ভারতের বিহার রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতা ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রত্যাশামাফিক জয় পায়নি। দেশটিতে গত বছর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পেয়েছিল বিজেপি। বিহার নির্বাচনের এই ফল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য একটি বড় ধাক্কা বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এর ফলে তার পক্ষে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচী নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যেমন কঠিন হবে তেমনি রাজনৈতিকভাবে বিজেপির সামনে আসতে পারে আরও নতুন চ্যালেঞ্জ। রবিবার প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের নেতৃত্বে আঞ্চলিক দলগুলোর মহাজোট বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোটের চেয়ে ৬০টি বেশি ১৭৮টি আসন পেয়েছে। উল্লেখ্য, বিহার বিধান সভার আসন সংখ্যা ২৪৩। নীতিশ কুমার টানা তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন। এরচেয়েও বড় কথা, লালু প্রসাদ প্রবল প্রতাপে আবার ফিরেছেন রাজ্য রাজনীতিতে।
যদিও রাজ্য নির্বাচন, কিন্তু বিজেপির প্রচারাভিযানে এবার দেখা গেল সবকিছুতেই মোদি নিজেকে যেন বেশি করে তুলে ধরছেন। গরুর মাংস খাওয়াকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তৈরি হওয়া অসহিষ্ণুতা ঠেকাতে তাকে ঠিক ততটা উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি। বিহার নির্বাচনেও এর একটি প্রভাব পড়তে পারে বলে অনেকে মনে করেন। বিহার নির্বাচনের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক-
ফিকে হতে শুরু করেছে মোদির প্রভাব
গত বছর সাধারণ নির্বাচনে বর্ণ ও জাতপাতের ওপর নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছিলেন মোদি। ফলে আঞ্চলিক প্রভাবশালী দলগুলো বিজেপির প্রবল জয় আটকে রাখতে পারেনি। তার মূল এজেন্ডা ছিল উন্নয়ন। এবার বিহার নির্বাচনে ৩০টির বেশি জনসভায় তিনি সেটি আবারও তুলে ধরেন। বিহার ভারতের একটি দরিদ্র রাজ্য। কিন্তু মোদির উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখতে পারেনি রাজ্যের ভোটাররা। রাজ্যটিতে কখনও বিজেপির তেমন কোন প্রভাব ছিল না। এখানে জিতলে দলটি জাতীয় রাজনীতিতে একধাপ এগিয়ে যেত। ভারতে আগামী দু’বছরে বেশ কটি রাজ্যে নির্বাচন হবে।
কাজে লাগছে না মোদি কেন্দ্রিক রাজনীতি
গত বছর কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত যে কয়টি রাজ্যে নির্বাচন হয়েছে সব জায়গায় দেখা গেছে মোদি সামনে থেকে প্রচারাভিযান চালিয়েছেন। তার মুখ্যপ্রার্থী প্রার্থীকে জনতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেননি। বিহারেও তাই করেছেন। অন্যদিকে নীতিশ নিজের উন্নয়নের ভাবমূর্তি যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
উত্তর প্রদেশের শিব নদর ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর দীপঙ্কর গুপ্ত মনে করেন, মোদির এখন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার চেয়ে তার দলের মধ্যে দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত। কারণ দলের নেতার প্রতি জনগণের আবেগ উচ্ছ্বাস থিতিয়ে আসলে দল তখন বিকল্প কাউকে সামনে আনতে পারবে না, বিহারে ঠিক এমনটিই ঘটেছে।
মোদি বিরোধী ফ্রন্ট
বিহারে কংগ্রেসসহ তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল নিজেদের ভেতর ঝগড়া বিবাদ ভুলে মোদির বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়েছে। বিরোধী জোটের সফলতার এ উদাহরণ আগামী বিধানসভা নির্বাচনে এবং ২০১৯ সালে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের সময় কাজে লাগতে। সব দল এক হয়ে দাঁড়াতে পারে বিজেপির বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অশোক মালিক বলছেন, ‘স্পষ্টতই ২০১৪ সালের উচ্ছ্বাস মিলিয়ে গেছে, ২০১৯ সালের হাওয়া বইতে শুরু করেছে।’
হারিয়ে যাননি লালু
বিহারের রাজনীতি থেকে লালু প্রসাদ যাদবকে হটিয়ে দেয়া যে সহজ কাজ নয় সেটি তিনি এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভালভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অধিকারী এই রাজনীতিককে তো অনেকেই ভুলতেই বসেছিলেন। কিন্তু এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি জানিয়ে দিলেন যে তিনি হারিয়ে যাননি। ক্ষমতাসীন জনতা দল নেতৃত্বাধীন মহাজোট পেয়েছে ১৭৮টি আসন। এর মধ্যে লালুর রাষ্ট্রীয় জনতা দল পেয়েছে ৭৫টি আসন। লালু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে রাজ্যে অপরাধের হার অনেক বেড়ে গিয়েছিল বলে তার সমালোচকরা বলে থাকেন। তারা এর নাম দিয়েছিল ‘জঙ্গল রাজ’। তবে এতে তার জনপ্রিয়তার কোন হেরফের হয়নি।
অশান্ত রাজনৈতিক মেরুকরণ
বিজিপির মূলমন্ত্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ। একে কাজে লাগিয়ে বিহারে (অন্যত্রও) হিন্দু ভোটগুলো পক্ষে টানার চেষ্টা করে বিজেপি। কোন কোন বিজেপি নেতা এই নির্বাচনকে যার গোমাংস খায় আর যারা খায় না তাদের মধ্যে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে নিয়েছিলেন। তারা বিরোধী দলগুলোর প্রতি এই অভিযোগও করেছিলেন যে এরা স্কুল ও সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘অন্য ধর্মের লোকদের জন্য সুযোগ করে দিতে চায়।’ এই কথা দিয়ে সাধারণত মুসলিমদের বোঝানো হয়ে থাকে। বিজেপির এ কৌশল যে কাজে আসেনি নির্বাচনের ফল তা দেখিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এনডিটিভিকে বলেন, ‘এটি বিহারের জনগণের ইচ্ছা ও আত্মমর্যাদার জয়। মানুষ অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছে।’
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: