ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামীর নিষ্ঠুর নির্যাতনে দু’ চোখ হারিয়ে এখন শুধু অন্ধকারময়

শিউলীর পৃথিবী-

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৩ নভেম্বর ২০১৫

শিউলীর পৃথিবী-

আরাফাত মুন্না ॥ আমার চোখ কি কোনভাবেই কিছু করা যাবে না? বাংলাদেশে কি কোন চিকিৎসাই নেই। এই অন্ধকার জীবন নিয়ে আমার বেঁচে থেকে কি লাভ। আমার এ অন্ধকার জীবনের জন্য যে দায়ী তার বিচার চাই, তাহলে আমি কিছুটা হলেও শান্তি পাব। হাসপাতালের বেডে বসে বলছিলেন, স্বামীর বর্বরতার শিকার হয়ে দুচোখ হারানো টঙ্গীর শিউলী আক্তার। শিউলির অপারেশন হয়েছে তবে চোখের আলো ফেরেনি। সাদা-কালো আর দিন-রাত, শিউলির কাছে সবই সমান। যে ছেলে-মেয়ে-ভাইকে এতদিন একটু দেখার জন্য পাগল হয়ে যেতেন, সেই ছেলে-মেয়ে-ভাই চোখের সামনে থাকলেও, তাদের দেখতে পান না শিউলি। স্বামীর নিষ্ঠুর নির্যাতনে দুচোখ হারিয়ে পৃথিবীটাই অন্ধকার হয়ে গেল তার। ইতোমধ্যেই চিকিৎসক বলে দিয়েছেন, শিউলি আর কোন দিন দেখতে পাবেন না, হয়তো স্বাভাবিক দেখানোর জন্য নকল চোখ লাগানো যাবে কয়েকদিন পরে, কিন্তু তাতে দৃষ্টি আর ফিরবে না। গত শনিবার অপারেশন শুরুর আগেই শিউলির স্বজনদের এ কথা জানিয়েছিলেন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডাঃ শওকাত আরা শাকুর। বুধবার হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডাঃ আতিকুল হক সাংবাদিকদের বলেন, শিউলির দুটো চোখই উপড়ে ফেলা হয়েছে, ভেতরে আর কিছুই নেই। তাই তার দৃষ্টি কোন দিনই ফিরবে না। শিউলিকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে কবে জানতে চাইলে ডাঃ আতিকুল হক বলেন, সময় লাগবে। গত সোমবার চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হলেও ওর চোখের যেসব সেলাই আছে, সেগুলো শুকাতে সময় লাগবে, আর সে মানসিকভাবেও অনেক ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় বাড়ি যাওয়াটা অনুচিত বলেই মনে করছি। কারণ, এখানে সে আশপাশে মানুষ পাচ্ছে, আমরা চিকিৎসকরা তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলছি বারবার, হাসপাতালেই অন্য সব কর্মকর্তা-কর্মচারী তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলছে, এতে সে এখানে মানসিকভাবে কিছুটা হলেও ভাল থাকছে, কিন্তু বাড়ি ফিরলেই এক ধরনের ট্রমা তাকে আবার ঘিরে ধরবে। তখন সেটা তার শরীরের জন্যও অনেক খারাপ হবে। এসব কথাভেবেই তাকে আরও বেশ কিছুদিন হাসপাতালে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। বুধবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, শিউলির পাশে বসে রয়েছেন ভাই রনি ও মেয়ে আঁখি। কালো চশমা পরে শিউলি দুজনের মাঝে বসে কথা বলছেন। শিউলির ভাই রনি বলেন, সাত/আট বছর থেকেই তিনি বড় বোনের সঙ্গে থাকেন। বড় হওয়া এ বোনের কাছেই, বোন-বন্ধু-মা সবই ছিল এই বোন। কিন্তু ২০০৯ সালে শিউলির প্রথম স্বামী আয়নাল চৌধুরী মারা যাওয়ার পর বোন দ্বিতীয় বিয়ে করলে সম্পর্কে ফাটল ধরে ভাই বোনের। মায়ের মতো বোনের কাছ থেকে দূরে সরে আসেন তিনি। রনি বলেন, ঘটনার আগের দিন তিনি বোনকে ফোন দেন ভুনা খিচুরিতে ডাল কিভাবে, কখন দিতে হবে জানার জন্য। কিন্তু ফোন ধরেন জুয়েল। তিনি জানতে চান, কেন শিউলির সঙ্গে কথা বলতে হবে। কারণ, জুয়েল কারও সঙ্গেই শিউলিকে কথা বলতে দিতে চাইতেন না। সেদিন অনেক কষ্টে বোনকে ফোনে পান ঠিকই, কিন্তু তার গলাটা যে কান্নাভেজা ছিল। সেটা ভাই রনি ঠিকই বুঝতে পারেন ফোনের ওই প্রান্ত থেকে। খিচুরি রান্নার পদ্ধতি বোনের কাছ কাছ থেকে শুনে ফোন কেটে দেন রনি। পরদিন দুপুর আড়াইটার দিকে জুয়েলের ফোন পান তিনি। রনির ভাষ্যমতে, জুয়েল কনফার্ম হতে চেয়েছিল আমি ঢাকায় আছি না কি নেই। কারণ, তিনি যে এই কাজ করবেন, সেটা ঠিক করে রেখেছিলেন। রনি ঢাকার বাইরে আছে জানতে পেরে ফোন রেখে দেন জুয়েল। পরদিন রনি আবার ফোন পান, শিউলির বাড়িওয়ালার কাছ থেকে। রনি বলেন, দুচোখ ওপড়ে নেয়ার পর জ্ঞান হারিয়েছিলেন শিউলি। তারপর যখন একবারের জন্য জ্ঞান ফেরে, তখন শুধু আমার ফোন নম্বরটাই বলতে পেরেছিলেন। আমি তখন বলি, শুধু বোনকে ফোনটা দেন, আমি শুধু ওর একটু কথা শুনতে চাই। তাকে ফোনটা দিলে তিনি শুধু বলেন, ‘ভাই আমাকে বাঁচা, আমাকে অন্ধ করে দিছে।’ আমাকে ফোনে জানানো হয়েছিল আমার বোন হাসপাতালে কিন্তু সেই অবস্থা যে এত ভয়াবহ আমি বুঝতেও পারিনি। বোনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে রনি বলেন, শুধু আমি কেন, পৃথিবীর কোনও মানুষই বোধ হয় না দেখলে এটা ভাবতে পারবে না। মানুষ কত নৃশংস হয়, কত বিকৃত হয়, বলছিলেন রনি। শিউলি হাসপাতাল থেকে ফিরে কোথায় থাকবে জানতে চাইলে রনি বলেন, বোনের কাছে বড় হয়েছি, মায়ের মমতা পেয়েছি। রাগ হয়ে একসময় দূরে ছিলাম, কিন্তু এখন তো বোনকে ফেলে দেব না। আমি চাইব, ছোটবেলায় বোন যেভাবে আমাকে যতœ করে তার কাছে রেখেছিলেন, এখন আমি তাকে সেভাবে যতœ করে আমার কাছে রাখব। তবে তার যেখানে ইচ্ছা, তিনি সেখানেই থাকবেন। সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে শিউলি বলেন, বৃহস্পতিবার বিকালে ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমার হাত-পা বেঁধে ফেলেন জুয়েল। মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দেন। এরপর চাকু দিয়ে আমার চোখে আঘাত করেন। এক সময় আমি বুঝতে পারি, আমার এক চোখ নেই। তারপর আর কিছু মনে নেই। পরে জ্ঞান ফিরলে কোন রকমে মুখের স্কচটেপ খুলে জানালার কাছে গিয়ে চিৎকার করি। আর কিছু বলতে পারি না আমি। শিউলির পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শিউলির প্রথম স্বামী আয়নাল হক চৌধুরী ২০০৯ সালে খুন হন। সেই খুনের মামলায় শিউলি, শিউলির বর্তমান স্বামী জুয়েল এবং শিউলির বড় ভাইকে আসামি করে মামলা করেন আয়নালের মা। ওই মামলায় শিউলি জেলও খাটেন ছয় মাস। শিউলির দ্বিতীয় স্বামী জুয়েল ও আয়নাল সম্পর্কে চাচাতো ভাই। উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার (৫ নবেম্বর ) টঙ্গীর জামাইবাজার এলাকায় স্বামীর বর্বরতার শিকার হয়ে দুচোখ হারান শিউলি আক্তার। এ ঘটনায় গত শনিবার রাতেই দুর্বৃত্ত স্বামী জুয়েলের বিরুদ্ধে টঙ্গী মডেল থানায় নারী নির্যাতন আইন-২০০০ (সংশোধনী-২০০৩) এর ১১ (ক) এবং ১১ (খ) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়।
×