ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজ নবান্ন

ফসলকেন্দ্রিক প্রধান উৎসব শুরু- নতুন চালে হবে পিঠে পুলি

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৫ নভেম্বর ২০১৫

ফসলকেন্দ্রিক প্রধান উৎসব শুরু- নতুন চালে হবে  পিঠে পুলি

মোরসালিন মিজান প্রথম ফসল গেছে ঘরে,/ হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে/শুধু শিশিরের জল;/অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে...। বছর ঘুরে আবারও এসেছে অঘ্রাণ। প্রিয় ঋতুর প্রথম দিন আজ ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২২ বঙ্গাব্দ। আজ রবিবার থেকে আনুষ্ঠানিক শুরু হবে নবান্ন উৎসবের। নতুন চালে হবে পিঠে পুলির আয়োজন। এতিহ্যবাহী আচার উৎসবে মুখরিত হবে গ্রামীণ জনপদ। পাশাপাশি শহরেও থাকবে নবান্ন উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। অসাম্প্রদায়িক উৎসবে যোগ দেবে বাঙালী। নিজের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হবে নতুন প্রজন্ম। সব মিলিয়ে বড় ভাললাগার অগ্রহায়ণ। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দের ভাষায়, ‘আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসিÑবিকালের এই রং-রঙের শূন্যতা/রোদের নরম রোমÑঢালু মাঠÑবিবর্ণ বাদামি পাখিÑহলুদ বিচালিÑ/পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসেÑকুড়ুনির মুখে নাই কোন কথা,/ধানের সোনার সাজ ফুরায়েছেÑজীবনেরে জেনেছে সেÑকুয়াশায় খালি...।’ অগ্রহায়ণের বন্দনা করে আরও অনেক গান কবিতা হয়েছে। এসব গান কবিতার বড় অংশ জুড়ে আছে নবান্ন। গোটা মাস ধরেই উৎসবটি চলবে। অনেকেরই জানা, ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নতুন আমন ধান থেকে পাওয়া চালে যে রান্না, সে উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবটি নবান্ন নামে পরিচিতি পায়। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। ইতিহাস বলে, ফসলকেন্দ্রিক সবচেয়ে প্রাচীন এবং বড় উৎসব এটি। হাজার হাজার বছর আগে নারীদের হাতে কৃষি সভ্যতার শুরু। কৃষি প্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। তখন থেকেই ঘরে ফসল তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। প্রতিবারের মতো এবারও অগ্রহায়ণের শুরুতে সোনার ফসলে ভরে উঠেছে কৃষকের জমি। হেমন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে খেলা করছে পাকা ধানের শীষ। আপন মনে হেলছে। দুলছে। দেখে মন ভরে যায়। সোনালী ফসলের দিকে তাকিয়ে নতুন নতুন স্বপ্ন বুনছেন কৃষক। ধান কাটার কাজও শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন অঞ্চলে। লোককবির ভাষায়Ñ আইলো অঘ্রাণ খুশীতে নাচে প্রাণ/ চাষি কাঁচিতে দিলো শান/কাঁচি হাতে কচ কচা কচ কাটে চাষি পাকা ধান...। নতুন এই ধান ঘরে তোলার পর আয়োজন করা হবে নবান্ন উৎসবের। বিভিন্ন অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হয়। বাকি অংশ চাল করে সে চালে পায়েশ রান্না করা হয়। আজ নবান্ন উৎসবের দিনে বাংলার কৃষকের ঘরে হরেক পদের রান্না হবে। এক সময় কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের তরকারি করা হতো, তার কিছু হলেও দেখা যাবে আজ। তালিকায় থাকবে সব ধরনের শাক। ভর্তা ভাজি। আর পিঠাপুলি পায়েসের কথা তো বলাই বাহুল্য। আজ এর শ্রেষ্ঠ সময়। ঘরে ঘরে পিঠাপুলি পায়েস হবে। ধুম পড়বে নেমন্তন্ন খাওয়া ও খাওয়ানোর। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতাও যোগ করা হয়। হিন্দুরা নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। পার্বণ বিধি অনুযায়ী হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। শাস্ত্রমতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। কে চায় ওমন পাপ করতে! অমুসলিম রীতিতে, নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে। আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন। নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলী’। অতীতে পৌষ সংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল। কাকবলির আগে আরও তিনটি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার নিয়ম রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑ লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ ও বীরবাশ। বীরবাশের প্রথা মূলত বরিশাল অঞ্চলের। এর নিয়ম অনুযায়ী, বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়। তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। এর পর গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোঁতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে বাঁধা হয় ধানের ছড়া। নবান্ন উৎসবে কাকবলি, লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ হয়ে গেলে সবাই একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেন। এর আগে কেউ কিছু মুখে নেন না। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। শহুরে মানসিকতার কাছে মার খাচ্ছে গ্রামীণ মূলবোধ। হয়ত তাই নবান্নের অনেক আচার অনুষ্ঠান এখন আর দেখা যায় না। কিংবা যেটুকু দেখা যায় সেখানে ঐতিহ্যের অনেক উপাদান থাকে অনুপস্থিত। এ অবস্থায় শহুরে শিক্ষিতজনেরা নিজস্ব কৃষ্টি রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছেন। এখন রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে উদ্যাপন করা হয় নববর্ষ উৎসব। প্রতিবারের মতো আজও ঢাকার চারুকলার বকুলতলায় আয়োজন করা হবে নবান্ন উৎসবের। আয়োজক জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্যাপন পর্ষদ। আনুষ্ঠানিকতার শুরু হবে সকাল ৭টা ১ মিনিটে। উৎসব উদ্বোধন করবেন শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সকাল ৯টায় নবান্ন শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শেষ হবে প্রথম পর্বের আয়োজন। দ্বিতীয় পর্বের উদ্যাপন চলবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। দিনব্যাপী উৎসবে থাকবে সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তিসহ নানা পরিবেশনা। বর্ণাঢ্য আয়োজনে আবহমান বাংলার ছবি তুলে ধরা হবে। মুড়ি-মুড়কি, পিঠাপুলি ছাড়া নবান্ন হয় না। ঐতিহ্যবাহী এসব খাবারের ব্যবস্থা করবেন আয়োজকরা। প্রায় একই সময় আরও কিছু উৎসব অনুষ্ঠান থাকবে রাজধানী শহরে। শেকড় সন্ধানী মানুষের অংশগ্রহণে নতুন প্রাণ পাবে অসাম্প্রদায়িক বাঙালী সংস্কৃতি।
×