ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অঞ্জন আচার্য

আয় বৈষম্য কমছে লাতিন আমেরিকায়

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ১৫ নভেম্বর ২০১৫

আয় বৈষম্য কমছে লাতিন আমেরিকায়

দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক নীতি ভাল হওয়ার অথবা ধনী দেশগুলোর সাহায্যের ওপর নির্ভর করে না। এটি নির্ভর করে দেশগুলোর সরকার কতটা ভালভাবে দেশ পরিচালনা করে তার ওপর। বলাবাহুল্য, এ ক্ষেত্রে সুশাসনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমনে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সরকারের সক্ষমতার ওপর। এছাড়া বৈষম্য কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে জনগণের মৌলিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। যুক্তরাষ্ট্রের তুলানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক নোরা লুস্টিগ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিশ্বে আয় বৈষম্য বাড়ছে না। লাতিন আমেরিকার বিশেষজ্ঞ এই গবেষক দেখিয়েছেন, বিশ্বের একমাত্র যে অঞ্চলটিতে বৈষম্য কমছে সেটি হলো লাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে মেক্সিকো, ব্রাজিল, বলিভিয়া ও আর্জেন্টিনা। এ দেশগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আয় স্থানান্তর কর্মসূচি এবং শিক্ষায় প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধির কারণে বৈষম্য কমছে বলে মনে করেন তিনি। যদিও এসব দেশের বৈষম্য পরিস্থিতি এখনও হতাশাজনক। আয় বণ্টনে বৈষম্য কম হলে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শিক্ষায় প্রবেশগম্যতা এবং ঝরেপড়া রোধে বড় ভূমিকা রাখে। আর শিক্ষা হলো একটি দেশে সামাজিক গতিশীলতা এবং জীবনমান উন্নয়নের খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ শ্রমের উচ্চ উৎপাদনশীলতা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পূর্বশর্ত। বিপুলসংখ্যক নিরক্ষর ও অশিক্ষিত মানুষ নিয়ে কোন দেশ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছেছে, ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত একটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্রাজিলে চালু করা হয়েছে ‘বলসা ফ্যামিলিয়া’ (পারিবারিক অনুদান) নামে একটি কর্মসূচী। এর অধীনে যেসব দরিদ্র পরিবারে সর্বোচ্চ তিনটি সন্তান রয়েছে তাদের প্রত্যেকের স্কুলে যোগদানের জন্য প্রতি মাসে প্রায় ১৩ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ আর্থিক ভাতা দেয়া হয়। এছাড়া যেসব পরিবারের ১৬ বা ১৭ বছর বয়সের দুটি সন্তান ইতোমধ্যেই স্কুলে পড়াশোনা করছে, তাদের প্রতিজনের জন্য মাসে ১৯ ডলারের সমপরিমাণ আর্থিক ভাতা দেয়া হয়। এ কর্মসূচীর আওতায় সুবিধা ভোগ করছে প্রায় ৫ কোটি ব্রাজিলিয়ান। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বলসা কর্মসূচীর কারণে স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও পাঠক্রম সম্পন্ন করার হার বেড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তাদের স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হয়েছে। আয়ের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি অসম দেশগুলোর সর্বাধিক সমাবেশ ছিল দক্ষিণ আমেরিকায়। তবে গোটা মহাদেশে এক নতুন ধারার সঞ্চার হয়েছে। বিগত দশকে গরিবের আয় যথেষ্ট বেড়ে গেছে। ফলে আয়ের ক্ষেত্রে অসমতা অনেক কমে এসেছে। লাতিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশে গিনিসূচক ২০০০ সালের তুলনায় ২০১০ সালে কম ছিল। এ অঞ্চলের গড় গিনিসূচক হলো শূন্য দশমিক ৫। এক দশক আগে ছিল শূন্য দশমিক ৫৪। গত ত্রিশ বছরের কোন সময় গিনিসূচক এত কম হয়নি। তবে তার পরও এই সূচক অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি। আর্জেন্টিনার পরিস্থিতি বিচারে বলা যায় যে, লাতিন আমেরিকার সর্বাধিক ধনী ১ শতাংশ মানুষের আয় সমাজের বাকি মানুষদের তুলনায় অনেক বেশি। তারপরও বলতে হয়, লাতিন আমেরিকায় আয়ের ক্ষেত্রে ব্যবধান কমে আসছে। গত ১০ বছরে মহাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার উদীয়মান এশীয় দেশগুলোর তুলনায় অর্ধেক ছিল। তারপরও এর দারিদ্র্যের হার ৩০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছে? ঔপনিবেশিক আমল থেকে যে মহাদেশটির আয় বণ্টন ব্যবস্থা চরমরূপে অসম ছিল সেটা সহসা বদলে গেল কীভাবে? একটা বড় কারণ হলো লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে কট্টর বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় এসেছে, বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ও ভেনিজুয়েলা। দেখা গেছে, অসমতা হ্রাস পেয়েছে সেইসব দেশে যারা পণ্য রফতানির ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল, যেমন- পেরু। অসমতা এমন দেশেও হ্রাস পেয়েছে যেখানে কারখানা শিল্পের বৃহত্তর ভূমিকা আছে, যেমন মেক্সিকো। লাতিন আমেরিকায় আয়ের ব্যবধান কমাতে দুটো জিনিস বড় ধরনের পার্থক্য রচনা করেছে। কয়েক বছর ধরে টানা প্রবৃদ্ধির ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমশক্তিতে কম দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিকের তুলনামূলক চাহিদা বেড়েছেÑ তা সেটা নির্মাণ খাতের শ্রমিক হোক আর ঝাড়ুদার হোক। দ্বিতীয় কারণ হলো লাতিন আমেরিকার প্রায় সব সরকার সর্বনিম্ন আয়ের লোকদের টার্গেট করে সামাজিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মজুরির ব্যবধান কমিয়ে আনা হয়েছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় পরিবর্তনটা ঘটেছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। আগে লাতিন আমেরিকার সরকারগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে অকাতরে অর্থ ব্যয় করত। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলো ছিল অবহেলিত। ১৯৯০-এর দশকের প্রথমভাগ থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। দরিদ্রদের মধ্যে সরকারী মাধ্যমিক শিক্ষার দারুণ প্রসার ঘটে। এই কৌশল অবলম্বনের সুফল পাওয়া গেছে। এলসালভাদর, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা ও নিকারাগুয়া বাদে লাতিন আমেরিকার আর সব দেশে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির সময় ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান কমে গেছে। উন্নততর শিক্ষা, কম দক্ষ শ্রমিকদের পণ্য অধিকতর ভাল সুযোগ, সামাজিক খাতে বড় অঙ্কের ব্যয় এসবের সামষ্টিক ফল হিসেবে লাতিন আমেরিকায় আয়ের ক্ষেত্রে ব্যবধান কমে গেছে। ব্রাজিলে এই অসমতা হ্রাস পেয়েছে এক-তৃতীয়াংশ। এদিকে সম্প্রতি ‘দ্য ডন’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষের বাস লাতিন আমেরিকায়। মূল : এন্ড্রেস ভেলাস্কো সূত্র : প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
×