ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে দম্ভোক্তির সুর- আমার টাকা কার পেটে না গেছে। কয়দিন আটকাইয়া রাখবেন স্যার

নূর হোসেনের পুরনো সিন্ডিকেট আবার সক্রিয় হতে তৎপর

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৬ নভেম্বর ২০১৫

নূর হোসেনের পুরনো সিন্ডিকেট আবার সক্রিয় হতে তৎপর

শংকর কুমার দে ॥ ‘আমার টাকা কার পেটে না গেছে স্যার কয়দিন আমারে আটকাইয়া রাখবেন? বেশি হইলে চাইর-পাঁচ বছর! হের পরে তো কোনভাবেই আমারে রাখতে পারবেন না।’ দম্ভোক্তির সুরে এই কথাগুলো বলেছেন চাঞ্চল্যকর নারায়ণগঞ্জ সাত খুনের মামলার অন্যতম আসামি নূর হোসেন। কলকাতা থেকে ঢাকায় আনার পর এই ধরনের দম্ভোক্তি করে মুচকি হাসি দিয়ে এসব কথা বলার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে তার হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে আশাবাদী। তার ফিরে আসার পর পুরানো সিন্ডিকেটও আবার সক্রিয় হওয়ার জন্য তৎপর। মাদক ব্যবসা, পরিবহন চাঁদাবাজি, বালুর মহল, মাছের খামার, জমি দখলসহ অবৈধ আয়ের উৎস ছিল তার পুরানো সাম্রাজ্যের প্রতি মাসে অবৈধ আয় ছিল তার কোটি টাকা। প্রতি মাসে আয়ের কোটি টাকার প্রায় অর্ধেকটাই চলে যেত দুর্নীতিবাজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, ওয়াসা, ডেসাসহ সেবা খাতের কর্মকর্তাদের পেছনে। কারাগারে বসেই তার হারানো পুরানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে আগ্রহী নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনায় যেন তার শাপে বর হয়ে উঠেছে। অনুসন্ধানে এই ধরনের তথ্য জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নূর হোসেন এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শাপলা সেলে। তার সর্বক্ষণিক নিরাপত্তায় আছেন কারারক্ষী। সেলের সামনের বারান্দা ও পাশের রাস্তাটি সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে সর্বক্ষণিকভাবে মনিটর করার ব্যবস্থা আছে। কারাগারের ভেতরেই পারসোনাল ক্যাশে (পিসি) কোন টাকা জমা করার সুযোগ আছে তার। কলকাতার কারাগারে থাকতে দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠজন ছাড়া অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম তেমন বিস্তৃত না হলেও দেশের কারগারে আনায় যোগাযোগ মাধ্যম বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ ঘটবে। তবে এখনই নয়, তাকে ফিরিয়ে আনার দাবি, ঘৃণা, বিদ্বেষ, কৌতূহল ইত্যাদির রেশ কেটে গেলেই আবারও যে সে কারাগারে বসে কলকাটি নাড়তে পারবেন এমনটাই আশার কথা জানিয়েছেন নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠজন ও সিন্ডিকেটের সদস্যরা। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের তার ঘনিষ্ঠজন, ক্যাডার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, বিভিন্ন স্তরের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার অন্যতম আসামি নূর হোসেন তার হারানো পুরানো সাম্রাজ্য পুনরায় দখলে নিতে মরিয়া। বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনার পর সাম্রাজ্যের বেশ কিছুটা বেদখল হয়ে গেলেও ইতোমধ্যে এর অনেকটা পুনরায় বাগিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন নূর। তার হাতে এসে গেছে বালুমহাল ও হাজী বদরুদ্দীন মার্কেট। শিমরাইলের সিনথিয়া মৎস্য খামারসহ সাম্রাজ্যের বাকি অংশগুলোও পুনরায় নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশাবাদী নূরের ঘনিষ্ঠরা। এলাকায় তার ঘনিষ্ঠজনদের মুখে মুখে ফিরছে যে, দেশের কারাগারে বসে নিজের সাম্রাজ্য নিজেই মনিটর করবেন নূর, যা ভারতের কারাগারে বসে সম্ভব ছিল না। অপরদিকে নূর হোসেন মুখ খুললে অনেকেই বিপদে পড়তে পারেন এমন আশঙ্কায় আতঙ্কে আছেন সুবিধাভোগীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নূর হোসেন ভারতে থাকার সময়েই গত ২ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের উপনির্বাচনে নূর হোসেন মনোনীত প্রার্থী আরিফুল হক হাসানই কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এরপর সিদ্ধিরগঞ্জের ট্রাকস্ট্যান্ডে নূর হোসেনের অফিস পুনরায় দখলে নিতে গিয়েছেন স্বয়ং আরিফুল হক ও নূরের ভাতিজা শাহজালাল বাদল। তবে পুলিশী বাধায় তখন তা সম্ভব হয়নি সেই যাত্রায়। উপনির্বাচনের আগে কলকাতার আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নূর হোসেন সদম্ভে বলেছিলেন, ‘আমার মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করার কোন শক্তি নারায়ণগঞ্জে নাই।’ সিদ্ধিরগঞ্জের অনেকেই মনে করছেন, কাউন্সিলর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নূর হোসেনের সাম্রাজ্য তার আত্মীয়স্বজন ও সহযোগীদের নিয়ন্ত্রণে আসার পথ প্রশস্ত হয়। বালুসাম্রাজ্য, মাদকসাম্রাজ্য, তেলসাম্রাজ্য, জবরদখলদারি, টেন্ডারবাজিÑ সবই এখন নূর হোসেনের সিন্ডিকেটের করায়ত্বে। শুধু পরিবহন সেক্টরের একটি অংশ এখনও নিজ আওতার বাইরে রয়ে গেছে, যা খুব সহসাই তার হাতের কব্জায় চলে আসতে বলে তাদের বিশ্বাস। অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের ৮ এপ্রিল পর্যন্ত নূর হোসেনের সিন্ডিকেটের কোন সদস্যকে এলাকায় দেখা যায়নি। তবে ৮ এপ্রিল আলোচিত সাত খুনের দুটি মামলার ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। নূর হোসেনের খুনের মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্বজন ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা এলাকায় ফিরতে শুরু করে। পুনরায় দখল নিতে থাকে নূরের হারানো সাম্রাজ্য। আগে যে যেখানে ছিল তা দখল করে নেয়। নূর হোসেনের ভাই নুরুজ্জামান জজ এলাকায় ফিরেই কাঁচপুর ব্রিজের ঢালে সড়ক ও জনপথের (সওজ) জায়গা দখল করে। দেড় শতাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে সে সওজের জায়গা দখল করে সেখানে বালু ভরাট করে চলেছে। সেখানে ‘মেসার্স জেরিন ট্রেডার্সের সাইনবোর্ড ঝোলানো রয়েছে। শিমরাইলে ৫০ একর জায়গার ওপর নূরের মেয়ে সিনথিয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত মৎস্য খামারটিও প্রথমে দখল করে নেয় মনির। পরে নূরের সহযোগী বাদল পুনর্দখলে নিয়েছে। যদিও ওই খামারে এখন পর্যন্ত মাছের পোনা ছাড়তে সক্ষম হয়নি তারা। নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদল এলাকায় ফিরেছেন ঈদের তিনদিন আগে। অস্ত্রসহ আটটি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এলাকায় ফিরেই তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর স্থাপিত বাস কাউন্টার ও ফুটপাথ দখল করেন। নূরের ভাতিজা আনু এলাকায় ফিরে লেগুনা ও টেম্পোস্ট্যান্ড দখলে নিয়েছেন। সেখানে ৩০০ লেগুনা থেকে প্রতিদিন দেড় শ’ টাকা করে চাঁদা তোলে আনুর লোকজন। নূর হোসেনের দূর সম্পর্কের ভগ্নিপতি রতন মোল্লা ফিরে এসে পরিবহন সেক্টরের দখল নিয়েছেন। স্থানীয়দের ভাষ্য, একটা বিশাল বাহনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই রতন মোল্লা। নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হাসান ও বাদলের নেতৃত্বে আসলাম, সুরুজ, লিটন, বাপ্পী, সেলিম খান, মাসুম, রতন, ভাঙ্গারি নবী, বেকারি আলম, রিপন, শাহ আলম এলাকায় এখন নব উদ্যোমে নানা তৎপরতায় সক্রিয়। হারানো ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার ফিরে পাওয়ার আশায় শিমরাইল মোড়, ট্রাকস্ট্যান্ড, বাসস্ট্যান্ড, ট্যাক্সি ও মাইক্রোস্ট্যান্ড, সিদ্ধিরগঞ্জ হাউজিং, কাঁচপুর সেতুর নিচের বালুমহাল, সিদ্ধিরগঞ্জ পুলসংলগ্ন বিদ্যুত কেন্দ্র, আদমজী ইপিজেড, মেঘনা ও পদ্মা ডিপোসহ সকল সেক্টরের দখল ও নিয়ন্ত্রণ এখন হোসেন সিন্ডিকেটের হাতে।
×