ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তফা জব্বার

রাজন-রাকিব হত্যার বিচারই ন্যায়ের মানদ- হোক

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৫ নভেম্বর ২০১৫

রাজন-রাকিব হত্যার বিচারই ন্যায়ের মানদ- হোক

ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছেন সিলেটের শিশু রাজন হত্যার রায় এবং ৪ ঘাতককে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। একইভাবে খুলনার চাঞ্চল্যকর রাকিব হত্যার দায়ে দুইজনকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। রায় দুটি একই দিনে দেয়া হয়েছে। কেবল শিশুহত্যার বিচার বলেই নয়, নানা কারণে রাজন-রাকিব হত্যা, তার তদন্ত ও বিচার এবং এর সামগ্রিক প্রেক্ষিত আমাদের সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুটি শিশু হত্যার পাশাপাশি আমাদের সম্ভবত আরও কিছু বিষয় ভাবতে হচ্ছে। রাজন হত্যার বিচার সম্পর্কে ইন্টারনেটে প্রাপ্ত খবরটি হচ্ছে এরকম : “আলোচিত শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলায় মূল আসামি কামরুলসহ ৪ আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেছেন আদালত। এছাড়া একজনকে যাবজ্জীবন, তিনজনকে সাত বছরের কারাদ- ও ২ জনকে এক বছরের কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। খালাস দেয়া হয়েছে তিনজনকে। মামলার ১৩ আসামির মধ্যে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত চার আসামি হলেনÑ মহানগরীর জালালাবাদ থানার কুমারগাঁও এলাকার শেখপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল মালেকের ছেলে কামরুল ইসলাম (২৪), চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়না (৪৫), তাজ উদ্দিন বাদল (২৮) ও জাকির হোসেন পাভেল। এছাড়া মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি ময়না চৌকিদারকে অপর দুটি ধারায় পৃথক পৃথকভাবে সাত বছর ও এক বছর করে কারাদ- প্রদান করেন আদালত। মামলার অপর আসামি হত্যাকা-ের ভিডিওচিত্র ধারণকারী নূর মিয়ার যাবজ্জীবন প্রদান করেন আদালত। সাত বছরের সাজা হয় মুহিত আলম, আলী হায়দার, পলাতক আসামি শামীম আহমদের। অপর দুই আসামি আয়াজ আলী ও দুলালকে এক বছর করে কারাদ- দেন আদালত। অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় বেকসুর খালাস পান ফিরোজ মিয়া, আজমত আলী ও রুহুল আমিন। দ-প্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে দশ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ৩ মাসের সশ্রম কারাদ- প্রদান করেন আদালত। রবিবার বেলা বারোটা ৪০ মিনিটে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আকবর হোসেন মৃধা আলোচিত এই হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণা উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সিলেটের আদালতপাড়ায়। আলোচিত এ হত্যা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় করে উৎসুক জনতা। বিচার শুরুর পর ১৬ কার্যদিবসের মধ্যে রবিবার (৮ নবেম্বর) এ মামলার রায় ঘোষণা হয়। উল্লেখ্য, গত ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় সদর উপজেলার কান্দিরগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামের আজিজুল ইসলাম আলমের ছেলে রাজনকে। নৃশংস এ হত্যাকা-ের পর মরদেহ গুম করতে গিয়ে জনতার হাতে আটক হন কামরুলের ভাই মুহিত আলম। হত্যাকারীরা নির্যাতনের ২৮ মিনিটের ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে দেশে-বিদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। খুনীদের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে জনতা। রাজন হত্যাকা-ের পর মহানগরীর জালালাবাদ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) বাদী হয়ে মুহিত আলমসহ অজ্ঞাত ৪/৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে গিয়ে হত্যাকারীদের সঙ্গে আর্থিক সমঝোতার অভিযোগে বরখাস্ত হন জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) আলমগীর হোসেন, এসআই জাকির হোসেন ও আমিনুল ইসলাম। গত ১৬ আগস্ট সৌদি আরবে আটক কামরুল ইসলামসহ ১৩ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে এ হত্যা মামলার চার্জশীট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর সুরঞ্জিত তালুকদার। গত ৭ সেপ্টেম্বর মামলাটি বিচারের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতের বিচারক সাহেদুল করিম। গত ১৬ সেপ্টেম্বর এ আদালতে মামলার প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গত ২২ সেপ্টেম্বর আদালতের বিচারক চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলায় সৌদি আরবে আটক কামরুলসহ ১৩ আসামির বিরুদ্ধে ৩০২/২০১/৩৪ ধারায় অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। গত ১ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ কার্যদিবসে মোট ৩৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। কামরুলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ অক্টোবর ১১ জন সাক্ষী ফের সাক্ষ্য দেন তার উপস্থিতিতে। ২৫ অক্টোবর এ মামলায় ৩৪২ ধারায় আসামিদের মতামত গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শুরু হয়। ২৭ অক্টোবর তিন কার্যদিবসে মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আসামিদের উপস্থিতিতে ০৮ নবেম্বর রায়ের দিন নির্ধারণ করেন আদালতের বিচারক। এদিকে নির্মম এ হত্যাকা-ের পর মামলার প্রধান আসামি কামরুল ইসলাম সৌদি আরবে পালিয়ে গিয়েও রক্ষা পাননি। প্রবাসীরা তাকে ধরে বাংলাদেশ দূতাবাসে হন্তান্তর করেন। পুলিশ সৌদি আরবে গিয়ে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ১৫ অক্টোবর তাকে দেশে নিয়ে আসে। আসামিদের মধ্যে গ্রেফতারকৃত কামরুল, তাজউদ্দিন বাদল ও রুহুল আমিন ছাড়া অন্য ৮ জন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়।” ইন্টারনেটে প্রাপ্ত এই খবরটিতে রাজন হত্যা মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ যা আছে তাতে একে আর দশটি মামলা থেকে আলাদা করা কঠিন। কেবল দ্রুত বিচার হওয়া ছাড়া মামলার আর তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। আর দশটি মামলার মতোই এই মামলাতেও ঘাতককে সহায়তা করার জন্য পুলিশের কোন বিচার হয়নি। তবে আমরা যদি পুরো প্রেক্ষিতটি বিবেচনা করি তবে আমাদের কাছে বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। প্রথমত রাজন হত্যার মধ্য দিয়ে আমরা মানুষের পশুবৃত্তিকে উলঙ্গভাবে প্রকাশিত হতে দেখলাম। একটি নিষ্পাপ শিশুকে কত জঘন্যভাবে হত্যা করা যায় এবং সেটি মানুষকে দেখানোর জন্য ভিডিও করে সেটি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া যায় তার নিকৃষ্টতম উদাহরণ দেখলাম আমরা এই হত্যাযজ্ঞের মাঝে। একই সঙ্গে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম মানুষের অন্তরে যে ভালবাসা, ¯েœহ ও দরদ থাকার কথা সেটি বিষে পরিণত হয়েছে। মানুষ শিশুটিকে রক্ষা করতে এগিয়ে না এসে পৈশাচিকভাবে মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছে। আমাদের নাগরিক সমাজেও এমন পৈশাচিকতা সহজে চোখে পড়ে না। অন্যদিকে রাজন হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাবান দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ ও টাকার ক্ষমতা দুটিই আমরা দেখলাম। ঘাতককে টাকার বিনিময়ে বিদেশে পাচার করার প্রধান হাতিয়ার যে ছিল টাকা সেটি আবারও আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল রাজন। যদিও এটি নতুন কোন ঘটনা নয়, তথাপি দেশটির ধনতান্ত্রিক রূপান্তরের নগ্ন প্রকাশ আবারও ঘটল। এই ঘটনাটি জনগণের মানসিকতার উল্টো চিত্রও প্রকাশ করেছে যে, রাজনের ঘাতক দেশ থেকে পুলিশের দুর্নীতির সুযোগে টাকার জোরে পালিয়ে যাবার পরও প্রবাসী বাংলাদেশীরা সেই ঘাতককে আটক করে এবং ঘাতককে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করে তার ফাঁসিও দেয়া সম্ভব হয়। এটি যেমন করে মানুষের সচেতনতা ও মানবিকতাকে প্রকাশ করে, তেমনি এটিও প্রকাশ করে যে, ইচ্ছে করলে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। হয়ত এই সত্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ৮ জুলাইয়ের ঘটনার বিচার ৮ নবেম্বরের মাঝে সম্পন্ন হতে পেরেছে। আমাদের চারপাশের বিচারের বাণীর কান্না থামাতে এটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। তবে উচ্চ আদালতে এই ধারাবাহিকতা বহাল থাকবে কিনা সেটির কোন নিশ্চয়তা অন্তত আমি পাইনি। দুটি শিশু হত্যার বিচারের মাইলফলক দৃষ্টান্তটি স্থাপনের পাশাপাশি আদালত আরও একটি কাজ করেছে। সেদিন শিশুর পায়ে গুলিবর্ষণকারী একজন সাংসদকে জামিন দিয়েছে। সংসদের অধিবেশনে যোগ দেবার অজুহাতে এই জামিন প্রদান করা হয়। টিভিতে আমরা দেখেছি সেই সাংসদকে ফুলের মালা দিয়ে জেলগেটে স্বাগতও জানানো হয়েছে। ফলে শিশুহত্যার বিচারের বাণী যে কেবল সফলতা দেখেছে সেটাই নয়, বরং শিশু নির্যাতনকারীর সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে বসবাস করে আমাদের কাছ থেকে ফুলের মালাও পাচ্ছে। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিকার হচ্ছে এটি। এই সমাজ যেমনি করে মানুষকে নিকৃষ্ট জীবে পরিণত করে, তেমনি বিচারকে অর্থের কাছে জিম্মি করে দেয়। রাজন-রাকিব হত্যার দুয়েকটি ভাল দৃষ্টান্তের পাশাপাশি শাহাদাতের ওপর গুলিবর্ষণকারীকে ফুলের মালাও প্রদান করে। এজন্য এ বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার যে, দিনে দিনে মানবিকতার অধঃপতন ঘটছে। শিশু হত্যা যেমন নতুন নয়, তেমনি নিষ্ঠুরতাও নতুন নয়। তবে দিনে দিনে এই নিষ্ঠুরতাকে প্রকাশ করার যে কুৎসিত মানসিকতার বিকাশ ঘটছে সেটি ভাবাই যায় না। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই এমন খুন-নিষ্ঠুরতা হয়ে আসছে। কালে কালে এর রূপ বা মাত্রা বদল হয়েছে মাত্র। আইন-আদালত এসব বিষয়ে শাস্তির ব্যবস্থাও করেছে। কিন্তু সেই পরিবর্তন কি হয়েছে যা হওয়া উচিত ছিল? ধর্মের নামে, বিবেকের নামে, সততার নামে বা মানবিকতার নামে চারপাশে যেসব নিষ্ঠুরতা হচ্ছে সেটি এমনকি মানুষের আদি সমাজেও ছিল না। বিশেষ করে মানুষ অনাদিকাল থেকে নারী ও শিশুর প্রতি যে বিশেষ দরদ দেখিয়ে আসছে রাজন হত্যায় সেটির উল্টো চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করব আদালতের রায়, ফাঁসি বা কারাদ-ের চাইতে আমাদের বিবেক ও মানবিকতা অনেক বেশি জাগ্রত হবে। আদালতের ফাঁসির চাইতে অনেক বেশি ফল পাওয়া যাবে যদি মনের পশুকে ফাঁসি দেয়া যায়। অন্যদিকে ধনতন্ত্রের বিকাশকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তবে শিশুর জীবন টাকার থলেতে বন্দী হয়েই থাকবে। যাহোক, নিবন্ধটির শেষ প্রান্তে আমি সভ্যতার বিবর্তনে মিডিয়ার রূপান্তরের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রাজন হত্যার বিষয়টি সবচেয়ে বড় যে সত্যটিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে সেটি হচ্ছে বিশ্বটা ডিজিটাল হয়েছে এবং প্রচলিত গণমাধ্যমের চাইতে ডিজিটাল গণমাধ্যমের প্রভাব আমাদের দেশে অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়েছে। স্মরণ করতে পারেন যে, রাজন হত্যার ভিডিও ফেসবুকে প্রচারের পর থেকে দেশের মানুষ, এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশীরা যে আন্তরিকতার সঙ্গে পুরো বিষয়টিকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছে, যেভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং সত্যকে অতন্দ্র প্রহরায় রেখেছে সেটি অতুলনীয়। আমরা সাম্প্রতিককালে ডিজিটাল গণমাধ্যমের এই ক্ষমতাটিকে উপলব্ধি করতে শুরু করেছি। গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম দিয়ে যার যাত্রা শুরু রাজন হত্যায় সেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তারই আরও একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে।
×