ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাবেক ছিটের উন্নয়নে আসছে ১৯৫ কোটি টাকার প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৪ নভেম্বর ২০১৫

সাবেক ছিটের উন্নয়নে আসছে ১৯৫ কোটি টাকার প্রকল্প

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ সাবেক ছিটমহলগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে প্রথম প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। এ জন্য পরিকল্পনা কমিশনে ১৯৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবটি (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। কমিশন শীঘ্রই এ প্রস্তাব নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা আহ্বান করবে। এরপর প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে চূড়ান্ত অনুমোদনের ব্যবস্থা করা হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল এ বিষয়ে বলেন, বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে দ্রুত সময়ে বিদ্যুত, পানি ও অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘ সময় ছিটমহলবাসী নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। এখন ওই অঞ্চলগুলোর উন্নয়নে যে প্রকল্পই পাঠানো হবে তা দ্রুত অনুমোদনের ব্যবস্থা করা হবে। সূত্র জানায়, বিলুপ্ত ছিটমহলসমূহের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণের কাজ করছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পের মাধ্যমে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম জেলার বিলুপ্ত ছিটমহল অঞ্চলের ১৩টি উপজেলার উন্নয়ন করা হবে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন (জিওবি) থেকে এ বরাদ্দ দেয়া হবে। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০১৮ সাল নাগাদ এর কাজ শেষ করবে এলজিইডি। এর আগে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ওইসব অঞ্চলের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর নির্দেশ দেন। দ্রুত সময়ে বিশুদ্ধপানি সরবরাহ, রাস্তাঘাটের উন্নয়নে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, যদি বিদ্যুত পৌঁছে দেয়া সম্ভব নাও হয় তাহলে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। পরবর্তীতে তিনি নিজেই ছুটে যান ছিটমহলের বাসিন্দাদের কাছে। সম্প্রতি সফর করেন কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার সাবেক দাসিয়ারছড়া ছিটমহল। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পের অধীনে বিলুপ্ত সিট মহলে ৬ কিলোমিটার উপজেলায় সড়ক নির্মাণ, ১৭ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক নির্মাণ, ১৬৮ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ, ৭০০ মিটার ব্রিজ কালভার্ট স্থাপন ও ১২টি গ্রোথ সেন্টার বা বাজার নির্মাণ ও দেড় কিলোমিটার বিদ্যমান খাল উন্নয়ন করা হবে। এলজিইডি থেকে পাঠানো প্রস্তাবনা নিয়ে যাচাই বাছায়ের কাজ চলছে। এই প্রকল্প অনুমোদন হলে সেখানকার বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আরাস্তু খান এ বিষয়ে বলেন, ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকায় এতদিন পর্যন্ত তাদের উন্নয়নে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। এখন ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হওয়ার পর দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হয়েছে তারা। এ জন্য মানবিক দৃষ্টিতে এই প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে নতুন নাগরিকদের জীবন মান উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। যাতে অন্য বাংলাদেশীর মতো সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পায় ছিটমহলবাসী। সেই সঙ্গে যে প্রত্যাশা নিয়ে ছিটমহলের অধিবাসীরা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তা পূরণ হতে পারে। এর অংশ হিসেবে সদ্য সাবেক হওয়া ছিটমহলবাসীর ভাগ্যের উন্নয়নে গুচ্ছ প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে পরিকল্পনা কমিশন। তবে এতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে সেটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ছিটমহলবাসীর জন্য বরাদ্দকৃত ২০০ কোটি টাকা দিয়েই প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করা হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গুচ্ছ প্রকল্পের বিষয়ে এর আগে বলেছিলেন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে খুব শীঘ্রই একটি টিম গঠন করে ছিটমহলে পাঠানো হবে। এ কমিটি ছিটমহলবাসীর প্রয়োজন নির্ধারণ করে একটি প্রতিবেদন আমাকে দেবে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী একটি গুচ্ছ প্রকল্প আকারে তৈরি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে দিকনির্দেশনা দেবেন সেভাবেই কাজ করব। সূত্র জানায়, ছিটমহলবাসীর জীবনযাত্রার মান্নোয়নে ও কর্মদক্ষতা বাড়াতে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে একটি গুচ্ছ প্রকল্প বা ক্লাস্টার প্রজেক্ট হাতে নেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। এর আওতায় ছিটমহলবাসীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী এবং বাজার ব্যবস্থার উন্নয়নসংক্রান্ত কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে। এ জন্য প্রাথমিকভাবে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এতে সচিব পদমর্যাদার এক সদস্যকে প্রধান করে পরিকল্পনা কমিশনের উর্ধতন কর্মকর্তারা ছিটমহল উন্নয়নসংক্রান্ত কমিটিতে থাকবেন। যারা ছিটমহলের সমস্যা নিরূপণ করে প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে। পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, বাংলাদেশের নাগরিকরা যেসব সুবিধা পাচ্ছে, তাঁরাও একই সুবিধা পাবে। উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কোনভাবেই ছিটমহলবাসীকে ভিন্ন চোখে দেখা হবে না। তাঁদের বাচ্চারাও স্কুলে যাবে, বছরের প্রথম দিন বই পাবে। তাঁদের উন্নয়নে সুপেয় পানি, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সেবা, সড়ক অবকাঠামো তৈরি করা হবে। এতে অর্থায়নে কোন সমস্যা হবে না। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কয়েক শ’ কোটি টাকা প্রয়োজন। তবে চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে সাবেক ছিটমহলবাসীর জন্য ২০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ টাকা দিয়ে কাজ শুরু হবে। পরবর্তীতে টাকার প্রয়োজন হলে সেটারও যোগান দেয়া হবে। পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করবে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ গুচ্ছ প্রকল্পে একজন প্রকল্প পরিচালক থাকবেন। তবে প্রকল্প বস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক ছিটমহলে আলাদা উপ প্রকল্প পরিচালক থাকবেন। এরা মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন নজরদারি করবে। সূত্র জানায়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল রয়েছে। ১৯৭৪ সালে করা স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়ায় ১১১টি ছিটমহল পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব ছিটমহলে জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। যারা সব ধরনের মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল এতদিন। চলতি বছরের মে মাসে চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় সম্ভব হবে। ফলে দুই দেশের ৫২ হাজার ছিটমহলবাসীর ৬৩ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে। বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার এবং ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। চুক্তির বাস্তবায়নের মাধ্যমে ১৭ হাজার একরের কিছু বেশি জমি বাংলাদেশ পায়। আর ভারত পায় সাত হাজার একরের সামান্য বেশি জমি।
×