ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৪ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজে (১৩ নবেম্বরের পর) কৈশোরের শেষ প্রান্তে ১৯৪৮ সালে আমাদের বাড়িতে অনেক পরিবর্তন হয়। আমাদের বাড়িতে আব্বা নির্মাণ কাজ শুরু করেন। আমাদের ৫ কামরাবিশিষ্ট মূল বাড়িটিতে আর একটি বড় কামরা সন্নিবেশিত হয় ও অন্দরমহলের বারান্দা অনেক বিস্তৃত হয়। পাকঘর মূল ঘরের সঙ্গে প্রায় যুক্ত হয়ে যায়। আম্মা পেছনের দিকে একটি গোসলখানা স্থাপন করেন। আমরা সম্ভবত গরুর দুধ খরিদ করা থেকে বিরত হই এবং বাড়িতে গাভী পালনের জন্য আমাদের নেপালী দুধ সরবরাহকারী দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই নেপালী বছরের পর বছর আমাদের একান্ত নেপালী গো-সম্পদ সেবক হিসেবে ছিল এবং সম্ভবত তার মৃত্যুকাল পর্যন্তই সে আমার আম্মার হুকুম বরদার ছিল। এই নেপালীর আর কোন নাম আমাদের জানা ছিল না, যদিও পূরন লাল নামে সে সমাজে পরিচিত ছিল এবং মীরাবাজারে ছিল তার বাড়ি ও গোশালা। এছাড়া বাড়িটিতে একটি টিউবওয়েলও স্থাপিত হয়। এই টিউবওয়েলের পানি দিয়ে সবজি ও ফুলের বাগানের পরিচর্যা হতো এবং পৌরসভার পানি সরবরাহ ছিল খাবার ও রান্নাবান্না এবং গোসলের জন্য। আমাদের বাড়িতে আমরা দুই ভাই তখন ফুলের বাগান নিয়ে কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতাম। বহির্বারান্দার একদিকে ছিল আমার বাগান আর অন্যদিকে ছিল আমার ভাইয়ের বাগান। সে বাগানে আমরা স্বহস্তে গাছপালার সেবা করতাম, নানা ধরনের সার বিশেষ করে গোবর ব্যবহার করতাম, নিয়মিত পানি দিতাম আবার বৃষ্টিকালে পানি যাতে জমতে না পারে সেজন্য পানি চলাচলের ব্যবস্থা করতাম। এখান-সেখান থেকে চারা বা কলম এনে বাগানকে সমৃদ্ধ করতাম। লতাপাতা বা ডালপালা কেটে বাগানকে সুদৃশ্য করে রাখতাম। আমাদের বাগান নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্বন্ধে অনেকেই- গুরুজন ও বন্ধু-বান্ধব অবহিত ছিলেন এবং এ নিয়েই আমরা প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ বা জিজ্ঞাসিত হতাম। এই বাগান প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্ভবত ১৯৪৫ সালে শুরু হয় এবং ১৯৫১ সাল পর্যন্ত বজায় থাকে। যখন দ্বিতীয়বর্ষে পড়াশুনা করি তখন ১৯৫০ সালে বিখ্যাত ইংরেজী সাহিত্যিক জর্জ বানার্ড শ’ মৃত্যুবরণ করেন। আমি সে সময় বানার্ড শ’র প্রায় প্রতিটি নাটকই পড়ে নিয়েছি এবং তাকে আমার খুব ভাল লাগত। আমি কলেজ ইউনিয়নের সম্পাদককে বলি যে, বানার্ড শ’-এর ওপর আমাদের একটি শোকসভা করা উচিত। তিনি নতুন অধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ১৯ ডিসেম্বর এ বিষয়ে একটি শোকসভা আহ্বান করলেন। প্রিন্সিপাল আবদুর রব চৌধুরী সাহেব তখন অবসরে গেছেন এবং প্রখ্যাত অধ্যাপক আবু হেনা আগস্ট মাসে আমাদের প্রিন্সিপাল হয়ে কলেজে এসেছেন। শোকসভায় আমিই ছিলাম প্রধান বক্তা এবং প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে আমি জর্জ বানার্ড শ’র বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমার বক্তৃতা সম্পূর্ণ করি। আমি বক্তৃতা শেষ করার পরই অধ্যক্ষ সাহেব আমাকে ডাকলেন। আমাকে অনেক প্রশ্ন করলেন এবং খুব প্রশংসা করলেন। তিনি আমার আব্বার নাম শুনে বললেন যে, তোমার আব্বার সঙ্গে আমার এখনও দেখা হয়নি। কিন্তু তাকে দেখতে যাব বলে ইতিমধ্যেই ঠিক করেছি। তিনি আরও বললেন যে, তোমার চাচি তো আমার মেয়ের সহকর্মী। তার মেয়ে এবং আমার চাচি সিলেট সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। সেদিনই সন্ধ্যাবেলা তিনি আব্বার সঙ্গে দেখা করতে আমাদের বাড়িতে আসলেন এবং তখন থেকেই আমি তার বৃহত্তর পরিবারের সদস্য হয়ে গেলাম। আবু হেনা সাহেবের ছেলেমেয়ের সংখ্যা তখন প্রায় আমাদের সমান ছিল। আমরা ছিলাম নয় জন এবং তার সন্তান-সন্তুতিও ছিল সেইরকম। আবু হেনা সাহেব বস্তুতপক্ষে আমার ব্যক্তিগত শিক্ষকের আসন গ্রহণ করেন এবং আমাকে অত্যন্ত যতœসহকারে তিনি শিক্ষা দিতেন। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার আমাকে তার কাছে যেতে হতো। তিনি আমাকে নানা বই, প্রবন্ধ, জার্নাল ইত্যাদি পড়তে দিতেন এবং মোটামুটিভাবে পরীক্ষা করতেন যে, আমি কি ঠিকমতো পড়াশোনা করেছি। তিনি আজীবন আমার শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি সলিমুল্লাহ হলে আমাদের প্রভোস্টও ছিলেন এবং আমার বিএ, এমএ পরীক্ষায় পরীক্ষকও ছিলেন। তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এখনও আমার সম্পর্কটি বেশ ঘনিষ্ঠ। আমার মনে হয় আমি যে ইংরেজী সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা করলাম তার পেছনে আবু হেনা সাহেবের মূল্যবান ভূমিকা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়াশোনা করি তখন আবু হেনা সাহেব সরকারী চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজ পরিদর্শক নিযুক্ত হন; পরে তিনি আমাদের হলের প্রভোস্টও হন। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বেরিয়েছেন এবং আমি সাইকেলে হলে ফিরছি। তিনি আমাকে ইশারায় নামতে বললেন। তখন আমাদের বিএ সম্মান পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়ে গেছে এবং আমি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছি। তিনি চিরন্তন শিক্ষকের মতো আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘হিপোক্রেসি’ বানান করো তো? আমি থতমত খেয়ে এত সহজ প্রশ্নের জবাব দিলাম যুঢ়ড়পৎরংু। তিনি বললেন, প্রথম শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ ছাত্র, পরীক্ষার খাতায় কিন্তু ভুল লিখেছ। আমি নাকি যুঢ়ড়পৎধংু লিখেছিলাম। প্রিয় ছাত্রের জন্য এরকম খেয়াল এখন অচিন্ত্যনীয়। তিনি আমার হাতের লেখাও বুঝে নিয়েছিলেন। কারণ আমাদের পরীক্ষার খাতায় নাম তো থাকে না। এছাড়া আর এক ব্যক্তি আমার লেখাপড়ার ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন এবং তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালী মুসলমান আইসিএস কর্মকর্তা সিলেটের বিরাহিমপুরের গজনফর আলী খান। তিনি ১৮৯৭ সালে ভারতের ৪র্থ মুসলমান আইসিএএস অফিসার ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার আব্বার মক্কেল এবং সারাজীবন তিনি আমার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বিরাহিমপুরের গজনফর আলী খান সিলেটে তেমন পরিচিত ছিলেন না। সবাই জানত যে, বিরাহিমপুরের দালানটি ছিল তার বাড়ি। তিনি ছিলেন অবিবাহিত এবং তার ছিল একটি বড় গ্রন্থাগার। তার দেখাশোনা করতেন তার অবিবাহিত ভাই ঝি মিস জিল খান। আরও জানা ছিল যে, শহরের কালিঘাটে আজমল আলী চৌধুরীর দালানটিও নির্মাণ করেন গজনফর আলি খানের বড় ভাই ডাঃ আসদ্দর আলী খান তার কন্যার বিবাহকালীন যৌতুক হিসেবে। আসদ্দর আলী খান ১৮৭৮ সালে কলকাতা ক্যাম্বেল মেডিক্যাল কলেজ থেকে এলএমএফ পাস করে বাংলা প্রেসিডেন্সিতে ডাক্তারী সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি বিহারে সার্জন জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তার প্রায় বিশ বছরের ছোট ভাই গজনফর আলী খানকে (১৮৭২-১৯৫৯) এন্ট্রান্স পাস করার পর তিনি বিলেতে পাঠিয়ে দেন এবং সেখান থেকে আইসিএস পরীক্ষা দিয়ে তিনি ১৮৯৭ সালে হন প্রথম বাঙালী এবং চতুর্থ ভারতীয় মুসলিম আইসিএস কর্মকর্তা। তিনি উত্তর প্রদেশে গোরখপুরের বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে ১৯৩২ সালে অবসরান্তে সিলেটে বিরাহিমপুরে বসবাস শুরু করেন। তিনি চিরকুমার ছিলেন এবং নানা বিষয়ে প-িত ছিলেন। ডাঃ আসদ্দর আলি খানের নাতি ছিলেন এ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান, বাংলাদেশের নৌবাহিনী প্রধান এবং জেনারেল এরশাদের ডেপুটি সামরিক প্রশাসকের একজন ছিলেন। তিনি জাতীয় গুরু দায়িত্ব পালনকালেই মধ্যবয়সে ইন্তেকাল করেন। আসদ্দর আলী খান তার জ্যেষ্ঠ মেয়েকে সিলেটে বিয়ে দেবেন বলে একজন শিক্ষিত জামাইয়ের খোঁজ নিতে থাকেন। অবশেষে তিনি উকিল আমজদ আলী খানের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দেন এবং যৌতুক হিসেবে কালিঘাটের দালান ও ৫০ একর জমি প্রদান করেন। আমজদ আলী খান সিলেটে বহুদিন পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন এবং তিরিশের দশকে আদালতেই হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করেন। তার ছেলে আজমল আলী চৌধুরী ছিলেন রাজনীতিবিদ ও এক সময় পাকিস্তানের মন্ত্রী। অন্য ছেলে ছিলেন ওয়ারেস আলী চৌধুরী, যিনি আসাম সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সচিব হিসেবে অবসর নেন। তার জ্যেষ্ঠ মেয়ে খায়রুননেসা খানম ছিলেন সিলেটের মুসলিম মহিলা গ্র্যাজুয়েটদের একজন এবং পূর্ব বাংলায় স্কুল ইন্সপেট্রেস। তিনি করাচিস্থ বাংলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি আম্বরখানার আলী আশরাফের স্ত্রী ছিলেন। আলী আশরাফ সম্পর্কে আমার চাচা এবং আসামে হাকিম ছিলেন ও পাকিস্তানে বেসরকারী বিমান পরিবহন বিভাগের ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে অবসরে যান। তার মা ছিলেন আমার দাদির বোন এবং পিতা ছিলেন পুলিশের ডেপুটি সুপার মোহাম্মদ নাদের। তিনি যৌবনে খুব সৌখিন ব্যক্তি ছিলেন। তার ছিলেন চার বোন এবং তিনি ছিলেন একমাত্র ভাই। তিনি আলিগড়ে পড়াশোনা করেন এবং ছাত্রাবস্থায় বিমান চালনায় প্রশিক্ষণ নিয়ে সফল হন। তিনি সিলেটে প্রথম মোটরসাইকেল আমদানি করে সশব্দে চলাফেরা করতেন। গজনফর আলী. খান আমার আব্বার মক্কেল ছিলেন এবং আমাকে খুব ¯েœহ করতেন। আমি আইএ পরীক্ষায় ভাল করলে তিনি আমাকে মিষ্টিমুখ করার জন্য ৫০ টাকা দেন। আসদ্দর আলীর উত্তরাধিকারীরা ঢাকায় বসবাস করেন। বিরাহিমপুরে বর্তমানে তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা বসবাস করেন। চলবে...
×