ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাফল্যের চূড়ায় বাংলাদেশ ॥ ২০১৫

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৪ নভেম্বর ২০১৫

সাফল্যের চূড়ায় বাংলাদেশ ॥ ২০১৫

মিথুন আশরাফ ॥ সেই ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ থেকে উনত্রিশ বছর সাত মাস ধরে ওয়ানডে ক্রিকেট খেলছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে এসে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ সাফল্যই মিলেছে বাংলাদেশের। এ বছর ১৮ ম্যাচের ১৩টিতেই জিতেছে। তাও আবার ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে হারিয়েছে। পাকিস্তানকে ১৯৯৯ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো হারিয়েছে। প্রথমবারের মতো সিরিজে হারানোর সঙ্গে পাকিদের হোয়াইটওয়াশও করে দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকেও প্রথমবারের মতো সিরিজে হারিয়েছে। আর বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে। এ বছর একটি সিরিজেও হারেনি মাশরাফিবাহিনী। এমনকি দেশের মাটিতে ১২ ম্যাচ খেলে মাত্র ২টি ম্যাচ হেরেছে! বিশ্বকাপ দিয়েই এ বছর শুরু করে বাংলাদেশ। বছরের প্রথম ম্যাচেই জয় তুলে নেয়। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে হওয়া বিশ্বকাপে আফগানিস্তানকে ১০৫ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েই বছর শুরু করে। এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। শ্রীলঙ্কার কাছে পরের ম্যাচটিতেই ৯২ রানে হারে। পরের ম্যাচেই আবার জয় পায় বাংলাদেশ। স্কটল্যান্ডকে ৬ উইকেটে হারিয়ে দেয়। এমন অবস্থা ছিল, যে করেই হোক বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে হলে ইংল্যান্ডকে হারাতেই হবে। এমন ম্যাচে ইংলিশদের হারিয়ে দিয়ে শেষ আটে খেলা নিশ্চিত করে নেয় টাইগাররা। এরপর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩ উইকেটে হারলেও লড়াই করে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলটি খুবই প্রশংসিত হয়। কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে ১০৯ রানে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু এ ম্যাচটি কতটা বিতর্কিত ছিল, তা সবারই জানা। বিশ্বকাপ শেষ হতেই দেশের মাটিতে টানা ম্যাচ খেলতে থাকে বাংলাদেশ। একটি করে দল আসে খেলতে, আর হারতে থাকে। বাংলাদেশ শুধুই জয়ের ধারা অব্যাহত রাখে। বিশ্বকাপের পর পাকিস্তান আসে খেলতে। প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে ৭৯ রানে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলা হলেই হারে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা হলেই হতাশা ঘিরে ধরে। এবার তা থেকে বের হয় বাংলাদেশ। ১৬ বছর পর পাকিস্তানকে হারায় বাংলাদেশ। শুধু এক ম্যাচ হারালেই কথা ছিল, দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও ৭ উইকেটে জিতে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো টেস্ট খেলুড়ে পূর্ণশক্তির কোন দলকে সিরিজে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। এমনকি তৃতীয় ওয়ানডেতে ৮ উইকেটে জিতে পাকিস্তানকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে হোয়াইটওয়াশ করার গৌরবও অর্জন করে। পাকিস্তান গো-হারা হেরে যাওয়ার পর ভারত আসে খেলতে। বাংলাদেশকে পাত্তাই দেয় না ভারত। শুরুতে শক্তিশালী দল পাঠাতেই চায়নি। শেষে পাঠায়। তাতেও লাভ হয়নি। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে হারের প্রতিশোধও শুধু বাংলাদেশ নেয় না, সিরিজেই হারিয়ে দেয়। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচেই জিতে যায় বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে যেমন প্রথম ওয়ানডেতে ৭৯ রানে হারায়, ঠিক একই ব্যবধানে ভারতকেও হারিয়ে দেয়। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৬ উইকেটে জিতে সিরিজ জয় করে নেয়। ভারতের বিপক্ষেও প্রথমবার সিরিজ জিতে। তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে গিয়ে ৭৭ রানে হেরে যায় বাংলাদেশ। ভারতকে হোয়াইটওয়াশের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও পারা যায়নি। এরপর বাংলাদেশে খেলতে আসে দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশ যে ওয়ানডেতে চমক দেখাচ্ছে তাতে ভয় ছিল প্রোটিয়াদের। কিন্তু পরপর দুই টি২০তে জিতে এমন এক ভাব তৈরি হয়েছিল, যেন ওয়ানডেতে অনায়াসেই জিতে যাবে। এবি ডি ভিলিয়ার্সতো টি২০ খেলার পর ওয়ানডেতে খেললেনই না। প্রথম ওয়ানডেতেও ৮ উইকেটে জিতল দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু এরপর প্রোটিয়ারা বুঝল বাংলাদেশ এখন আর ফেলনা দল নয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়ানডেতে জিতে গেল বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৭ উইকেটে ও তৃতীয় ওয়ানডেতে ৯ উইকেটে জিতে সিরিজই জিতে গেল বাংলাদেশ। এ বছর টানা তিন সিরিজ জিতে নিল। সিরিজ জয় দিয়েই বাংলাদেশের বছর শেষ হলো। তখনও কেউই জানত না জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলা হবে। অস্ট্রেলিয়ার দুই টেস্ট খেলতে আসার কথা ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে সফর স্থগিত করে দিল অসিরা। অনেকদিন বিরতি পরে গেল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সূচীতে। জিম্বাবুইয়েকে সিরিজ খেলতে আনার চেষ্টা করল বিসিবি। জানুয়ারিতে তিন ওয়ানডে, দুই টেস্ট, দুটি টি২০ ম্যাচের সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল জিম্বাবুইয়ের। বিসিবি প্রস্তাব দিল নবেম্বরে নির্ধারিত ওভারের সিরিজটি খেলতে। তাতে জিম্বাবুইয়ে রাজি হয়ে গেল। বাংলাদেশও আরেকটি ওয়ানডে সিরিজ খেলার সুযোগ পেয়ে গেল। যেটি হয়ে গেল বছরের শেষ সিরিজ। এ সিরিজে জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে দিল বাংলাদেশ। প্রথম ওয়ানডেতে ১৪৫ রানে, দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৫৮ রানে ও তৃতীয় ওয়ানডেতে ৬১ রানে জিতে জিম্বাবুইয়েকে ধবলধোলাই করল বাংলাদেশ। বছরটি আরও সাফল্যের রঙে রঙিন হয়ে গেল। জয় সংখ্যা আরও বেড়ে গেল। ওয়ানডেতে সেরা একটি বছরই অতিক্রম করল বাংলাদেশ। হার-জিতের হিসেবে অবশ্য ২০০৯ সালটিকেই সেরা ধরা হয়। এ বছর ১৯ ম্যাচে ১৪ জয় পায় বাংলাদেশ। হার-জিতের হিসেবে এক ম্যাচ বেশি খেলায় ২.৮০০ ভাগ সাফল্য। আর ২০১৫ সালে সাফল্য ২.৬০০। তবে ২০০৯ সালে পূর্ণশক্তির দলগুলোর মধ্যে শুধু শ্রীলঙ্কাকেই হারিয়েছিল বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। তবে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটি পূর্ণশক্তির দল ছিল। আর সব জয়ই আসে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে। ২০১৫ সালে যেহেতু ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে হারানোর গৌরব যুক্ত হয়েছে, তাই এ বছরটিকেই সেরা ধরা হচ্ছে। অন্য কোন বছরেই এত সাফল্য মিলেনি বাংলাদেশের। ২০০৬ সালে সর্বোচ্চ ২৮ ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। জয়ও ধরা দেয় ১৮টি। কিন্তু সঙ্গে হার ১০টি আছে। এরপর ২০১০ সালে ২৭ ম্যাচ খেলে ৯ জয়ের বিপরীতে হার ১৮। বাংলাদেশ ইতিহাসে সবচেয়ে করুণ বছর ধরা হয় ২০০৩ সালকে। এ বছর ২১ ম্যাচ খেলে একটিতেও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। বছরে খেলা আর হার-জিতের হিসেবে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কোন জয় নেই বাংলাদেশের। ১৯৮৬ সালে ২ ম্যাচ, ১৯৮৮ সালে ৩ ম্যাচ, ১৯৯০ সালে ৪ ম্যাচ, ১৯৯৫ সালে ৩ ম্যাচ, ১৯৯৭ সালে ৭ ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। জয়হীন থাকে। ১৯৯৮ সালে গিয়ে প্রথমবারের মতো জয়ের মুখ দেখে বাংলাদেশ। ৬ ম্যাচ খেলে ১টিতে জয় পায়। সেই জয়টি আসে তখনকার বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দল কেনিয়ার বিপক্ষে। ১৯৯৯ সালে গিয়ে ১২ ম্যাচ খেলে ২টিতে জয় মিলে বাংলাদেশের। এরমধ্যে বিশ্বকাপেই দুটি জয় আসে। প্রথমবারের মতো কোন টেস্ট খেলুড়ে দলকে হারায় বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে হারিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে স্কটল্যান্ডকেও হারায় বাংলাদেশ। এরপর টানা চার বছর কোন জয় নেই। ২০০০ সালে ৪, ২০০১ সালে ৬, ২০০২ সালে ১৪ ও ২০০৩ সালে ২১টি ম্যাচ খেলে একটিতেও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ২০০৪ সালে আবার জয়ের দেখা পায়। সেই থেকে আর জয়হীন বছর কাটাতে হয়নি বাংলাদেশকে। এবার (২০০৪ সালে) ১৯ ম্যাচে ৩টিতে, ২০০৫ সালে ১৪ ম্যাচে ৪টিতে, ২০০৬ সালে ২৮ ম্যাচে ১৮টিতে, ২০০৭ সালে ২৩ ম্যাচে ৮টিতে, ২০০৮ সালে ২৬ ম্যাচে ৫টিতে, ২০০৯ সালে ১৯ ম্যাচে ১৪টিতে, ২০১০ সালে ২৭ ম্যাচে ৯টিতে, ২০১১ সালে ২০ ম্যাচে ৬টিতে, ২০১২ ও ২০১৩ সালে ৯ ম্যাচে ৫টিতে ও ২০১৪ সালে ১৮ ম্যাচে ৫টিতে জয় পায় বাংলাদেশ। এর মধ্যে পাঁচটি জয়ই আসে বছরের শেষে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে। দলটিকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। ৫-০ ব্যবধানে হারিয়ে দেয়। এ সিরিজ থেকে বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের নেতৃত্ব পান মাশরাফি বিন মর্তুজা। তার হাত ধরে দলের সাফল্যও এসে পড়ে। এরপর থেকে শুধু জয়ই ধরা দেয়। ২০১৫ সালে এসে শুধু জয়ই মিলে। সাফল্যই মিলে। এ বছর ওয়ানডেতে সাফল্যের চূড়ায় ওঠে বাংলাদেশ। ১৯৮৬ সাল থেকে ওয়ানডে খেলা শুরু করে যে কোন বছরের চেয়ে এ বছর সেরা সাফল্য পায় বাংলাদেশ।
×