ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

দীপনরা কেন খুন হয় কেন খুন হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৫ নভেম্বর ২০১৫

দীপনরা কেন খুন হয় কেন খুন হবে

(১৪ নবেম্বরের পর) ॥ চার ॥ এবার আমি ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রসঙ্গে আসি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এদের মূল কাজ হজের ব্যবস্থা করা। তাই যদি হয় তা’হলে মন্ত্রণালয় না রেখে হজ ব্যবস্থাপনা আউটসোর্সিং করলেই হয়। জঙ্গী মতবাদ প্রতিরোধে ধর্ম মন্ত্রণালয় জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারত। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কাজ হতে পারত সব ধর্মের প্রতি সমান দৃষ্টি ও সহায়তা, ওয়াজ মাহফিল [জিহাদের ডাক দিলে] ও জঙ্গীবাদের বয়ানকারী ইমামদের চিহ্নিত করা, যে কোন ধরনের ধর্মীয় উগ্রতার বিরুদ্ধে ফুট সোলজার বা পদাতিক হিসেবে কাজ করা। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কিছু উদ্যোগ নিয়েছে; কিন্তু তার ফলাফল কী সেটি পত্রিকার রিপোর্টই বলে দিচ্ছেÑ “জঙ্গী প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের জন্য মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতনতার কাজে উদ্বুদ্ধ করার কথা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ ও ভাতা গ্রহণ করলেও বেশির ভাগ ইমাম জঙ্গীবাদ বিষয়ে সচেতনতামূলক বয়ান (বক্তব্য) করছেন না। কিছু এলাকায় ইমামদের বিরুদ্ধে উগ্রবাদী বক্তব্য দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। ইমামদের এই প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। কিছু সচেতনতামূলক বইও বিতরণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে প্রশিক্ষিত ইমামরা কী বয়ান দিচ্ছেন তা দেখছে না কেউ। সচেতনতামূলক কার্যক্রম বন্ধ : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারা দেশে প্রায় দুই লাখ ৬০ হাজার মসজিদ থাকলেও প্রশিক্ষণ দেয়া গেছে প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার ইমামকে। বয়ানসহ জঙ্গীবাদ বিষয়ে সচেতনতা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব স্থানীয় থানা পুলিশ ও উপজেলা-জেলা প্রশাসনের। জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গঠিত জাতীয় কমিটি স্থানীয় পর্যায়েও কমিটি গঠন করে দিয়েছে। তবে কমিটি গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাদের কার্যক্রম। ধর্মপ্রাণ মুুসল্লিরা বলছে, ইমামদের সবাই নিরপেক্ষ ধর্মীয় নেতা বলেই জানে। তাই ইমামদের ভুল উসকানিমূলক বক্তব্যে জঙ্গীবাদী মনোভাব বাড়ছে। অনেকেই বিপথগামী হচ্ছে, কথিত জিহাদের নামে যোগ দিচ্ছে নিষিদ্ধ সংগঠনে। দেশে জঙ্গীবাদ নির্মূল করতে হলে সচেতন ধর্মীয় নেতা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মসজিদগুলোতে পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো জরুরী বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ও জাতীয় কমিটির সদস্য শামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেন, ‘আমরা ইমামদের ট্রেনিং দিয়ে দিচ্ছি। তবে দেশের দুই লাখ ৬০ হাজার মসজিদে কারা কী বয়ান করছেন, তা দেখা সম্ভব হয় না। আলেমদের শিক্ষায় অনেক ঘাটতি আছে। অনেকেই কুরআন হাদিসের আলোকে কথা বলেন না। এসব কথিত আলেম দুই যুগ ধরে দেশের জনগণকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। মাদ্রাসা শিক্ষার নামে কোমলমতি শিশুদের শিবিরের সদস্য আর জঙ্গী বানানোর চেষ্টা চলছিল। আমরা এগুলো শনাক্ত করেছি।’ শামীম মোহাম্মদ আফজাল আরও বলেন, ‘আমরা জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে পারি। তবে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য প্রশাসন।’ পুলিশ ও র‌্যাবের এক হিসাবে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে হিযবুত তাহ্রীর, জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হুজিসহ অন্য সংগঠনগুলোর আটককৃতদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই ছিল ছাত্র। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘মগজ ধোলাই করে সফল হচ্ছে জঙ্গীরা। এখন মেধাবী ছাত্রদের টার্গেট করছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্ররা ধর্মীয় আবেগে সহজেই জঙ্গীদের টোপ গিলছে। তারা মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত হলেও ইসলামের ইতিহাস ও মর্ম সম্পর্কে সচেতন নয়। তারা নিজেদের এই কাজে নিয়োজিত করে সফল মনে করছে। এ ধরনের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং বিশেষায়িত পুলিশ (কাউন্টার টেররিজম) গঠন করতে হবে।’ জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার কমিটির স্থানীয় পর্যায়ের কমিটিগুলো চলছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতার কাজ পর্যবেক্ষণ করে ওই কমিটির প্রতি মাসে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠানোর কথা। তবে প্রশিক্ষণ ছাড়া।...” [কালের কণ্ঠ, ৮.১১.২০১৫] এর আগে মসজিদের বয়ানের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এবং তা যে সত্য তার প্রমাণ পত্রিকার এই প্রতিবেদনÑ “রাজধানীর কিছু মসজিদ এবং দেশের কয়েকটি জেলার মসজিদের মুসল্লি, ইমাম ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ মসজিদে সচেতনতার বয়ান হচ্ছে না। রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়ার বেলাল মসজিদে জুমার নামাজ পড়েন স্থানীয় বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘উগ্রবাদ নিয়ে ইমাম সাহেব সরাসরি কোন কথা বলেন না। উল্টো তাঁর সব বয়ানেই ‘ইসলামের জন্য জিহাদ করতে হবে, ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখতে হবে’,-এমন কথা থাকে!” ওই মসজিদের ইমাম আলহাজ আজিজুল হক বলেন, ‘জিহাদের ব্যাপারে উৎসাহ জোগানোর মতো বক্তব্য দিই না। জঙ্গীবাদ স্পর্শকাতর বিষয় বলে বয়ানে আনতে সাহস পাই না আমি।’ ইমাম হিসেবে কোন প্রশিক্ষণ পাননি বলেও জানান আজিজুল হক। জানতে চাইলে তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘জঙ্গীবাদ বিষয়ে আমাদের নজরদারি আছে সবখানেই। তবে প্রশিক্ষিত ইমামরা কী বলছেন, সেটা তদারকির দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয়নি।’ চাঁদপুর জেলার বেশির ভাগ মসজিদেই জঙ্গী বিষয়ক সচেতনতামূলক বয়ান হয় না। তবে নজরদারি আছে বলে দাবি পুলিশের। জেলা পুলিশ সুপার আমীর জাফর বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর থেকে নির্দেশনা আছে, ইসলাম ধর্ম ব্যবহার করে কেউ যেন জঙ্গীবাদে উৎসাহ না দিতে পারে। এ বিষয়ে আমরা নজরদারি করি।’ ভোলা জেলার বেশ কিছু মসজিদ ঘুরে জুমার বয়ানে ইসলামের পক্ষে জিহাদের পক্ষে কথা বলতে শোনা গেছে। তবে ইমামদের সচেতনতামূলক বয়ান করতে দেখা যায়নি। বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা মিয়াবাড়ী জামে মসজিদের মুসল্লি সিরাজ তালুকদার বলেন, ‘কখনই জঙ্গী নিয়ে ইমাম সাহেবকে কিছু বলতে শুনিনি।’ ওই মসজিদের ইমাম এম এ বারী বলেন, ‘আমি কোন প্রশিক্ষণ পাইনি। কেউ আমাকে কখনও বলেনি যে বয়ানে এসব সচেতনতার কথা বলতে হবে।’ বোরহানউদ্দিন থানার ওসি রতন কৃষ্ণ রায় চৌধুরী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার জানা নেই। আমাকে আগে জানতে হবে।” [কালের কণ্ঠ, ঐ] ইসলামিক ফাউন্ডেশন কাজ কিছু করছে এবং দেখা যাচ্ছে সমন্বয়ের অভাবে তার কোন ফল নেই। আবার এই ফাউন্ডেশন একই সঙ্গে পাকিস্তানী লেখকের কাদিয়ানীবিরোধী বই তর্জমা করে প্রকাশ করেছে। পূর্বে যে তাত্ত্বিক কাঠামো দিয়েছিলাম তার সঙ্গে এটি মেলে কিনা দেখুন। ॥ পাঁচ ॥ মানস জগতে আধিপত্য বিস্তারে প্রাথমিক ভূমিকা রাখে শিক্ষা সংস্কৃতি। আমাদের শিক্ষার সাফল্য ধরা হয় শিশুদের হাতে নববর্ষে বই তুলে দেয়া ও জি-৫ সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখা। কিন্তু তা কি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ? প্রয়োজন ছিল একমুখী শিক্ষা চালু করা। কবির চৌধুরী কমিশনের নীতিমালা পুরোপুরি কার্যকর করা হয়নি হেজাবিরা নর্তন-কুর্দন করবে বলে। আমরা চেষ্টা করেও শিক্ষামন্ত্রীকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে, জাতীয় ইতিহাস বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আবশ্যিক করার। কিন্তু তার বিশেষ আগ্রহ মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারে। ২০১৪ সালের মাদ্রাসা খাতের একটি হিসাব দিই। যেসব প্রতিষ্ঠানে ‘ইসলামী শিক্ষা’ দেয়া হয় তার মধ্যে আছে মক্তব, হেফজখানা ও এতিমখানা, খানকাহ [ প্রায় ১০ হাজার], স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কওমী, আলীয়া এবং তাখাসসুস বা উচ্চতর আরবী শিক্ষা। সব মিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৭ লাখ ২৫ হাজার ২১১ জন। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিয়েছে ২,৫০,৫০,৭০,০০০ টাকা। এর মধ্যে আলীয়া বা সরকারী মাদ্রাসাসমূহে বরাদ্দ [হাজার টাকার] ৬৪৬৭০ টাকা। বেসরকারী মাদ্রাসাসমূহে ২০৫১৯০০৭, বেসরকারী মাদ্রাসাসমূহে (ভোকেশনাল ও বিজনেস ম্যানেজমেন্ট) ২৭১৮১, এবতেদায়ী মাদ্রাসাসমূহে ১৪৪১০৯ এবং বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ৩৩৬৪২, মোট ২,০৭,৮৮,৬৯৯ টাকা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী এরা মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানেই পড়ুক, ভালভাবে আরবী লিখতে বা বুঝতে পারে না। সেখানে যা পড়ানো হয় তার কয়েকটি উদাহরণ দিইÑ ১. ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কোন কল্যাণমূলক মতবাদ পৃথিবীতে নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতার নামান্তর। ধর্মকে ধ্বংস করার কৌশল হিসেবে রচিত একটি অপতন্ত্র। কেননা, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা হলো, কোন ধর্মই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন ধর্মকেই মডেল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। প্রত্যেক ধর্ম থেকে কিছু কিছু মূলনীতি গ্রহণ করে বাকি মূলনীতিগুলো মানব রচিত মতবাদ থেকে গ্রহণ করত রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। এটি ইসলামী ধর্মবিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’ [ইসলামী পৌরনীতি, আল-বারাকা লাইব্রেরি, পৃ. ৩৮৭] প্রধানমন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ফিরিয়ে এনেছেন। এখন সরকারের টাকায় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা কুফরি। এ বিষয়ে রিপোর্ট দিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। কিন্তু, শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করে মাদ্রাসায় এগুলো পড়ানো যেতে পারে, অন্যখানে না হলেও। তা’হলে সাবোটাজটা করা হচ্ছে কোত্থেকে! ২. ‘সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (র)-এর মতে, মুসলমানদের হৃদয় ও মনের এক প্রান্ত দিয়ে যখন জাতীয়তাবাদের চেতনা অনুপ্রবেশ করে, তখন অন্য প্রান্ত দিয়ে ইসলাম নিষ্ক্রান্ত হয়। যে মুসলিম নিজেকে জাতীয়তাবাদের ধারক বলে জাহির করেন, তিনি ইসলামের আলোকবর্তিকা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ইসলামের বিশ্বজনীন আদর্শের বিপরীতে জাতীয়তাবাদ মানুষে মানুষে বিভক্তি আনে। জাতিতে জাতিতে হিংসা, বিদ্বেষ, লড়াই ও সংঘাত জাতীয়তাবাদেরই পরিণাম।’ [ আলিম ইসলামী পৌরনীতি, ঐ, [৭০]। আমাদের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ একটি মূলনীতি। সরকারী টাকায় শেখানো হচ্ছে তা ইসলামবিরোধী। এটি হচ্ছে সরকারী বা আলিয়া মাদ্রাসার কথা। অনিয়ন্ত্রিত কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৪ হাজার। তাতে পড়ছে ১৪ লাখ। ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী কওমি মাদ্রাসার মধ্যে পুরুষদের জন্য আছে ১২৫৯৩, মহিলাদের ১২০৯টি। আগে মহিলা মাদ্রাসা ছিল না। ছাত্রীর সংখ্যা এখন ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৬ জন। শিক্ষক পুরুষ ৬৬৯০২ ও মহিলা ৬৮২৬। সবচেয়ে বেশি মাদ্রাসা পূর্বাঞ্চলে, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে [৪৫৪৯+২৯৮০+২৪৬]। চলবে...
×