুষ দেখেছিল, ভাল এবং মন্দ-উভয়ের ওপর সূর্যের আলো সমভাবে পড়ছে। ঈশ্বর সম্বন্ধে এ এক নতুন ধারণা-এক সার্বভৌম শক্তি সব কিছুর পশ্চাতে। বেদান্ত অনুসারে পরম সত্য নির্গুণ এবং নাম ও রূপের অতীত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মতে সেই পরম সত্যই আবার দেব-দেবীর রূপ ধারণ করেন। অধ্যাত্ম ইতিহাসে এরকম শত শত উদাহরণ পাওয়া যায়। পরম সত্যের আরাধনা অত্যন্ত প্রাচীন। দেবী-মাতৃকাকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আরাধনা করা হয়। হেমন্তকাল- শস্যশ্যামলা কৃষিক্ষেত্র, স্বচ্ছ জলধারাবাহিত নদী, নির্মেঘ আকাশ, দিনে সূর্যালোকে সর্বদিক উদ্ভাসিত, আবার রাত্রিকালে শুভ্রচন্দ্র কিরণে স্নাত। ভক্তদের কাছে তিনি সত্যই এবং সমস্ত ঘটনাই আধ্যাত্মিক সত্য, তিনি তাদের কাছে শুধু প্রতিমা নন, তিনি মূর্ত আদর্শ। স্বামী বিবেকানন্দের মতে উপাসনা অর্থাৎ তাঁর কাছে প্রতিনিয়ত অকুণ্ঠ শরণাগতিই আমাদের শান্তি দিতে পারে। সে জন্যই তাঁকে ভালবাসো-ভয়ে নয় বা কিছু পাবার আশায় নয়। তাঁকে ভালবাসো, কারণ তুমি সন্তান। ভাল মন্দে-সর্বত্র তাঁকে সমভাবে দেখ। যখন আমরা তাঁকে এই রূপে অনুভব করি, তখনই আমাদের মনে আসে সমত্ব ও চিরশান্তি। যতদিন এই অনুভূতি না হয়, ততদিন দুঃখ আমাদের অনুসরণ করবে। তাঁর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে পড়ে থাকতে হবে। তিনি তো আর জাগতিক নন! তিনি অন্তর্যামী। জাগতিকভাবে যখন সন্তান খেলনা নিয়ে ভুলে থাকে, তখন মা কাছে আসেন না। যখন আর খেলনা ভাল লাগে না, তখনই কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায় এবং মা সমস্ত কাজ ফেলে এসে কোলে নেন। তেমনি যখন আমরা এ বিশ্ব জগতে সব কিছু নিয়ে মেতে থাকি, তখন মায়ের দেখা পাই না। নিষ্কামভাবে সব কিছু করতে পারলেই মায়ের দেখা পাওয়া যায়। লেখক : সন্ন্যাসী মহারাজ, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা
×