ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

সুরের ইন্দ্রজালে ভাসল প্রজন্ম

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১৭ নভেম্বর ২০১৫

সুরের ইন্দ্রজালে ভাসল প্রজন্ম

এদেশের মানুষের সত্যিকারের গৌরব দেশের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় লোকসঙ্গীতে। একে বাংলা সংস্কৃতির প্রাণ বললেও ভুল বলা হবে না। ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি ও বাউল গানের সুরে মাতোয়ারা হননি এমন বাঙালী খুঁজে পাওয়া কঠিন। শত বছর পরেও এ সব গানের আবেদন এখনও ফুরায়নি। বাংলা সংস্কৃতির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে লোকধারার এ সব গান। শুধু দেশের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় নয় বরং দেশের বাইরেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে লোকধারার সঙ্গীতগুলো। লোক গানের সুর ও কথায় বেঁচে আছি আমরা আর আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। এদেশের তরুণ প্রজন্মকে বাংলার মাটি, মানুষ আর সুরের টানে বিমোহিত করতে এই সুরভা-ারের তুলনা অসিম। তাই দিন শেষে আমরাই লালন, আমরাই হাসন রাজা, আব্বাসউদ্দিন, আবদুল আলীম আর বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম। একটি দেশ বা একটি সংস্কৃতির প্রকৃত পরিচয় তার লোকসঙ্গীতের। ফোক গান বাংলাদেশী সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় গভীরে ছড়িয়ে রয়েছে। এটা শুধু বাংলাদেশী জীবনের গল্প বলতে নয় এটা ধর্ম, সমাজ, পরিবেশ এবং আমাদের জীবনের বিভিন্ন কথা বলে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে লোকসঙ্গীতের আগ্রহ, অনুশীলন বেশ কম। সম্প্রতি বেশ কজন বাংলাদেশী তরুণ ক্রমবর্ধমানভাবে তা জনপ্রিয় করে তুলতে একটি নতুন পদ্ধতিতে লোক সঙ্গীত পরিবেশন করছে। লোকসঙ্গীত যে আত্মার গান তা প্রমাণিত। তাই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ১২ নবেম্বর থেকে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো শুরু হয়েছিল ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক ফোক ফেস্টিভাল ২০১৫’-এর আসর। প্রচার প্রচারণা আর মিডিয়ার কৌতূহলী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ‘ফোক ফেস্টিভাল’ টিকে ঘিরে শহুরে মানুষের আগ্রহ ছিল দেখার মতো। কারণ প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিতব্য এই আয়োজনে উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাউল ঘরানার আধুনিক শিল্পীরা একসঙ্গে একই মঞ্চে গাইছেন! ৬টি দেশের প্রায় শতাধিক শিল্পী ও ব্যান্ড পারফর্ম করছে এই ফেস্টিভালটিতে। এই আয়োজনটি উপভোগ করতে রাজধানীর হাজারো মানুষ ১২ নবেম্বর বিকাল ৩টা থেকেই আর্মি স্টেডিয়ামে জড়ো হতে থাকেন। যদিও স্টেডিয়ামের গেট খুলে দেয়া হয় বিকাল সাড়ে চারটা নাগাদ! সবার মতোই শহুরে মানুষের বিশাল স্রোত ঠেলে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ আকাক্সিক্ষত স্থানে উপস্থিত হতে পারলেও অন্তত ঘণ্টা খানেকের বেশি সময় চলে যায় স্টেডিয়ামের মূল ফটকের সামনে যেতে। স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়েই আরেকটা জিনিসের প্রতি চোখ বার বার আটকে যাচ্ছিল। স্টেডিয়ামের চারপাশে ডিজিটাল ব্যানারে দেয়া হয়েছে তিন দিনব্যপী যারা গাইবেন তাদের বিশাল বিশাল ছবি। স্টেডিয়ামে যখন প্রবেশ করলাম, দেখি পুরো স্টেডিয়ামে মানুষে পূর্ণ। মঞ্চের সামনের আসনগুলোতো বটেই এমনকি গ্যালারি আর মাঠের মধ্যখানে ফাঁকা জায়গাগুলোও পূর্ণ মানুষে। বেশির ভাগই একেবারে তরুণ। বুঝলাম, স্টেডিয়ামে উপস্থিত মানুষরা শুধু রাজধানী ঢাকারই নয়, বরং পুরো বাংলাদেশেরই। মঞ্চের বাম পাশে যেতেই দেখা গেল প্রচুর মানুষের ভিড়। একটু উঁকি দিতেই দেখা গেল বাহারি খাবারের ছোট ছোট স্টোররুমের মতো খাবারের রেস্টুরেন্ট। পাশেই বসে খাবারের জন্য সুব্যবস্থাও আছে। যেহেতু এটি মঞ্চের এক পাশে অবস্থিত, মূলত এখানে বিশাল বিশাল স্ক্রিনে অনুষ্ঠান লাইভ দেখারও সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এদিক থেকে সোজা চলে গেলা পুরো বিপরীতে, মঞ্চের ডান পাশে। সেখানেও কিছু স্টলের দেখা পেলাম। মিডিয়া রুম, তথ্যকেন্দ্র এছাড়া একটি তাঁতশিল্পের দোকানও দেখা গেল। আর এই পাশটাতেই দেখা মিলল বাংলাদেশের জনপ্রিয় তারাকাদের। সিনেমা, নাটক, মঞ্চে কাজ করা পরিচিত মুখগুলো সাধারাণ মানুষের মতোই উপভোগ করতে এসেছেন প্রথমবারের মতো আয়োজিত ফোক ফেস্টিভাল। কিছুক্ষণ পর মঞ্চ আলো করে নিজের দল নিয়ে চলে আসলেন অর্ক। শুরু করলেন একেরপর এক গান। এর মধ্যে বাংলাদেশের একেবারে নেচেরাল তিনটি বাউল গান করলেন অর্ক। ‘দে দে দে পাল তুলে দে’ গানটা মুখে নিতেই ফের গর্জে উঠলো পুরো স্টেডিয়ামের অন্দর মহল। গলাতে মেলাতে শুরু করলেন উপস্থিত হাজারো জনতা। একটা গান কিভাবে মানুষকে মুহূর্তেই যুক্ত করে ফেলে অর্কের গাওয়া এই গান গাওয়ার সময় পরিস্থিতি না দেখলে বোঝাই যেত না। এরমধ্যে আবার ফ্রান্সের একটি জিপসি মিউজিকও গাইতে দেখা গেল অর্ক মুখার্জীকে। গানের কথা কেউ না বুঝলেও অর্কের পাশে বসে থাকা মেধাবী দোতারা, মেন্ডোলিন, দেবকি বাদক সত্যকি ব্যানার্জীর অসামান্য সুর তোলা মিউজিকে দুলতে থাকে পুরো স্টেডিয়াম। অর্কের পরেই মঞ্চে উঠলেন বাংলাদেশের তিন প্রখ্যাত বাউল শিল্পী রব ফকির, শফি ম-ল ও লাবিক কামাল। এরপরই গিটারে আঙুল দিয়ে মধ্যরাতে স্তিমিত হয়ে যাওয়া উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের চাঙা করে দিলেন ভারতের অসমে জন্ম নেয়া বলিউডের একাধিক ছবিতে মিইজিক নিয়ে কাজ করা এবং প্রখ্যাত কোক মিডিয়ায় ফিউশন করা শিল্পী পাপন এ্যান্ড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। গাইলেন কোক মিডিয়ায় বিখ্যাত হওয়া তারই সাঁইজি গানটি। এরপর মানুষের মুখে মুখে ফেরা সেই বিখ্যাত গান ‘দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে...’ গানটি গেয়ে উঠলেন। আধু ঘুমে অনেককে গানটির সঙ্গে তুমুল উত্তেজনায় সুর মেলাতেও দেখা গেছে। তারপর একে একে করলেন অসমীয়, হিন্দী ও বাংলা ভাষার গান। তখন ঘরির কাঁটায় চলে গেছে প্রায় মধ্য রাতে। কিন্তু কেউ নড়ছেন না। গেয়ে উঠলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার খ্যাতি অর্জন করা ‘দমাদম মাস কালান্দার’ গানটি। পাপনের কণ্ঠে রুনা লায়লার গান শুনে উপস্থিত শ্রোতারা যেন বাঁধনহারা হয়ে গেল। উৎসব মাতাতে দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই মঞ্চে ওঠেন ম্যাজিক বাউলিয়ানার শিল্পীরা। নবীণ শিল্পীদের মন মাতানো সুরে মাতে উপস্থিত প্রতিটি দর্শক। ধারাবাহিকতায় মঞ্চে উঠেন নাশিদ কামাল, আজগর আলিম, জহির আলিম এবং নূরজাহান আলিম। শ্রোতারা আরও শুনেছেন বারী সিদ্দিকীর করুণ গানে বিষাদের সুর। তরুণ প্রজন্মের একজন হয়ে লোক সঙ্গীতের গান শুনিয়েছেন অর্ণব এ্যান্ড ফ্রেন্ডস, ফোক সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম। আরও এসেছেন শিল্পী পবন দাস বাউল, নুরান সিস্টার্স এবং ইউনান আর্ট ট্রুপ এর সদস্যরা। আয়োজকরা আশা করছেন, প্রতিদিন ত্রিশ হাজারেরও বেশি দর্শক উৎসবটি দেখতে আসবেন আর্মি স্টেডিয়ামে। কিন্তু সেই হিসেব ছাড়িয়ে গেল বায়ান্ন হাজারে! এত মানুষের ঢল যেন সঙ্গীত সুধার অমিয় ধারায় অবগাহনের নিমিত্তেই। তিন দিনের এই আয়োজনে অংশ নিয়েছেন পাঁচ দেশের শতাধিক কণ্ঠশিল্পী, সঙ্গীতায়োজক ও ব্যান্ড দল। গান গেয়েছেন খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন, কাঙ্গালিনী সুফিয়া, বারী সিদ্দিকী, কিরণ চন্দ্র রায়, চন্দনা মজুমদার, মমতাজ, নাশিদ কামাল, আজগর আলীম, জহির আলীম, নুরজাহান আলীম, বাউল শফি মণ্ডল, ইসলাম উদ্দিন কিস্সাকার, অর্ণব, আনুশেহ, লাবিক কামাল গৌরব, ম্যাজিক বাউলিয়ানার শিল্পীরাসহ অনেকেই। বিদেশের তালিকায় রয়েছে ভারতের লোকসঙ্গীত সাধক পবন দাস বাউল, ফোক ব্যান্ডদল ইন্ডিয়ান ওশান, নুরান সিস্টার্স, পাপন, পার্বতী বাউল, পাকিস্তানের কণ্ঠশিল্পী আবিদা পারভীন ও সাঁই জহুর, চীনের ইউনান আর্ট ট্রুপ, আয়ারল্যান্ডের নিয়াভ নি কারাসহ বেশকিছু আলোচিত লোকজ গানের শিল্পীর নাম। মাছরাঙা টেলিভিশন এবং সান ইভেন্টসের যৌথ আয়োজনে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত এ উৎসবের শেষ দিন ১৪ নবেম্বর। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শক উপস্থিত ছিল এদিন। বৃহস্পতিবার শুরু হয়ে শনিবার শেষ হওয়া এ উৎসবটিকে ঘিরে অনেক আগে থেকেই মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল ও আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। আর তাই তো হাজার হাজার মানুষ রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে এ লোক সঙ্গীতের মহোৎসবটি উপভোগ করেছেন। এর মধ্যে শুক্রবার রেকর্ডসংখ্যক দর্শক উপভোগ করেন উৎসবটি। শেষের দিনও আর্মি স্টেডিয়ামে লোকসঙ্গীত পিপাসুদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। এদিনও লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার পর উৎসবস্থলে প্রবেশ করতে হয়েছে দর্শকদের। এদিন উৎসব শুরু হয় বিকাল পাঁচটায়। রাত ১টা পর্যন্ত চলে বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনা। শেষ দিন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ছিল সাধনার অনবদ্য নাচ দিয়ে। কিন্তু হয়তবা কোন কারণেই তারা পারফরমেন্স করতে পারেনি। ইসলামউদ্দিন কিসসাকার ও একই কাতারে ছিলেন। নিজের ফোক সঙ্গীত পরিবেশন তিনিও করতে পারেননি। যার কারণেই দিনের শুরু হয় জলের গানের স্টেজ পারফরমেন্সের মধ্য দিয়ে। মুহূর্তেই তাদের অনবদ্য পরিবেশনায় যেন প্রশান্তি ছেয়ে যায় স্টেডিয়াম জুড়ে। একে একে কয়েকটি গান পরিবেশন করেন তারা। এরপর পার্বতী বাউল, ইন্ডিয়ান ওশিয়ান এর লোক সঙ্গীতে অন্যরকম উন্মাদনায় ভাসেন দর্শক। তবে শেষের দিনে উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন আবিদা পারভীন। আবিদা পারভীনের মায়াবী লোকসঙ্গীতের পরিবেশনা পূর্ণতা দান করে লোকসঙ্গীতের উৎসবের এই শেষের দিনটিকে। এই উৎসবের সমাপ্তি টানতে মঞ্চে আসেন বিখ্যাত ‘দ্য ম্যাঙ্গানিয়ারস ফ্রম হামিরার’। সব মিলিয়ে উৎসবের তৃতীয় দিনটি ছিল রঙিন ও একই সঙ্গে খানিক বেদনার। কারণ তিন দিনব্যাপী অন্যরকম এক ঘোরে দর্শকদের বেঁধে রেখেছিল উৎসবটি। তবে এই উৎসব পুনরায় উপভোগ করতে ভবসুরের ভক্তদের অপেক্ষা করতে হবে সামনের বছর পর্যন্ত।
×