ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

দীপনরা কেন খুন হয় কেন খুন হবে

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১৩ নভেম্বর ২০১৫

দীপনরা কেন খুন হয় কেন খুন হবে

(১১ নবেম্বরের পর) গণদল হিসেবে বঙ্গবন্ধু খুনের সমর্থক জিয়া বিএনপির পত্তন করেছিলেন। কারণ সেনাবাহিনীর শাসন ক্রমেই ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল সমাজকে। জামায়াতকেও তিনি শক্তি প্রদান করেন গণদল হতে। জিয়া যে আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন মূলত তা ছিল জামায়াতী আদর্শ। এই ধারার মূল প্রতিনিধি জামায়াত। পার্থক্য খালেদা সূক্ষ্ম শিফন পরেন, নিজামীর স্ত্রী বোরকা পরেন, নিজামী দাড়ি রাখেন, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেন, মওদুদ আহমদ বা এমকে আনোয়ার ট্রাউজার শার্ট বা স্যুট পরেন এবং দাড়িহীন। এলিট বা শিক্ষিত যারা জিয়া-এরশাদ আমলে কলকে পেয়েছেন তারা শহরে বসবাস করেন ও স্যুট বা ট্রাউজার পরাদের সমর্থন করেন। মফস্বল বা গ্রামীণ সমাজ পছন্দ করে পায়জামা-পাঞ্জাবি। তফাৎ এইটুকুই। এদের মিলিত সংখ্যা সেক্যুলার দর্শনে বিশ্বাসীদের থেকেও বেশি। এদের সঙ্গে আছে আরও বিভিন্ন ‘ইসলামী দল’। তারাও প্রকাশ্য দল। এদের অপ্রকাশ্য শাখা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সম্পন্ন গৃহস্থের শহুরে ছেলেদের হিযবুত তাহরীর, গ্রাম বা মফস্বলের মাদ্রাসায় পড়া তরুণদের জামায়াতুল মুদাসসিরিন বা হালের আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। এর উদাহরণ, উত্তরাঞ্চলে শায়েখ আবদুর রহমান বা বাংলা ভাইয়ের উত্থান রাষ্ট্রীয় পোষকতায়। এরা রক্ষণশীল ধর্মীয় সমাজে বিশ্বাসী। এদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে প্রধানত সেনা ও ব্যবসায়ীরা। এদের ফ্রন্ট লাইন সিপাহশালার হচ্ছেন মওদুদ বা মির্জা ফখরুল প্রমুখ। এর উদাহরণ মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থন দিয়েছে বিএনপির শহুরে আধুনিক পোশাক পরা ক্যাডার ও মস্তানরা এবং গ্রাম বা মফস্বলে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা মাদ্রাসার তরুণরা যারা জামায়াতে বিশ্বাসী। পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে দু’টি গণদল ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সমর্থন করেছে। এটি বিরল, অবিশ্বাস্য, অমানবিক একটি ঘটনা যার জন্য এ দু’দেলের কর্ণধাররা লজ্জিত নয়। শক্তিতে ও ক্ষমতায় থাকার জন্য এরা স্ত্রী-কন্যাকে অপরের হাতে তুলে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা অনুভব করবে বলে মনে হয় না। সমাজের এই যে বাতাবরণ তা সৃষ্টি হয়েছে গত তিন দশকে এবং ক্ষমতা ও অর্থ তা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ধারক ও বাহক আওয়ামী লীগ কখনও এর বিরুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি, তেমন চেষ্টাও করেনি। তাদের প্রথম আমলে বিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় থাকতে হয়েছে। ফলে তারা ছিল ডিফেনসিভ, কৌশল ছিল আত্মরক্ষামূলক। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। পুরনো ও বড় দল হওয়ায় আওয়ামী লীগ টিকে গিয়েছিল। কিন্তু বিএনপি জোটের ক্রমাগত নিপীড়ন এমন অভিঘাতের সৃষ্টি করেছিল এবং ব্যবসায়ীরা এত ক্ষতিগ্রস্ত ও ভীত হয়েছিল যে, তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বিশেষ করে শিক্ষক, ছাত্র ও তরুণরা আওয়ামী লীগের মূল শক্তি হয়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগ পরবর্তীতে জয়লাভ করে। ভাল হতো যদি আওয়ামী লীগ তাদের প্রায় বিপর্যস্ত দল শক্তিশালী বা দৃঢ় করে তুলত, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বিকশিত করত এবং তাদের দর্শন যাতে মানসিক জগতে আধিপত্য বিস্তার করে তাতে সচেষ্ট হতো। নজর সেদিকে একেবারে দেয়নি তা বললে ভুল হবে কিন্তু আরও দেয়া উচিত ছিল। বরং তারা সামরিকায়নে গুরুত্ব দিয়েছে সিভিল সমাজের বিপরীতে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে স্থানীয় সরকার দৃঢ়করণে অগ্রসর হয়নি এবং মানসিক জগতে আধিপত্য বিস্তারে ততটা মনোযোগী হয়নি। তারা অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং তাতে আশাতীত সাফল্য লাভ করেছে। এর অর্থ তারা অন্যান্য ক্ষেত্রেও সফল হতো যদি সেরকম মনোযোগ দিত। এবং ঘাটতিটা সেখানে হয়ে গেছে। এটা ঠিক, পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট যাতে নির্দিষ্ট থাকে সেজন্য সরকার শুদ্ধিকরণ করেছে। সেটি সমালোচিত হয়েছে কিন্তু বিএনপি এর চেয়েও ব্যাপক শুদ্ধিকরণ অভিযান পরিচালনা করে ২০০১ সালে। কিন্তু শুদ্ধিকরণ কখনও সম্পূর্ণ হয় না। যে কারণে দেখি কার্যক্ষেত্রে নানা অজুহাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এটিকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যেমন একটি ধাপ, তেমনি মানস জগতে আধিপত্য বিস্তারেরও একটি ধাপ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতি দমনের সুযোগ করে দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত নিজে। ২০০১-৫ সাল এবং ২০০৭-৯ সালে জামায়াত-বিএনপির স্বেচ্ছাচার, আগুনে মানুষ ও ঘরবাড়ি পোড়ানো, হত্যা, গুম, লুট প্রভৃতি সুযোগ করে দিয়েছে জনসমর্থন নিয়ে তাদের দমনে। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আওয়ামী জোটের সমর্থক সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে ভোটের রাজনীতিকে অধিক গুরুত্ব দেয়ায় তাদের দর্শন ফিকে হয়ে গেছে, বিভ্রান্তি বেড়েছে। আমাদের মানস জগতে যে বৈপরীত্য তা প্রভাব ফেলেছে দলের রাজনীতিতেও। ফলে অলিখিত সমঝোতা হয়ে যায় যেখানে দৃঢ়তা প্রয়োজন সেখানে। গত দু’মাসে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা বোঝার জন্য এই পটভূমি। পরস্পর পরস্পরকে সমালোচনা করা যেতে পারে কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ঘটনা ঘটবেই। দীপনরা খুন হয়, খুন হবে। ॥ দুই ॥ গত ৩০ বছর ধরে আওয়ামী লীগকে ব্র্যানডিং করা হয়েছে হিন্দু ভক্ত ইন্ডিয়ান এজেন্ট হিসেবে। পাকিস্তানীরা যা করেছিল গত ৩০ বছর সামরিক শাসক, বিএনপি-জামায়াতরাও তাই করেছিল। আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রতীতি জন্মেছে ভোটের ক্ষেত্রে হেরে যাওয়ার কারণ এই ব্র্যানডিং। তাদের মনে তা গভীর অভিঘাত এনেছে। বঙ্গবন্ধুকেও একই কায়দায় ব্র্যানডিং করা হয়েছিল; কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করে কীভাবে নিজের পথ করেছিলেন, ইতিহাসের এই অভিজ্ঞতা তারা কাজে লাগাননি। তারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন, তাদের মুসলমানত্ব কম নয় এবং তারাও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, তাতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে মাত্র। এটি যে কত বিপজ্জনক ভারতে প্রবলভাবে জয়ী বিজেপি এখন তা অনুধাবন করছে। বিজেপি তার নীতি থেকে সরে না এলে বহুদিনে গড়ে ওঠা ভারতের ভারত্ববাদ তছনছ হয়ে যাবে। দু’একটি উদাহরণ দিই। বাংলাদেশের সিভিল সমাজের ১৯৭৫ থেকে আকাক্সক্ষা সংবিধানের ১৯৭২ সালের রূপ ফিরিয়ে আনা। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদাও ছিল তা, কিন্তু যা হলো, সংবিধানের মূল নীতি ফিরে এল কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রয়ে গেল। তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল। শেখ হাসিনা এ পরিপ্রেক্ষিতে কোন মন্তব্য করেননি বটে, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে তার মনে হয়েছে হয়ত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম উঠিয়ে দিলে বিএনপি-জামায়াত আবারও আওয়ামী লীগকে হিন্দু ভাবাপন্ন বলে প্রতিপন্ন করে ভোটের বাক্স তছনছ করে দেবে। কিন্তু, আরও বাস্তব হলো, ১৯৪৮ সাল থেকে সেক্যুলারপন্থীদের যে ব্র্যানডিং করা হয়েছে তাতে তারা ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করলেও তাদের হিন্দু ভাবাপন্ন বলা হবে। বিএনপি নেতারা যে মুসলমান তা প্রচারের জন্য বক্তৃতা শুরুর আগে বিসমিল্লাহ বলতেন। আওয়ামী লীগ নেতারাও তা অনুকরণ করেন। খালেদা জিয়া-নিজামী-এমএ হান্নান বিমান বন্দরের নাম বদলে রাখলেন শাহ আমানত। শেখ হাসিনা জিয়া বিমানবন্দরের নাম বদল করে রাখলেন হযরত শাহজালাল (র.)। এতে প্রতিশোধ হলো বটে কিন্তু প্রকৃত প্রতিশোধ হলো না, ধর্মের ব্যবহার বাড়ল মাত্র। মাদ্রাসার ওপর তারা গুরুত্ব বৃদ্ধি করলেন। কিন্তু ভোটের মূল সমীকরণ তাতে বদলায়নি। বরং, আওয়ামী লীগের মূল আদর্শ ফিকে হলো। এসব নিয়ে প্রশ্ন ওঠালে বলা হয়, আমরা রাজনীতি বুঝি না। আমরা রাজনীতি বুঝি না তা ঠিক নয়, তা’হলে আওয়ামী লীগকে ভোট দিতাম না বা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের হয়ে প্রচার করতাম না। আমরা রাজনীতিতে আদর্শের জায়গাটিকে গুরুত্ব দিই। এসব সত্ত্বেও বলতে দ্বিধা নেই শেখ হাসিনার মতো আর কোন নেতা এত দৃঢ়ভাবে জঙ্গী দমনে অগ্রসর হননি। প্রতিদিনই তো অপ্রকাশ্য জঙ্গী ও প্রকাশ্য জঙ্গী শিবির- জামায়াত কর্মীরা অস্ত্রসহ ধরা পড়ছে অনেক সময় সহযোগী পাকিস্তানীদের সঙ্গে। তারপরও পুরোপুরি জঙ্গী দমিত হচ্ছে না কেন? বা গত দুই মাসের কথা যদি ধরি তা’হলে বিদেশী, অন্তর্জাল লেখক, পুলিশ কেন নিহত হচ্ছে? তাজিয়া মিছিলের ৪০০ বছরে এই প্রথম বোমা হামলা হচ্ছে। এ প্রশ্ন জাগতে পারে। শেখ হাসিনা দৃঢ়চেতা নেতা। আমাদের এ বিশ্বাস আছে যে, তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান, অপরাজনীতির বিনাশ চান, জঙ্গীবাদের শিকড় উপরে ফেলতে চান। তিনি না হলে মানবতাবিরোধীদের বিচার হতো না। এ দেশের কেউ কখনও ভাবেনি যে, বঙ্গবন্ধু হত্যা বা নিজামী-গোলাম আযমদের বিচার হতে পারে। তিনি সুপার পাওয়ারদের ডিকটাট অনেক সময় অগ্রাহ্য করেছেন। আত্মমর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছেন। বিদেশেও স্বীকৃত যে, জঙ্গী দমনে তিনি শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে বিশ্বাসী। তারপরও, এ প্রশ্ন উঠবে যে, জঙ্গী তো দমিত হচ্ছে না। এর একটি কারণ হতে পারে, মানস জগতে বিকল্প আদর্শ জায়গা করে নিতে পারেনি। এছাড়া, তার পাশে যেসব উপদেষ্টা, মন্ত্রী, দলীয় নেতা আছেন তারা বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেন কিনা সন্দেহ। বরং, তারা বিভিন্ন বিভ্রান্তি তৈরি করেন। ফলে, অনেক ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক ভূমিকা কাক্সিক্ষত ফল আনে না। এবং এ কারণে সমাজে ফের স্থিতাবস্থা সৃষ্টি হয়। কয়েকটি উদাহরণ দিই। চলবে...
×