ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১৩ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজে (১১ নবেম্বরের পর) কলেজের শিক্ষকবৃন্দের সঙ্গে আমার খুব সুসম্পর্ক ছিল। তাদের বেশিরভাগই আমাকে কোন বিষয় পড়াতেন না; কিন্তু আমাকে খুব ¯েœহ করতেন এবং আমার দেখাশুনা করতেন। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ এখলাস আমার পড়াশুনা নিয়ে এতই সতর্ক ছিলেন যে, আইএ পরীক্ষার কিছুদিন আগে আমি সিলেট জেলার স্কুল টুর্নামেন্টের কোন একটি খেলায় যখন আম্পায়ারের কাজ করি তখন তিনি খুবই ক্ষুব্ধ হন। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন যে, আমার পরীক্ষা সামনে রয়েছে, সেজন্য লেখাপড়ায় বেশি নজর দেয়া দরকার। তিনি সেদিন সন্ধ্যাবেলা আমার আব্বার কাছে নালিশ করেন যে, আমি লেখাপড়ায় নজর না দিয়ে খেলাধুলায় সময় নষ্ট করছি এবং সেটা আমার জন্য ভাল নয়। আমার আর একজন শিক্ষক আবদুল জলিল চৌধুরী আমাকে একদিন ডাকলেন। তিনি ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন এবং আমাকে ইতিহাস পরীক্ষায় খুব বেশি নম্বর দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে দিয়েছিলেন ৮৮। তিনি বললেন যে, এই বেশি নম্বর দেয়ার জন্য কতিপয় শিক্ষক এটি নিয়ে হাসি-মশকরা করেন এবং তার সেটা মোটেই ভাল লাগেনি। তিনি আমাকে বললেন যে, তুমি ইতিহাসে খুব ভাল এবং আমি আশা করব যে, তুমি আইএ পরীক্ষায় আমার মান রাখবে। অত্যন্ত সুখের বিষয় যে, আইএ পরীক্ষায় ইতিহাসে আমার দুটি পরীক্ষায় একটাতে আমি পাই ৮৮ এবং অন্যটাতে পাই ৮০। পরীক্ষার ফল পাওয়ার পর আমি তাকে রাজশাহীতে চিঠি দিয়ে আমার নম্বর জানিয়ে দিই। তিনি এতে অত্যন্ত প্রীত হন এবং আমাকে একটি প্রশংসাসূচক চিঠি লেখেন। বাংলার অধ্যাপক পল্লীগীতি ও লোকসাহিত্য সংগ্রাহক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের সুদৃষ্টি আমার ওপর পড়ে এবং সারাজীবন তিনি ছিলেন আমার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। তার অবসরান্তে তিনি ঢাকায় শান্তিনগর বসবাস শুরু করেন, যেখানে আজও তার উত্তরাধিকারীরা আছেন। যখন পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয়ে চাকরি করি তখন আমি কাছেই বেইলি রোডের বর্তমান অফিসার্স ক্লাবে থাকতাম। সেখানে থাকতে আমাকে প্রায়ই অধ্যাপক সাহেবের বাসায় যেতে হতো নানা কাজে তাকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে। অর্থনীতির অধ্যাপক পরবর্তীকালে বহু কলেজে অধ্যক্ষ ও শিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালক মিসবাহুল রব চৌধুরী এখনও আমাকে তার ¯েœহধন্য ছাত্র বলে দেখেন। দর্শনের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কোন পারিবারিক হত্যা মামলার আসামি হিসেবে ঢাকা জেলে যখন ছিলেন তখন কিছুদিনের জন্য আমিও সেখানে রাজবন্দী ছিলাম। তিনি শ্রেণীপ্রাপ্ত কয়েদী হিসেবে ভাল খাবার পেতেন এবং প্রায়ই আমার ও আমার বন্ধু-বান্ধবের জন্য ভাল খাবার সরবরাহ করতেন। ইতিহাসের অধ্যাপক আবদুল মুনিম চৌধুরী আব্বার সহপাঠী ছিলেন এবং তিনি কয়েক মাস আমাদের পড়িয়ে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে চলে যান। পরে তিনি লন্ডনে শিক্ষা এ্যাটাশী হিসেবে নিযুক্তি পান। দর্শনের অধ্যাপক আমার আত্মীয় শামসুজ্জামান চৌধুরী কিছুদিন পরেই ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি হন। দর্শনের আর একজন শিক্ষক আবদুল হাই (পরবর্তী সময় আমার ছোট বোন নাজিয়ার শ্বশুর) রাজশাহী কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি হন। অঙ্কের আরও দু’জন শিক্ষক মুহিব আলী ও আবদুল মতিন ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। মুহিব সাহেব কলেজে নিকটস্থ টিলাগড়ে এক ধান ক্ষেতের মাঝখানে থাকতেন। অধ্যাপক সোলেমান যেমন সব বিষয়ে দ্রুতগতি পছন্দ করতেন মুহিব সাহেবের স্টাইল ছিল আস্তে-ধীরে। মতিন সাহেব ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং তার ছিল মধ্যমমানে অবস্থান- দ্রুতগতিও না, শ্লথও না। তবে তিনি ছিলেন একটু লাজুক প্রকৃতির। কথাসাহিত্যিক আবু রুশদ মতিন উদ্দিন কিছুদিনের জন্য ইংরেজী বিভাগে অধ্যাপক ছিলেন। তিনি এক রকম চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলতেন এবং আস্তে আস্তে পড়াতেন। পরবর্তীকালে তিনি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে হন আমার সহকর্মী। তিনি ছিলেন শিক্ষা কাউন্সিলর, আমি যেখানে ছিলাম অর্থনৈতিক কাউন্সিলর। আমরা প্রায় একসঙ্গে পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস গড়ে তুলি। দূতাবাসে তখন আরও বাঙালী কর্মকর্তা ছিলেন হিসাব বিভাগে। অন্যান্য শিক্ষক যাদের সঙ্গে আমার বিশেষ যোগাযোগ ছিল তারা ছিলেন রসায়ন বিভাগের প্রধান আমার বন্ধু সুবিমলের পিতা সত্যেন্দ্র রায় চৌধুরী, পদার্থ বিজ্ঞানে দেওয়ান মোহাম্মদ আহমদ চৌধুরী, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের নতুন শিক্ষক গোলাম রসুল। আমরা কলেজে ভর্তি হবার সামান্য ক’দিন পর পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের হোসেন আলী (কলকাতাস্থ ডেপুটি হাইকমিশনার-একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুপরিচিত), রসায়ন বিভাগের এবিএস সফদর, ইংরেজী বিভাগের একেএম আহসানুল্লাহ ১৯৪৮ সালের কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিসেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সফল প্রার্থী হিসেবে যথাক্রমে কেন্দ্রীয় সরকারের ফরেন, পুলিশ ও পোস্টাল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৫০ সালে ইংরেজী সাহিত্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ রোমান্টিক কবি ডরষষরধস ডড়ৎফংড়িৎঃয-এর শতবর্ষ পালন উপলক্ষে পাকিস্তান ব্রিটিশ কাউন্সিল একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। কবি ডড়ৎফংড়িৎঃয আমার একজন পছন্দের কবি ছিলেন এবং তার আদর্শ কন্যা লুসি সম্বন্ধে আমার ধারণা ছিল যে, এমন চমৎকার প্রকৃতিকন্যা বাস্তবে পাওয়া মুশকিল। আমি ঠিক করলাম যে, এই প্রিয় কবি সম্বন্ধে আমি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করব। বিষয়টি নিয়ে আমি কিছু পড়াশোনা করলাম এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলাম। আমার প্রবন্ধে আমি আমার ধারণার প্রমাণস্বরূপ ডড়ৎফংড়িৎঃয-এর অনেক কবিতা থেকে উদ্ধৃতি সন্নিবেশিত করি। প্রতিযাগিতায় দুটি শ্রেণী ছিল। প্রথম শ্রেণীটি ছিল স্নাতকোত্তর ছাত্রদের জন্য, আর দ্বিতীয় শ্রেণী ছিল কলেজ ছাত্র যারা তখনও স্নাতক পরীক্ষা দেয়নি তাদের জন্য। আমি কলেজ ছাত্র হিসেবে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। তখন আমরা হাতে লেখা প্রবন্ধই প্রতিযোগিতায় পেশ করি। আমাকে তাই দুটি কপি নিজ হাতে লিখতে হয়। কিছুদিন পরে এই প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার ফলাফল করাচি থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিল ঘোষণা করলো। ঢাকার একজন ছাত্র আশরাফ আলী লাহোরের একজন কলেজ ছাত্রী ফারজানা আহমেদ এবং আমি পুরস্কার পাই। আমাদের নামও রেডিওতে ঘোষণা করা হলো, খবরের কাগজেও সংবাদটি বেরুলো। আরও কিছুদিন পরে করাচি ব্রিটিশ কাউন্সিল আমাকে একটি পুরস্কার ঘোষণা, বিবৃতি এবং পুরস্কার হিসেবে একটি ইংরেজী কবিতা সংকলন পাঠালো। খবরের কাগজের এই ঘোষণাটি পরবর্তীকালে আমার খুবই অপছন্দ হলো। কারণ, ঘোষিত প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি আশরাফ আলী ইতিমধ্যেই বিএ পাস করেছেন এবং সম্ভবত এমএও পাস করেছেন। আমার মনে হলো যে, তিনি শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন। আমি পাই দ্বিতীয় পুরস্কারটি আর ফারজানা আহমদ পান তৃতীয় পুরস্কার। এই পুরস্কার প্রাপ্তি আমাকে বেশ খ্যাতি লাভ করে এবং আমি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে প্রশংসাপত্র পেতে থাকি। প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় এই সাফল্য আমাকে আর একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে। তখন জাতিসংঘ নতুন স্থাপিত হয়েছে এবং নিউইয়র্কের জাতিসংঘ এ্যাসোসিয়েশন একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা ঘোষণা করল ১৯৫১ সালে। প্রবন্ধটির বিষয় ছিল ঞযব জঁষব ড়ভ টহধহরসরঃু. এবং প্রতিযোগীদের বয়স ছিল সতেরোর্ধ্ব স্নাতক বা নিম্নশ্রেণীর ছাত্রবৃন্দ। আমি এই প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম এবং আমার উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক হলেন অধ্যাপক আবদুস সোবহান খান চৌধুরী। আমি এবিষয়ে একটি প্রবন্ধ মোটামুটিভাবে রচনাও করে ফেললাম। তখন দেখা গেল যে, আমার বয়স সতের-এর নীচে। আমি এবং অধ্যাপক খান চৌধুরী কয়েক মাসের কম বয়সের জন্য রেয়াতি চেয়ে অনেক আবেদন-নিবেদন করে ব্যর্থ হলাম। এই প্রবন্ধের একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল যে, সফল প্রতিদ্বন্দ্বীর নিউইয়র্ক ভ্রমণের সুযোগ ছিল। কোন কোন বয়সে হাত দেখানো এবং হাতের রেখা পড়া নেশার মতো হয়ে যায়। ষোলো বছর থেকে আমার এই নেশা পেয়ে বসে। একজন জ্যোতিষীকে ডেকে আমি আমার হস্তরেখা বিশ্লেষণের ব্যবস্থা করলাম। জ্যোতিষীর কাছ থেকে পামিস্ট্রির ওপর অনেক বইও সংগ্রহ করলাম। জ্যোতিষী আমার একটি ঠিকুজী প্রস্তুত করে দিলেন এবং বললেন যে, আমার হস্তরেখায় নৌভ্রমণ নেই অর্থাৎ আমার বিদেশ যাত্রা নেই। আমি তখন আমার হস্তরেখা পরিবর্তন করার জন্য ছুরি দিয়ে কেটে একটি নৌযাত্রার রেখা বানালাম। কিন্তু সেটা খুব বেশিদিন স্থায়ী হলো না। আমার মনে হলো, নিউইয়র্কে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যাওয়ার সুযোগ এই হস্তরেখার কারণে আমার হয়নি। আমার আগের বছর আইএ পরীক্ষায় যে প্রথম স্থান অধিকার করে আমার বন্ধু ওয়াশিংটন নিবাসী আজিজুল জলিলকে ঘবি ণড়ৎশ ঐবৎড়ষফ ঞৎরনঁহব পত্রিকা আমেরিকা ভ্রমণের সুযোগ করে দেয়। আমি স্বাভাবিকভাবে ১৯৫১ সালে সেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী আমার দাদা শিক্ষা ডাইরেক্টরেটের পরামর্শে সিদ্ধান্ত দিলেন যে, প্রবেশিকা পরীক্ষায় যে সেবার প্রথম হয়েছে সেই এই আমেরিকা ভ্রমণে যাবে। আমি তার কাছে অভিযোগ করার আগেই তার সিদ্ধান্ত কার্যকরী হলো। সে বছর মতলবের ছাত্র আবদুল মতিন পাটোয়ারি (পরবর্তীতে গাজীপুর ইসলামিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারের সুবাদে আমেরিকা ভ্রমণের সুযোগ পায়। এসব কারণে বিদেশ ভ্রমণে সুযোগ না পাওয়া আমাকে বেশ বিচলিত করে। ১৯৫২ সালে এই রকম বিদেশ ভ্রমণের আর এক সুযোগ আমার হলো না। সেবার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল তুরস্ক সফরে যায়। সেখানেও আমি বাদ পড়লাম যদিও আমার দাদার তদ্বিরে আর এক সমসাময়িক ছাত্র এই সুযোগটি পায়। আমার দাদার কাছে যখন আমি অভিযোগ করলাম যে তার হস্তক্ষেপে অনেকেই বিদেশ গেল আর আমি আমার পাওনা সুযোগ পেলাম না তখন তিনি বললেন যে তিনি জানতেনই না যে আমার এই ভ্রমণের সুযোগ ছিল। যাই হোক, বাস্তব কর্মজীবনে বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে অভিযোগ করার বা বঞ্চিত মনে করার কোন সুযোগই আমার ছিল না বরং এক এক সময় আমি বিদেশ ভ্রমণ করে পরিশ্রান্ত হয়ে যাই এবং এখনো সেই অনুভূতি মাঝে মধ্যে হয়। চলবে...
×