ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৪:২২, ১১ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজে (১০ নবেম্বরের পর) আমার এই মতটি অনেকেই গ্রহণ করলেন না এবং আমার কতিপয় বন্ধুও তাতে খুশি হলেন না। তারা সবাই মিলে অত্যন্ত গোবেচারা মানুষ আমাদের সহপাঠী রেজাউল করিমকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনোনীত করলেন। রেজাউল করিম সাহিত্যচর্চা করতেন। তবে মোটেই পরিচিত ছিলেন না। আমি সে সময় সারা কলেজে খুবই পরিচিত ছিলাম এবং সিলেটের সাহিত্য অঙ্গনেও সক্রিয় ছিলাম। কিন্তু নির্বাচন করতে গিয়ে দেখলাম যে, আমার সমর্থন খুব শক্তিশালী নয়। প্রথমদিকে আমি খুবই নিশ্চিত ছিলাম যে, আমি জিতব এবং সেজন্য তত প্রচারণা চালাইনি। যখন বুঝতে পারলাম যে, আমার অবস্থা তত ভাল নয় এবং আমার বন্ধু সুবিমল রায় চৌধুরী আমাকে জানাল যে, হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে আমি তেমন জনপ্রিয় নই। আমি তাতে খুবই বিচলিত হই এবং জোরেশোরে প্রচারকার্যে নামি। কিন্তু নির্বাচনে আমি বেশ ভোটের ব্যবধানে পরাজয়বরণ করি। এই পরাজয়ের মধ্য দিয়েই আমার কৈশোরের অবসান ঘটে। নির্বাচনে দু’বারের এই ব্যর্থতা আমাকে খুবই ব্যথিত করে। তবে সম্ভবত নম্রতাবোধে আমি ভাল দীক্ষা পাই। রেজাউল করিম সারাজীবন আমার বন্ধু ছিলেন। রেজাউল করিম সাধারণ বীমা কর্পোরেশনে ডেপুটি নির্বাহী পরিচালক হন এবং অবসরান্তে একটি ব্যক্তিখাতের বীমা প্রতিষ্ঠানে প্রধান নির্বাহী হিসেবে ইন্তেকাল করেন। তওফিক সিরাজ প্রথমে বিমান বাহিনীতে যোগ দেন, কিন্তু অতি সত্বরই স্বাস্থ্যগত কারণে দেশে ফিরে আসেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ তেমন ছিল না। তার বাড়ি ভাদেস্বরে সম্ভবত বহু বছর পর একবার দেখা হয়। মুরারীচাঁদ কলেজ সিলেট শহরের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। বন্দরবাজারকে যদি শহরের কেন্দ্রবিন্দু বিবেচনা করা হয় তাহলে সেখান থেকে দূরত্ব হলো প্রায় দুই/আড়াই মাইল। আমি কলেজে ভর্তি হয়েই ঠিক করলাম যে, আমাকে একটি সাইকেল কিনতে হবে। সেজন্য আমার নিজস্ব তহবিল ছিল যথেষ্ট। আমি স্কুলে শেষ তিনটি বছর বৃত্তি পেয়েছি ক্রমান্বয়ে মাসে তিন, চার ও পাঁচ টাকা হিসেবে। আমার আব্বা আমার নামে একটি ডাকঘরে সঞ্চয়ী হিসাব শুরুতেই খুলে দেন। সেই হিসাবে যা সঞ্চয় ছিল তাতে একটি ইঝঅ সাইকেল সহজেই কেনা যেত। ঢাকায় তখন আমার মামা সৈয়দ শাহাদত হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্র। তাকে লিখলাম যে, তিনি একটি ইঝঅ ঈুপষব খরিদ করে সেটা রেলযোগে সিলেটে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। কাজটা যত সহজ ভেবেছিলাম বাস্তবে তত সহজ হলো না। আব্বা তখন কমরেড ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষক। তিনি কমরেড ব্যাংকের একটি ড্রাফটের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। মানি অর্ডারের সহজ পন্থা তাই আমার নেয়া হলো না। মামা তার মধ্যে আবার ঝামেলা সৃষ্টি করলেন। তার নামটা যেভাবে আমি ড্রাফটে বানান করেছি তিনি তা খেয়াল না করে অন্যভাবে দস্তখত করলেন। আর যায় কোথায়, ব্যাংক তাকে কোনমতেই টাকা দেবে না। অবশেষে তিনি আমাকে লিখলেন যে, পুরনো ড্রাফটের পরিবর্তে একটি নতুন ব্যাংক ড্রাফট যেন প্রেরণ করি। এসব ব্যবস্থা নিতে নিতে কমরেড ব্যাংক লাল বাতি জ্বালালো এবং আমার ড্রাফটটি মূল্যহীন হয়ে গেল। আমার আব্বা আমার ক্ষতি পুষিয়ে দিলেন ঠিকই; কিন্তু আমার একটি তিক্ত স্মৃতি চিরস্থায়ী হয়ে গেল। সুখের বিষয় যে, এখন আমরা যেভাবে ব্যাংকিং ব্যবস্থার তদারকি ও পর্যবেক্ষণ করি তাতে এ রকম দুর্যোগ প্রায় অচিন্ত্যনীয়। সাইকেল অবশেষে পাওয়ার পর আমি দুটি কাজে মনোনিবেশ করি- একটি ছিল শহরের আনাচে-কানাচের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং আর একটি ছিল পরিচিতজনের ঘনঘন খোঁজখবর নেয়া। অবশ্য এমসি কলেজে যাওয়ার জন্য সাইকেলের কোন সহজ বিকল্প ছিল না। আমি প্রায় প্রতিদিনই আমার বন্ধু হেদায়েতকে মিরাবাজারের এক কোণ থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেতাম এবং ফিরতি পথে তাকে সেখানে নামিয়ে দিতাম। সিলেটের একটি দৃশ্য তখন খুবই সুন্দর ছিল। প্রতিদিন সকাল ন’টা থেকে দশটার মধ্যে আর বিকেল পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যে কলেজ যাত্রী ও কলেজ ফেরতাদের সাইকেল শোভাযাত্রা। মুরারীচাঁদ কলেজে আদিকাল সেই ১৯২৯ সাল থেকেই সুন্দর সাইকেল স্ট্যান্ড আজও বিরাজমান। এক সময় নাকি কলেজে সাইকেল স্ট্যান্ডে কোন সাইকেল তালামারা ছিল না। এখন তো তালা ব্যবস্থা সংবলিত সাইকেল ছাড়া আর কোন সাইকেলই বোধ হয় পাওয়া যাবে না। কারও কারও মতে এই অবক্ষয়ের জন্য গণতন্ত্রায়নই দায়ী, এলিটিস্ট সমাজে তালাচাবির প্রয়োজন মোটেই ছিল না। তালা না লাগালেও চুরি-চামারি তেমন ব্যাপক ছিল না। আমার শৈশব ও কৈশোরে সারাদিনে কখনও ঘরবাড়ির দরজায় তালা লাগানো হতো না, শুধু রাতেই দরজা-জানালা বন্ধ করা হতো। মুরারীচাঁদ কলেজে আমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ছাত্র ছিলেন আমার আব্বা। ১৯১৭ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তিনি এই কলেজে ছিলেন। তারপর তার চার ভাই ও এক বোন সেই কলেজে পড়েন। এক ভাই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলকাতায় শিবপুর প্রকৌশল কলেজে চলে যান। বাকি তিনজন এই কলেজ থেকেই স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। আমরা দুই ভাই সেখানে ভর্তি হলাম ১৯৪৯ সালে। চতুর্থ প্রজন্মের ইংরেজী শিক্ষায় প্রথম দুই ছাত্র। আমার দাদার আমলে কিন্তু কলেজটি হয়নি। আমি ছিলাম মাত্র দুই বছর; কিন্তু আমার ভাই সেখান থেকেই চার বছরে বিএসসি পাস করেন। প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উত্তরণের সময় আমাদের একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই পরীক্ষায় আমি সর্ববিষয়ে বেশি নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হই। সম্ভবত একটি বিষয় ছাড়া সব পরীক্ষায় আমি ব্যাপক দূরত্ব বজায় রেখে প্রথম হই। শিক্ষক মহলে অনেকেই আমাকে ডেকে নিয়ে প্রশংসা করলেন। আমি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করি রাষ্ট্রনীতির অধ্যাপক আবদুস সোবহান খান চৌধুরীর। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন যে, প্রবেশিকা পরীক্ষায় আমি কোন্ স্থান অধিকার করেছি। আমি যখন বললাম যে, আমি প্রথম দশের মধ্যে ছিলাম না এবং সর্বমোট তারকা নম্বরও পাইনি, তখন তিনি খুব বিস্মিত হলেন। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষার মার্কশীট দেখতে চাইলেন। মার্কশীট দেখে তিনি বললেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই প্রথম বিশজনের মধ্যে ছিলে।’ তারপর শুধালেন, ‘তুমি কোন বৃত্তি পেয়েছ?’ আমি যখন বললাম এই কলেজে প্রথম শ্রেণীর বৃত্তি পাওয়া একমাত্র ছাত্র ছিলাম আমি তখন তিনি খুশি হয়ে বললেন, ‘আমি যা বলেছি তাই ঠিক। ঐচ্ছিক বিষয়ে ভাল করনি বলে তুমি দশের মধ্যে স্থান করতে পারনি। কিন্তু বৃত্তির তালিকায় তুমি প্রথম কাতারেই আছ।’ এই সুসংবাদটি আমাকে খুবই প্রীত করে এবং অধ্যাপক সোবহান খান চৌধুরী তখন থেকেই হয়ে যান আমার একজন প্রিয় শিক্ষক। তার ছাত্রজীবনে তিনি খুব নামকরা ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বোর্ডে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে কলকাতা থেকে ভালভাবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সহপাঠী ছিলেন এবং তাদের পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ ছিল ঈর্ষণীয়। একজন আরেকজনের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। অধ্যাপক চৌধুরী সারাজীবন আমার প্রতি তার আগ্রহ বজায় রাখেন। আমরা একসঙ্গে ওয়াশিংটনে এবং পরবর্তীকালে ঢাকায় চাকরি করি। তিনি ওয়াশিংটনে শিক্ষা কাউন্সিলর ছিলেন এবং শিক্ষা বিভাগে মহাপরিচালকের পদে উন্নীত হওয়ার পর কলকাতায় বাংলাদেশের প্রথম ডেপুটি হাইকমিশনার নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে আমি সস্ত্রীক কয়েকদিন তার মেহমান ছিলাম। তার মতো সজ্জন ভাল মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। তার ছিল তিনটি মেয়ে, যারা নিজেদের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত আছে। তারা সবাই এখনও আমার ঘনিষ্ঠ, যদিও দেখা-সাক্ষাৎ হয় খুব কম। চলবে...
×