ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আশরাফ জামান

প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে সমাজচিত্র

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ১৩ নভেম্বর ২০১৫

প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে সমাজচিত্র

বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন আমরা চর্যাপদেই পাই। চর্যাপদগুলোর মাধ্যমে বৌদ্ধ সিদ্ধচার্যরা যে ধর্মমত প্রচার করেন সেগুলোর আলোচনা করলে বৌদ্ধ ধর্মমতের বিভিন্ন যান বা সাধন পদ্ধতির সমন্ব^য়টাই যে সিদ্ধাচার্যদের সমসাময়িককালে বাংলাদেশে আত্মবিস্মৃতি ও আত্মস্বতন্ত্র রক্ষার প্রেরণা যুগপৎভাবে কার্যকর হয়েছিল এবং সে বোধের স্বাক্ষর চর্যাপদের বিভিন্ন গানে দেখা যায়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত চর্যাচর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাপদে আমরা বৌদ্ধমত ও তাদের আচরণ ইত্যাদির স্পষ্ট পরিচয় পেয়ে থাকি। চর্যাপদের স্বাভাবিক লোকজীবনের রেখার মধ্যে লুকিয়ে আছে তাদের ধর্মমতের মূল কথা। সাধারণ মানুষের জীবন চরিতরূপে চর্যাপদে কর্তাগণ ধর্মের কথাই ব্যাপকভাবে বর্ণনা করেছেন। ড. নিহার রঞ্জন রায় বলেছেন : ‘এ তথ্য সর্বজনস্বীকৃত যে, আর্যব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ জৈন ইত্যাদি সম্প্রদায়ের ধর্ম, শ্রাদ্ধ, বিবাহ, জন্ম-মৃত্যু প্রভৃতি সংক্রান্ত বিশ্বাস, সংস্কার ও আচার অনুষ্ঠান নানা দেব-দেবীর রূপ ও কল্পনা আহার-বিহারের ছোঁয়াছুয়ি অনেককিছু আমরা সেই আদিবাসীদের নিকট হইতে আত্মসাৎ করিয়াছি।’ ॥ দুই ॥ প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক পর্বে তিনটি ধর্মের প্রভাব দেখা যায়। যেমন ১. জৈন ২. বৌদ্ধ ও ৩. আর্য-ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। জৈন ও বৌদ্ধধর্ম বেদবিধি ও যাগযজ্ঞের বিরোধী ঈশ্বর অবিশ্বাস হলেও ব্রাহ্মণ চিন্তারই প্রতিক্রিয়া রূপ। বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়া ধর্মের সাধন প্রক্রিয়ার গূঢ়ার্থ সংকেতই চর্যাপদের মূল উদ্দেশ্য। কোনটা আচরণীয় কোনটা অ-আচরণীয় তা সুনির্দিষ্ট নিশ্চিতরূপে নির্ণয় করা যেতে পারে চর্যাপদ দ্বারা। যে ধর্মসাধনা ছিল আসলে মহাযান বৌদ্ধভাবনা প্রভাবিত বজ্রযানী সাধন ধারার অংশ বিশেষ। বৌদ্ধমতের দার্শনিক ভাবনার দুটি বিভাগ। ১. হীনযান ২. মহাযান। যান অর্থ বাহন প্রক্রিয়া, পদ্ধতি বা পথ বোঝানো হচ্ছে। তবে বুদ্ধ নিজে ধর্মের পদ্ধতির কখনো দার্শনিক ব্যাখ্যা দেননি। অর্হৎ-ত্ব অর্জনই হীনবাণী সাধনার চরম উদ্দেশ্য ছিল। অর্হৎ-ত্ব অর্থে বুদ্ধ নির্দেশিত পথে নির্বাণ সিদ্ধিকেই বোঝানো হয়েছে। মহাযানী সাধন পন্থার পরিণামী উদ্দেশ্য নির্বাণ লাভ অর্থে অনস্তিত্বে বিলুপ্ত হওয়া নয়, বুদ্ধত্বলাভ বোধিসত্ত্বত্ব বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে মহাজ্ঞান আয়ত্ত করে তবেই পরিণামী বুদ্ধত্বে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। হীনযানীদের দৃষ্টিতে নির্বাণ একটি অনস্তিত্ব মূলক অবস্থা : অন্য পক্ষে মহাযানী দর্শনে বুদ্ধত্বের পরিকল্পনার অপেক্ষাকৃত ইতিবাচক। চর্যাপদের কবিতাগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো বিশেষ ধর্মীয় আচরণ সম্বন্ধে ইঙ্গিতদান করা। তাহলেও প্রসঙ্গত পদকর্তারা সমকালীন লোকজীবনের ছবি এঁকেছেন সেগুলো তৎকালীন সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক ইতিহাসের চিত্তাকর্ষক সামগ্রী। পদগুলো সেকালের সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা। শ্রম ও বিশ্রাম, কাজ ও আনন্দ, জন্ম ও মৃত্যু। বিবাহ ও উৎসব, পূজা-অর্চণা, ক্রিয়াকর্ম, পারিবারিক জীবন, বস্ত্র, অলঙ্কার দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত খাদ্যদ্রব্য, বাসনপত্র, অপরাধবিচার পদ্ধতি, সংগীত ও তত্ত্বতার উপকরণ ইত্যাদি বৌদ্ধ সংস্কৃতি বিষয়ের বহু শিল্পসম্মত বিবরণ আমরা পেয়ে থাকি। বেশির ভাগ চর্যার ডোম-ডোমনি, শবর-শবরী, নিষাদ-কাল্পনিক এদের কথা বলা হয়েছে। ডোম, নিষাদ, শবর শবরী এসকল ‘নিচু’ জাতি গ্রামের বাইরে উঁচু পর্বতে বা বনে জঙ্গলে বাস করতো। কাহ্নপার ১০ নং চর্যায় পাই নগর বাহিরে যে ডোম্নী তোহেরি কুড়িয়া। ছোই ছোই যাইসি ব্রাহ্ম নাড়িয়া। অর্থাৎ রে ডোম্নী নগরের বাইরে তোমার কুঁড়েঘর, ব্রাহ্মণ নেড়াকে তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও। বৌদ্ধ মতাবলম্বীরা চর্যাপদে রূপকের মাধ্যমে সুন্দরভাবে তাদের মত প্রকাশ করতেন। এর একটি সুন্দর উদাহরণ আমরা চাই একটি পদে- দুলি দুহ্নি পিটা ধরন ন জাই। রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ। অর্থাৎ কাছিম দুইয়ে পিটা ধরা যাচ্ছে না, গাছের তেঁতুল কুমিরেই খায়। রূপকার্থে এখানে বলা হয়েছে যারা অনভিজ্ঞ তারা চিত্তকে নির্বাণ মার্গে চালিত করতে পারে না, সহজানন্দও উপভোগ করতে পারে না, যে গুরুর উপদেশ পেয়েছে সে কুম্ভক সমাধির সাহায্যে তার চিত্তকে নিঃস্বভাবে নিয়ে যেতে পারে। ডোমজাতীয় নারী যেমন অস্পৃশ্যতা হেতু নগরের বাইরে থাকে আর তার রূপমুগ্ধ কামান্ধ ব্রাহ্মণ তার কুঁড়েঘরের পাশে ঘোরাঘুরি করে কিন্তু সেই রমণীকে আয়ত্ত করতে পারে না তেমনি সমস্ত জ্ঞান সম্বল করে বাইরে সাধকরা তাঁকে পেতে চান, কিন্তু তাঁরা সেই নৈরাত্মাদেবীর আভাস মাত্র পান করে তাকে অর্থাৎ নির্বাণরূপ মহাসুখকে আয়ত্ত করতে পারেন না। কারণ কেবল শাস্ত্রজ্ঞানে সেই মহাসুখকে পাওয়া যায় না। কাহ্নপাদ তাই ঘৃণা লজ্জা ত্যাগ করে ‘নগ্ন হয়ে অর্থাৎ অন্তরের যাবতীয় লোকাচার ও শাস্ত্রীয় গোঁড়ামিকে ত্যাগ করে সেই নৈরাত্মাদেবীকে পাবার জন্য কাপালিক হয়েছেন নিজেকে সেই সাধানার’ যোগ্য করেছেন। নৈরাত্মাদেবীর সঙ্গে মিলিত হয়ে অনুভব করেছেন, চৌষট্টি পাহাড়যুক্ত একটি পদ্মে উঠে তিনি নৈরাত্মাদেবীর সঙ্গে নৃত্য করছেন। একসো পদুমা চৌষট্টী পাখুরি তাই চড়ি নাচত্ম ডোম্নী বাপুড়ি (১০ নং) চর্যাপদবিশ্লেষণ করলে আমরা বৌদ্ধমত ও তাদের সংস্কৃিত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নিতে পারি। ॥ তিন ॥ সেকালে দেশে কাপালিক যোগিনী দেখা যেত। তারা ডমরু বাজাতো, কানে কুন্ডল, পায়ে ঘণ্টা ও নূপুর পরতো। নটী ও গায়িকাবৃত্তি ছিল ডোম মেয়েদের একচেটিয়া কাজ। তাঁত ও বাঁশের দোতারা বানাতো ও বিক্রি করতো। তাদের হাতি ও উট গৃহপালিত জন্তু ছিল। পাগলা হাতি বাখোর (খুটি) ভেঙ্গে অনর্থ বাধাতো। হরিণ শিকার এদের জনপ্রিয় ছিল। শিকারীকে বলতো অহেরী। দাবা খেলার প্রচলন ছিল একথা চর্যাপদে পাওয়া যায়। ছককে বলতো পীঢ়ি তাতে চৌষট্টি কোটা থাকতো। রাজাকে ঠাকুর বলতো। বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল। শুকনো লাউয়ের খোলে তাঁতের তার দিয়ে এবং দা-ি ও চাকি দিয়ে বীণা তৈরি করা হতো। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হতো ঘটা করে। পড়হ, মাদল, করন্ড, কমালা এবং দুন্দুহি বাদ্য বাজাত। বরকন্যা খাটে শুত, কর্পূর দিয়ে পান খেতো। নদীতে পুণ্যের জন্য সাঁকো তৈরি করতো। মুদ্রা হিসেবে কড়ি ও বুড়ির প্রচলন ছিল। প্রায় ডোমনী মেয়েরা নৌকা চালাত। নদীপথে নৌকা চলতো এবং ব্যবসা বাণিজ্যের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতো। জলপথে খান্টের (ডাকাতের) ভয় ছিল। দোকানদারি চলতো। চিকন বাকল দিয়ে ধেনোমদ গাঁজা তৈরি করত। কাপালিকেরা মদ খুব পছন্দ করতো। উঁচু উঁচু পাবত, তহি বসই শবরি বালি। বাদিয়ারা সাপ ধরতো ও সাপের খেলা দেখাতো। চর্যাপদের মাধ্যমেই আমরা বৌদ্ধমত ও সংস্কৃতি এবং তৎকালীন বাংলাদেশের সমাজ চিত্রের পরিচয় পেয়ে থাকি। এক থেকে দেড় হাজার বছর পূর্বের এদেশের মানুষের সামাজিক চিত্র এটি।
×