ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তাপস মজুমদার

অমৃত সমাচার

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৫ নভেম্বর ২০১৫

অমৃত সমাচার

গত দুটো সংখ্যায় পর পর দুটো গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে লেখার পর এবার ভেবে রেখেছি হাল্কা চালে হাল্কা বোলে দুটো মজার বিষয় নিয়ে লিখব- রসগোল্লা ও ইলিশ। এ দুটোই বাঙালীর পাতে, বাঙালীর ভাতে বেশ ভাল জমে বৈকি। শ’ শ’ বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বলে কথা! তবে তার আগে বিজেপি, বিহার এবং নীতিশ-লালু নিয়ে সর্বশেষ খবরা খবর। ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছেন যে, গত রবিবার ঘোষিত বিহার বিধানসভার নির্বাচনে একেবারে ভরাডুবি ঘটেছে বিজেপির। ২৪৩ আসনের বিধানসভায় নীতিশ-লালুর মহাজোট পেয়েছে ১৭৮টি আসন, বিজেপি জোট মাত্র ৫৮টি। অথচ আগের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জোট পেয়েছিল ৯৪টি আসন। দিল্লীর দিকে তাকালে কী দেখি? গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র তিনটি আসন অথচ এর আগের নির্বাচনে দলটির আসন ছিল ৩২টি। এ থেকে বেশ বোঝা যায় যে, দিল্লীর নির্বাচনের ভরাডুবি থেকে আদৌ কোন শিক্ষা নেয়নি বিজেপি। অধিকন্তু জাত-পাত, স্পৃৃশ্যে-অস্পৃৃশ্যে বিভক্ত অনগ্রসর ও অনুন্নত বিহারে তুরুপের তাস হিসেবে খেলেছে গো-মাংস বিতর্কের সাম্প্রদায়িকতা। এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, উত্তরপ্রদেশে গো-মাংস বিষয়ক গুজব ছড়িয়ে প্রত্যন্ত এক গ্রামে ইখলাখ হত্যা বিজেপি দলীয় উগ্রপন্থীদেরই কাজ, যার অহেতুক জেরে বর্তমানে সারা ভারত প্রায় জেরবার। দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বাধানো বিজেপি-আরএসএসের পুরনো ঐতিহ্য এবং ভারতের আদালত যাই-ই বলুক না কেন, ভয়াবহ গুজরাট দাঙ্গার পেছনে নরেন্দ্র মোদির নাম কোনদিনও মুছে যাওয়ার নয়। তবে গো-মাংস বিতর্কের জেরে মোদি-অমিত শাহর আপাত পরাজয়ে নিশ্চয়ই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে ভারতের অগণিত শান্তিপ্রিয় মানুষ। বিহারের ভোটারদের মধ্যে বড় একটা অংশ যাদব সম্প্রদায়, তথা গো-পালন ও গোয়ালা পেশার সঙ্গে যুক্ত। সেই তারা যখন ভোটের রাজনীতিতে গো-বিতর্কের ট্যাবলেট গেলেনি, সেহেতু এই ইস্যু অন্যত্রও টিকবে বলে মনে হয় না। বিজেপির এই ভরাডুবিতে দলের প্রবীণ নেতারাÑ সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানি, সাবেক সভাপতি ও মানবসম্পদমন্ত্রী মুরলিমনোহর যোশি, সাবেক অর্থ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা ও সাবেক মন্ত্রী শান্তকুমার এক লিখিত বিবৃতিতে বলেছেন, দিল্লীর ভোট থেকে শিক্ষা না নেয়াতেই বিহারে এই বিপর্যয়। এর জন্য দায়ী সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছে, যাদের মধ্যে আছেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহও। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি বিহারের ফলাফলকে মেনে নিয়ে যথারীতি অভিনন্দন জানিয়েছেন নীতিশ কুমার, লালুপ্রসাদ যাদবকে। গণতন্ত্রের শক্তি বুঝি নিহিত এখানেই। এবার আসি ইলিশ প্রসঙ্গে। জনকণ্ঠের যারা আগ্রহী পাঠক এবং নিয়মিত হাট-বাজার করেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, এবার রাজধানীর বাজারে ভাল মানের ইলিশ প্রায় মেলেনি। রাজধানীতে ইলিশ মাছ এসেছেও কম তুলনামূলকভাবে, অধিকাংশই আকারে ছোট। চার শ’ পাঁচ শ’ গ্রামের। ঠাটারিবাজার, রায়সাহেবের বাজার এবং গোপীবাগ বাজারের খোঁজখবর নিয়েই লিখছি এ কথা। নিউমার্কেট, গুলশান-বনানীর অপেক্ষাকৃত সচ্ছল বাজারে কিছু বড় ইলিশ মিললেও মিলতে পারে। তবে সার্বিকভাবে ইলিশের উপস্থিতি যথেষ্ট অথবা আশানুরূপ বলা যাবে না। এ নিয়ে খুব একটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও চোখে পড়েনি। কবি বুদ্ধদেব বসুর একটা গল্পে পাই, কলকাতার বাজারে ইলিশ উঠেছে বলে সদ্য যৌবনে অবতীর্ণ এক কিশোরী হৈ হৈ করে ছুটছে তার প্রতিবেশীদের সুসংবাদটা দিতে। রাজধানীতে এবার এমনটা হলে নিশ্চয়ই আমাদের বাঘা বাঘা সাংবাদিক তেমন কার্পণ্য করতেন না খবরটা দিতে। আমরা ঠাটারিবাজারের দু’চারজন মাছ বিক্রেতাকে জানি, যারা সারাবছর ধরে ইলিশ মাছ বিক্রি করেন। এবার তাদের ব্যবসায় মন্দা গেছে। কেউ কেউ দিনের পর দিন বাজারেও আসেননি। কেন এমন হলো বা হচ্ছে? ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। মাছের রাজা না হলেও রানী তো বটে! অমন অপূর্ব সুন্দর সুঠাম রূপালী ঝা-চকচকে সুদর্শন মীনরাশি কী দ্বিতীয়টি মেলে ভূ-ভারতে, ভূপৃষ্ঠে! অথচ বাস্তবতা হলো ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে, অন্তত বাংলাদেশে। মাছবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ইলিশপ্রাপ্ত বিশ্বের ১১টি দেশের মধ্যে ১০টিতে কমলেও গত ক’বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে বাংলাদেশে। বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে, ভারতে ৫ শতাংশ, মিয়ানমারে ১০ শতাংশ। আরব সাগর তীরবর্তী দেশসমূহ এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী গুটিকতক দেশে বাদবাকি ইলিশ উৎপাদিত হয়ে থাকে। অনেক দেশে ইলিশকে ডাকা হয় শ্যাড মাছ হিসেবে। জাটকা নিধন বন্ধ এবং প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করার কারণেই বেড়েছে ইলিশের উৎপাদন। এক্ষেত্রে নিয়মিত নজরদারি জোরদার করাসহ বর্তমানের ২ লাখ ২৪ হাজার জেলের পাশাপাশি আরও বেশি সংখ্যক জেলেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় আনা সম্ভব হলে আরও বাড়তে পারে ইলিশের উৎপাদন। উল্লেখ্য, দেশের মোট মাছের ১১ শতাংশ উৎপাদন আসে ইলিশ থেকে এবং মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ শতাংশ। মৎস্য অধিদফতর এ বছর চার লাখ টন ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশা করছে। অধিকন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও পদাঙ্ক অনুসরণ করে পশ্চিমবঙ্গ ও উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ ইলিশের অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠাসহ জাটকা নিধন বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছে। বেশ আশা জাগানিয়া খবর বটে। তবে আবারও সেই প্রশ্ন, বাজারে ইলিশ কই? কম কেন? কিছুদিন আগে বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কম কেন জিজ্ঞাসিত হলে সকৌতুকে বলেছিলেন, বনের বাঘেরা সব ভারতে বেড়াতে গেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইলিশও বুঝি প্রায়ই বেড়াতে যায় পশ্চিমবঙ্গে। এ কথা কে না জানে যে, এদেশীয় ইলিশের সবিশেষ কদর সে দেশে। কেননা ইলিশ যতই সাগর থেকে উজান ঠেলে নদীর মিষ্টি পানির দিকে আসে, ততই এর নধরকান্তি দেহ থেকে ঝরে যায় লবণ, স্বাদ বাড়ে, তৈলাক্ত যুক্ত হয়ে মিঠা পানির অফুরন্ত প্লাংকটন ও অ্যালগি খেয়ে। যা হোক, আপাতত ইলিশ নিয়ে এই পর্যন্ত। এরপর রসগোল্লা। এ নিয়ে লেখার কারণ, রসগোল্লা নিয়ে রীতিমতো হই-হুল্লা ও শোরগোল বেধেছে ভারতের দুই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা রাজ্য সরকারের মধ্যে। এ লড়াইয়ে এমনকি জড়িয়ে পড়েছে দুটো রাজ্যের গণমাধ্যমসহ জনসাধারণও। উড়িষ্যার দাবি, রসগোল্লার আবিষ্কর্তা তারাই। বাঙালী তা ছিনিয়ে নিয়েছে। পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরে লক্ষ্মীকে ক্ষীরমোহন ভোগ দেয়া হতো। পরে তার মানভঞ্জন করতে জগন্নাথ লক্ষ্মীকে রসগোল্লা উপহার দেন। তবে এটি একটি মিথ বটে। আর একটি মত বলে, উড়িষ্যার পাহালা গ্রামে গাভী ও দুগ্ধপ্রাচুর্য থেকে দই ও ছানার রসগোল্লা তৈরি করে গোয়ালারা। পরে তা ছড়িয়ে পরে পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশে দলে দলে উড়িয়া পাচকের হাত ধরে। এই মতটা একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। তবে দুধের ছানা কেটে দেবতা বা দেবীকে ভোগ দেয়ার ব্যাপারটা কিছুটা বেখাপ্পা ঠেকে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে রসগোল্লার আবিষ্কর্তা হিসেবে ইতোমধ্যে প্রসিদ্ধি পেয়েছেন বাগবাজারের নবীনচন্দ্র দাস। বাংলার খাদ্য-ঐতিহাসিকদের মতে, নবীন ময়রা, ব্রজ সরকারের হাত ধরেই রসগোল্লার উৎপত্তি। সেখানে মহাধুমধামে রসগোল্লার শতবর্ষও পালিত হয়েছে। এক্ষণে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল মনে পড়ে। ১৯৩৬ সালে নবীন চন্দ্রের পৌত্র টিনে ভরা ভ্যাকুয়াম রসগোল্লা আবিষ্কার করেন (কেসি দাস)। এখন তো স্পঞ্জ রসগোল্লা, ডায়াবেটিক রসগোল্লা পাওয়া যায় বাংলাদেশেও। বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনে ইতোমধ্যে রসগোল্লার পেটেন্টের জন্য আবেদনও করা হয়েছে কলকাতার তরফে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে মেধাস্বত্ব অধিকারের লড়াইয়ে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত কোন্ পক্ষে থাকবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। নাকি নিজেই লড়াই করবে স্বীকৃতির জন্য! সবশেষে, একটি গল্প দিয়ে শেষ করি। লালুপ্রসাদ যাদব তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। আর পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী। লালুপ্রসাদ এসেছেন পশ্চিমবঙ্গ সফরে মমতার আতিথ্য নিয়ে। উঠেছেন রেলের রেস্টহাউসে। লালু তো এসেছেন নিজস্ব পাচক নিয়ে। পোলাও-মাংস-কোর্মা-কালিয়ার তুলনায় লালুপ্রসাদের প্রিয় অড়হরের ডালসম্ভারা, রোটি-চাপাতি। শেষ পাতে মিষ্টি দই ও রসগোল্লা পড়তেই লালু রেগেমেগে প্রায় অগ্নিশর্মা, ছ্যা ছ্যা বাঙালরা মিষ্টি দই খায়, রসগোল্লা খায়! উল্লেখ্য, লালুর প্রিয় সাদা টকদই। জানি না, বাংলামুলুক বাদে শেষ পাতে মিষ্টি দই ও রসগোল্লার প্রচলন বিশ্বের অন্য কোথাও আছে কিনা!
×