ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

লোকগানের মায়াজালে জনারণ্যে পরিণত আর্মি স্টেডিয়াম

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৪ নভেম্বর ২০১৫

লোকগানের মায়াজালে জনারণ্যে পরিণত আর্মি স্টেডিয়াম

মনোয়ার হোসেন ॥ হেমন্তের সন্ধ্যা থেকেই আর্মি স্টেডিয়ামে বয়ে যায় লোকগানের সুরসুধা। লোকসঙ্গীতের মরমি বাণীতে আপ্লুত হতে থাকে সুরের অনুরাগী শ্রোতাকুল। সুরের সহযোগে মানবতা ও অধ্যাত্মবাদী দর্শনের বাণীতে প্রাণিত হতে থাকে হৃদয়। দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান লোকসঙ্গীত শিল্পীদের অন্যবদ্য সব পরিবেশনায় আলোড়িত হয় উৎসব প্রাঙ্গণ। আর সন্ধ্যা পেরিয়ে সময় যখন রাতের পানে ধাবিত হয়েছে ক্রমশই বেড়েছে সুররসিকদের আনাগোনা। ছুটির দিনে সকলেই মনটাকে রাঙিয়েছেন আট ঘণ্টার সুরের পরিভ্রমণে। লোকগানের মায়াজাল ছড়ানো বিশাল আয়োজনটি এক সময় শ্রোতার আগমনে পরিণত হয়েছে জনারণ্যে। রাত দশটার পর ঘোষণা আসে, উৎসব প্রান্তরে জড়ো হয়েছেন ৫২ হাজার শ্রোতা-দর্শক। শুক্রবার এমন দৃশ্যপটে স্নিগ্ধ রূপ পেয়েছে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টা। মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টস আয়োজিত এই লোকসঙ্গীত উৎসবের দ্বিতীয় দিন ছিল শুক্রবার। এদিনের পরিবেশনায় অংশ নেন বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের শিল্পীরা। তখন ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যা ছয়টা। চারদিকে জ¦লছে আলোর রোশনাই। আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে আসেন কুষ্টিয়ার বাউল ভজন ক্ষ্যাপা। সুফি, কাওয়ালি ও গজল গানে পারদর্শী এই শিল্পী। দরাজ কণ্ঠে প্রথমেই গেয়ে শোনান কাওয়ালিÑ‘গুরু গো এ ভব কারাকার/করিতে পারাবার/তুমি গুরু আমার পাড়ের কা-ারি’। প্রথম গানেই আসর মাত। তুমুল হাততালিতে দর্শকশ্রোতারা অভিনন্দন জানায় এ শিল্পীকে। এরপর আবারও উন্মাতাল সুরের ঢেউ। এবার তিনি পরিবেশন করেন দেড়শো বছরের প্রাচীন কোন এক লোককবির গান ‘ও মন রে কেন ডুব দিলে না পাক-দরিয়ায়’। সুর থামতেই মঞ্চে আসেন এদিনের সঙ্গীতানুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রখ্যাত নজরুলসঙ্গীত শিল্পী শাহীন সামাদ। তারপর দর্শকদের মাতাতে মঞ্চে আসেন ম্যাজিক বাউলিয়ানার নির্বাচিত পাঁচ তরুণ শিল্পী। তাঁরা হলেন আয়েশা জেবীন দিপা, বিউটি খাতুন, দিতি সরকার, মরিয়ম আখতার কণা ও মাসুমা সুলতানা সাথী। নবীন বাউল শিল্পীদের পরিবেশিত প্রথম গানের শিরোনাম ছিল ‘কি দিয়ে জুড়াই বলো সখী’। বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমকে আশ্রয় করে গাওয়া দ্বিতীয় গানের শিরোনাম ছিল ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছে/কেমন দেখা যায়/আরে ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপক্সক্ষী নাও’। হৃদয়ের আকুল কথাটি ব্যাকুল কণ্ঠের অনুরণন ছড়িয়ে গীত হয়Ñ করি মনা কাম ছাড়ে না মদনে/বলো প্রেম রসিক হবো কেমনে...। এরপর একে একে গীত হয় ‘সোনা বন্ধু আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি’, ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’। সঙ্গীতসুধার এ পর্যায়ে ছিল দ্বিতীয় রজনীর আনুষ্ঠানিকতা। এদিনের অতিথি ছিলেন এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও ভারতের রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, সব দেশেই লোকসংস্কৃতি ও শহুরে সংস্কৃতির ধারা পাশাপাশি বিরাজমান। মূলত লোকসংস্কৃতি প্রান্তিক মানুষের, অন্যদিকে শহুরে সংস্কৃতি নাগরিক শ্রেণীর। এই দুই ধারা মধ্যে রয়েছে ব্যবধান। শহুরে সংস্কৃতি কিছুটা উন্মূল হলেও লোকসংস্কৃতির মূল আমাদের মাটির গভীরে প্রোথিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম সবশ্রেণীর মানুষের কাছে নিয়ে এসেছেন। বিশ^বাসীর কাছেও তুলে ধরেছেন এ সঙ্গীতের মর্মকথা। আমরাও সেই ঐতিহ্যকে অনুসরণ করছি। পঙ্কজ শরণ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠছে ঢাকা। এর কারণ এ দেশের মানুষের আত্মায় রয়েছে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা। নতুন বাংলাদেশের পরিচয়কে তুলে ধরছে এই সংস্কৃতি। এমন একদিন আসবে বিশ^সঙ্গীতাসরে এ দেশের শিল্পীরা প্রমাণ করবে। সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে আবারও সুরের খেলা। এবার মঞ্চে আসেন তরুণ বাউল শিল্পী রুবা। প্রথমেই তিনি গাইলেন ‘বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না’ গানটি। এরপর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এ শিল্পী গেয়ে শোনান ‘শুয়া উড়িল উড়িল জীবেরও জীবন’। এরপর তার কণ্ঠে গীত হয়Ñ‘তোমরা দেখো গো আসিয়া কমলায় নৃত্য করে চমকিয়া চমকিয়া’। রুবার পরিবেশনা শেষে গান শোনান কুমিল্লার তরুণ বাউল স্বপ্নীল সজীব। তার পরিবেশিত দু’টি গানের শিরোনাম ছিল ‘দয়াল তোমারও লাগিয়া যোগিনী সাজিবো’ ও লালনের ‘মিলন হবে কতদিনে আমার মনের মানুষেরও সনে’। এরপর উচ্চারিত হলো বাংলার কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল আলীমের গান। দরদি কণ্ঠে শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করে গাইলেন মহান শিল্পীর ছেলে আজগর আলীম। গেয়ে শোনান ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে সুধাই’। এছাড়াও বাবার গান গেয়ে শোনান জহির আলীম ও নূরজাহান আলীম। দুই ভাই-বোনের গানের শিরোনাম ছিল ‘নাও বাইও না মাঝি বিষম দইরাতে’ ও ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি নাইওরিগো তোলো’ । আবদুল আলীমের গানের শ্রোতারা শুনতে পেল এদেশের লোকসঙ্গীতের আরেক কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের গান। তার গানকে সঙ্গী করে শ্রোতাদের তন্ময় করেন নাশিদ কামাল। একে একে গেয়ে শোনান ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘প্রাণ সখীরে ঐ শোন কদম্ব তলে বংশী বাজায় কে’ ও ‘সুন্দরী কমলা নাচে’। এরপর উৎসব আঙিনায় সুরের মায়ায় বিরহের বীজ বুনে দেন বারী সিদ্দিকী। কণ্ঠের সঙ্গে মধুময় বাঁশির সংযোগে শুরুতেই শোনান ‘আমি একটা জিন্দা লাশ কাটিস নারে জংলার বাঁশ/আমার লাইগা সাড়ে তিনহাত কবর খুঁড়িস না’। পুরো মাঠ গলা মেলায় শিল্পীর সঙ্গে। এরপর একে একে গেয়ে শোনান ‘ঘরে জ¦ালা বাইরে জ¦ালা’, ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি’, ‘রজনী হইসনা অবসান/আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন’। গানের মাঝে ছিল মনমাতানোর বাঁশির। ‘শুয়াচাঁন পাখি আমার’ গানটি শেষ করে পরিবেশনা। বারী সিদ্দিকীর পর মনমাতানো মঞ্চে আসেন এই প্রজন্মের জনপ্রিয় লোকজ ঘরানার ব্যান্ডদল অর্নব এ্যান্ড ফ্রেন্ডস। দলটির পরিবেশিত গানগুলো ছিল ‘মন তোরে পারলাম না বুঝাইতে’, ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’, ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’, সাঁওতালী গান ‘হিথায় তোকে মানাইছে নাগো/তুই লাল পাহাড়ের দেশে যা’। চাচা তপন চৌধুরীর সঙ্গে অর্নব গেয়ে শোনান ‘ওরে ও পাগল মন’ । সাড়ে ১১টায় মঞ্চে উঠেন এদিনের অন্যতম আকর্ষণ ভারতের জনপ্রিয় বাউলশিল্পী পবন দাস বাউল। বাউল ফিউশনের জন্য পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। বাংলাদেশে তার অগণিত ভক্ত শ্রোতা। তাদের গানে গানে মাতিয়ে রাখেন এ শিল্পী। শুরুতেই গেয়ে শোনান ‘চঞ্চল মন আমার শোনে না কথা’। তারপর একে একে গেয়ে শোনান তার রিয়েল সুগার এ্যালবামের জনপ্রিয় গানগুলো। শ্রোতাকে আলোড়িত করে পরিবেশন করেন ‘তোমার দিল কি দয়া হয় না’, ‘বসুন্ধরার বুকে বরষার ধারা’, ‘নাচো গো নাচো কালী’, ‘পাড়ার লোকের মন ভালো না’সহ একগুচ্ছ গান । মাঝরাতে মঞ্চে উঠেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজ। তিনি তার জনপ্রিয় গানগুলো পরিবেশন করে বাড়িয়ে দেন উৎসবের উচ্ছ্বাস। রাত ১টার দিকে মঞ্চে উঠে চীনের ইউনান আর্ট গ্রুপ। দলটির পরিবেশনা মুগ্ধ করে দর্শক শ্রোতাদের। সমাপনী পরিবেশনা ॥ আজ শনিবার শেষ হবে তিন দিনের এই আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব। দ্বিতীয় দিনের মতো তৃতীয় দিনেও উৎসব শুরু হবে বিকেল পাঁচটায়। আট ঘণ্টার সুরের ভ্রমণ শেষ হবে রাত ১টায়। সমাপনী আয়োজনের শুরুতেই থাকবে লুবনা মরিয়মের নৃত্যদল সাধনার মনোমুগ্ধকর লোকনৃত্যের পরিবেশনা। দ্বিতীয় পরিবেশনায় উপস্থাপিত হবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পালাগান। পরিবেশন করবেন ইসলাম উদ্দিন কিস্্সাকার। এরপর বৈচিত্র্যময় বাদ্যের সহযোগে লোকগান পরিবেশন করে ব্যান্ডদল জলের গান। তরুণ প্রজন্মের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় এ দলটি সুরে সুরে মাতিয়ে রাখবে শ্রোতা। এছাড়া এদিনের পরিবেশনায় থাকবে জনপ্রিয় বাউলশিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়ার মরমি গান। শেষ দিন অনবদ্য পরিবেশনা নিয়ে আসবেন আয়ারল্যান্ডের বাউলশিল্পী নিয়াভ নি কারা। গাইবেন ভারতের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত শিল্পী পার্বতী বাউল। ব্যান্ডদল ইন্ডিয়ান ওশানের পরিবেশনাও মুগ্ধ করবে দর্শক-শ্রোতাকে। উৎসবের শেষ প্রহরের মধ্যমণি উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী আবিদা পারভীন। গোটা উৎসবেরও অন্যতম আকর্ষণ তিনি। পাকিস্তানের এই বিখ্যাত গায়িকার পরিবেশনার মধ্য দিয়ে ভাংবে মিলন মেলা। তার আগে পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে হাজির হবে ভারতের রাজস্থানের গানের দল হামিরা ফ্রম মাঙ্গানিয়ারস। রম্য ম্যাগাজিন উদ্ভট’র যাত্রা শুরু ॥ বাংলা সাহিত্যে রম্য চর্চার জন্য যোগ হলো রম্য বিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন ‘উদ্ভট’। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুক্রবার বিকেলে এটির প্রচ্ছদ উন্মোচন ও ওয়েবসাইট (www. udvot.com) উদ্বোধন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুস সবুর খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন রেডিও নেক্সটের হেড অব প্রোগ্রাম শাহরিয়ার হাসান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদ্ভটের সম্পাদক মীযানূর রহমান নিয়ন। উদ্ভটের পক্ষে আরও বক্তব্য প্রদান করেন জাকিয়া জেসমিন জ্যোতি ও সৈয়দ মিজানুর রহমান। প্রধান অতিথির বক্তব্যে আব্দুস সবুর খান বলেন, রম্য চর্চা বাংলা সাহিত্যে বহুল প্রচলিত নয়। রম্য সাহিত্যে চর্চাও খুব সহজতর নয়। আপাদ দৃষ্টিতে মনে হয় যে রম্য লেখা মানুষকে হাসায় আনন্দ দেয়। কিন্তু একটু ভেবে পড়লে দেখা যাবে হাস্য রসাত্মকভাবে কীভাবে মানুষকে ভাবতে সহায়তা করে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শাহরিয়ার হাসান বলেন, ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে নতুন একটি ম্যাগাজিন প্রকাশের চেষ্টা সত্যিই সাহসিকতার পরিচায়ক। তবে আন্তরিকতা থাকলে কোন কিছুই ব্যর্থ হয় না; এটিও হবে না। স্বাগত বক্তব্যে উদ্ভটের সম্পাদক মীযানূর রহমান নিয়ন বলেন, সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই রম্য থাকে। আমরা এসব থেকে আলাদা করে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপনের জন্যই এ কাজে হাত দেয়া। সকলের ভালবাসা ও সহযোগিতা পেলে সৃজনশীল এ চিন্তার বিকাশ সম্ভব হবে। অনুষ্ঠানে জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়।
×