ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মানস ঘোষ

বিহারের নির্বাচন এবং একটি সমীক্ষা

প্রকাশিত: ০৩:২৬, ১৮ নভেম্বর ২০১৫

বিহারের নির্বাচন এবং একটি সমীক্ষা

গত সপ্তাহে বিহার নির্বাচনের ফল ঘোষণার একদিন আগে আমি এক বিশেষ নিবন্ধে পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলাম, নীতিশ-লালু-কংগ্রেস জোট বিজেপি জোটের চেয়ে ‘বেশিসংখ্যক’ আসন জিতে নেবে এবং নীতিশকুমার তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন। এই সাফল্যের পেছনে কারণগুলো বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারের সময় বিজেপি যেসব মারাত্মক ভুল করেছিল আমি তা সবিস্তারে উল্লেখ করেছি। আমার ওই লেখা পড়ে অনেকে, বিশেষ করে সাংবাদিককুলের কেউ কেউ নীতিশ-লালুর পয়সা খেয়ে তাঁদের নির্দেশ অনুসারে এই লেখা লিখেছি বলে অভিযোগ করেন। শুধু সাংবাদিকই নন, বেশ কয়েকজন রাজনীতিক ফোন করে বলেন, আমি ওই লেখায় লালু-নীতিশের খিদমতগারি করেছি কিছু পাবার আশায়। রাজনীতিকরা দৈনিক স্টেটসম্যানকে অনেকদিন ধরেই তাঁদের ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’ হিসেবে ব্যবহার করেন। বঙ্গেশ্বরী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো দৈনিক স্টেটসম্যানকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘কাগজটির পেটে লাথি মেরে বন্ধ করে দেব, ভাতে মারব।’ আমার লেখা ওনার মনঃপুত না হলেই হুঙ্কার দিয়ে দলের নেতা-সমর্থকদের বলেন, ‘ওই কাগজটি পড়বেন না, হাসিনার টাকা খেয়ে ওটা শুধু মিথ্যা সংবাদ লেখে ও মিথ্যা ভাষ্য দেয় আমাদের বাংলার মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য।’ আর যত বড় বড় সংবাদগোষ্ঠী আছে তারা আমাদের দৈনিককে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। শুধু মালিকরাই নয়, ওইসব গোষ্ঠীর সাংবাদিকরাই বলে থাকেন, দৈনিক স্টেটসম্যান কি লিখল তাতে কী আসে যায়। কিন্তু অনেক কিছুই যে আসে যায় তা ফল প্রকাশের পরপরই জানতে পারি। আমাদের অনেক হিতাকাক্সক্ষী ফোন করে আমাকে বলেছেন, অন্য কাগজ যখন নির্বাচনী ফল নিয়ে কোন স্পষ্ট মত বা ইঙ্গিত প্রকাশের ঝুঁকি নিচ্ছে না অর্থাৎ মোদি জোট যে হারবে সেই খবর ঝুঁকি নিয়ে তারা পরিবেশন করছে না, তখন আমরাই একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে পরিষ্কার ভাষায় বিশ্লেষণ করে বলেছিলাম বিজেপি নীতিশের মহাজোটের কাছে শুধু পরাজিতই হবে না, এক বিশাল ব্যবধানে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হবে। বড় বড় বাংলা ও ইংরেজী সংবাদগোষ্ঠী নিরাপদ বলয়ে থাকতে চায় বলে তাদের রিপোর্ট বা মতামত কলামে এই সত্য কথাটা সৎসাহস নিয়ে প্রকাশ করার হিম্মৎ দেখায়নি। কারণটা খুবই সহজবোধ্য। আসলে বিজেপি সরকারের বিজ্ঞাপন হারানোর ভয়ে তারা সত্যি কথাটা লেখা থেকে বিরত থেকেছে। ফোনে একজন বললেন, ‘আপনার লেখায় সত্য কথাটা পড়ে দৈনিক স্টেটসম্যানের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় দৈনিক স্টেটসম্যান ছিল একমাত্র কাগজ যা সাহস করে লিখেছিল তৃণমূল প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ভোট দিতে বাধ্য হবে। সেটা পরে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। অনেক সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল নানা ধরনের কল্পনার ফানুস উড়িয়েছিল। যা পরে ফেটে গিয়েছিল। বিহার নির্বাচন নিয়ে আপনার দৈনিকের সমীক্ষা তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে।’ উত্তরে আমি তাঁকে বিনম্র ভাষায় বললাম, আমার ধমনীতে বয়ে চলেছে স্টেটসম্যানের তিন পুরুষের পরম্পরা। স্টেটসম্যানের রিপোর্টিং করেছি চার দশকের বেশি। সত্যি কথাটা সোজাভাবে বলতে আমি অভ্যস্ত। এটা স্টেটসম্যানের ঐতিহ্য ও ট্রেনিং যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিকদের মনঃপুত নয়। কিন্তু কী করা যাবে! এই মুখবন্ধ লেখার প্রয়োজনবোধ করলাম এই কারণে, দৈনিক স্টেটসম্যানের জন্মলগ্নে লিখিতভাবে অঙ্গীকার করেছিলাম, আমরা কোন অবস্থাতেই সত্যের পথ থেকে সরে আসব না। বিহার নির্বাচনের গুরুত্ব বুঝেই পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে আমি সাহস করে ওই লেখায় বলেছিলাম কি কি কারণে মোদি-অমিত শাহর ‘হাইভোল্টেজ’ ঝটিকা প্রচার বিহারীদের মনে দাগ কাটবে না এবং তা ব্যুমেরাং হবে। কিন্তু এর পরদিন সকালে টিভি খুলে যখন নির্বাচনী ফল দেখছিলাম তখন বেশ কয়েকটি চ্যানেল তাদের প্রাথমিক খবরে মোদির দল বিশাল ব্যবধানে জিততে চলেছে বলে তারস্বরে চিৎকার করে এমনভাবে প্রচার করছে যা শুনে আমার মনে খটকা লাগল। তাহলে এতদিনের সৎ সাংবাদিকতা করার অভিজ্ঞতা কি মাঠে মারা যাবে? আমি কি তাহলে বিহারের ভোটারদের মন, মানসিকতা, ভাবাবেগ, আশা-আকাক্সক্ষা ও নাড়ির স্পন্দন সঠিকভাবে বুঝতে পারিনি? দশটার পর থেকে ভোটের ফল যখন নাটকীয়ভাবে বদলে গেল এবং আমার লেখার যথার্থতা প্রমাণিত হতে শুরু করল তখন আমি আমার পেশাদারি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। আমার লেখার মূল সূত্র ছিল বিহারের ভোটারদের মন-মানসিকতা। তাদের মোদি এবং সারা ভারতের মানুষ যতই ‘বিমারু’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক না কেন তাদের রাজনৈতিক পরিণতমনষ্কতা সম্বন্ধে আমার মনে কেন সন্দেহ ছিল না। যার প্রথম পরিচয় পাই আমি সমস্তিপুর ও হাজীপুরের ভোটারদের কাছ থেকে। তাঁরা আমায় টেলিফোনে বললেন, এই নির্বাচনে আমরা বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে নির্বাচিত করছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নয়। তাদের কথা শুনেই আমি বুঝে যাই মোদির ঝড়ো প্রচারের কোন প্রভাব এখানে পড়বে না। আর নীতিশের সুশাসনের কারণে বিহারের বদলে যাওয়ার কথা আমি প্রথমে শুনি গত আগস্ট মাসে ভাইজাগে বসে। এক নামজাদা তেলুগু শিল্পপতির মুখে শুনি নীতিশের সুশাসনের প্রশস্তি। তখনই বুঝতে পারি নীতিশ জোট বিহারের নির্বাচনে জিততে চলেছে। ওই শিল্পপতি প্রায়শই বিহারে যান কর্মী নিয়োগের কারণে। গত এক দশক ধরে তিনি বিহার থেকে অতি নগণ্য পারিশ্রমিকে শ্রমিক পাচ্ছিলেন। এখন যেটা তিনি বর্তমানে পাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে অতি কম খরচে। ওই শিল্পপতির কথায় বিহারে কৃষি এত উন্নতি করেছে এবং সেখানে পরিকাঠামোর কাজ রাজ্য সরকার এমন বিশালভাবে হাতে নিয়েছে যে, বিহারের মজুরি আজ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বিহারীরা এখন নিজের রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে গিয়ে চাকরি করতে প্রস্তুত নয়। ওদের শূন্যস্থান পূরণ করছে মালদা, মুর্শিদাবাদ ও দিনাজপুরের শ্রমিকরা। যারা অন্ধ্রে বিহারীদের চেয়েও কম মজুরিতে কাজ করছে। বিহার নির্বাচনে বিশেষ করে লালুর অভাবনীয় সাফল্যের কারণ হলো তিনি এখনও রাজ্যের যাদবগোষ্ঠীর মুকুটহীন সম্রাট। যারা রাজ্যের জনগোষ্ঠীর ১৬ শতাংশ। মোদি নীতিশ ও লালুকে ‘শয়তান, তান্ত্রিক, জোচ্চোর’ এবং তাদের ‘ডিএনএ’-তে গলদ আছে বলে আক্রমণ করেন। এতে রাজ্যের যাদবগোষ্ঠী ক্ষেপে গিয়ে একাট্টা হয়ে নীতিশ-লালু জোটের পক্ষে ব্লক ভোটিং করে। লালু যাদবদের ব্লক ভোট পাওয়ার জন্যই তার প্রচারে ‘বিহারী’ বনাম ‘বাহারি’ (বাইরের লোক) বিভাজনসূচক খেলার সূত্রপাত ঘটান। এটাও একটি কারণ লালুর রাষ্ট্রীয় জনতা দল নীতিশের দলের চেয়ে ৯টি আসন বেশি পেয়ে একক সর্ববৃহৎ দলের সম্মান পেয়েছে। যাদবরা গোষ্ঠীগতভাবে ব্লক ভোটিংয়ের ফলে রাজ্য বিধানসভায় রেকর্ডসংখ্যক ৬১ জন যাদব বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। যার মধ্যে লালুর দলের ৪২ জন, বাকিরা নীতিশ, কংগ্রেস ও বিজেপির বিধায়ক। অর্থাৎ বিহারে প্রতি চারজন বিধায়কের মধ্যে একজন যাদব। আইন প্রণেতা হিসেবে যাদবদের এই বিশাল উপস্থিতি রাজ্যের অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করেছে। এর মূল কারণ, যাদবরা নিজেদের স্বার্থকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে এবং অন্য জাতিধর্মের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে নানান পদ্ধতিতে। যাদবরা ঝেঁটিয়ে লালুকে ভোট দেয়ার মূল কারণ তারা প্রায় এক দশক বিহারের ক্ষমতার অলিন্দের বাইরে। লালু-রাবড়ির ১৫ বছর রাজত্বে তারা অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল। কিন্তু বিগত এক দশকে নীতিশ জমানায় তারা সেই সুযোগ-সুবিধার ছিটেফোঁটাও পায়নি। আর বিগত লোকসভা নির্বাচনে এক বিরাট অংশ চাকরি পাওয়ার আশায় বিজেপিকে ভোট দেয়। তাদের আরও আশা ছিল প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর কথা রাখবেন। বিশেষ করে বিদেশে রাখা কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে এনে তিনি তাঁর কথামতো সকলের এ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা জমা করবেন। সুতরাং মোদি যখন তাঁর জনধন যোজনা চালু করেন তখন বিহারের যুবকরা, বিশেষ করে যাদবরা ব্যাংকে গিয়ে প্রায়ই খোঁজ নিত মোদি তাদের এ্যাকাউন্টে কোন টাকা জমা করেছেন কিনা। তারা সবাই জীবিতকালে মোদি সরকারের বদান্যতার ফসল ঘরে তুলতে আগ্রহী ছিলেন, মৃত্যুর পরে নয়। কিন্তু যাদবকুল যখন বুঝল ১৫ লাখ টাকা জমা করার প্রতিশ্রুতি ছিল এক নির্বাচনী ভাঁওতা ও ফাঁকা প্রতিশ্রুতি তখন থেকেই তারা মোদিকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু যে মারাত্মক ভুলটি অমিত শাহ করেন তা হলো বিহারীদের মন, মানসিকতা ও ভাবনার কথা না বুঝেই নানা ধরনের জ্ঞানহীন অহেতুক মন্তব্য করে বসেন। যার চূড়ান্ত মাশুল বিজেপিকে দিতে হয়েছে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ের নির্বাচনে। নির্বাচনী প্রচারে অমিত শাহ পাকিস্তান প্রসঙ্গ টেনে এনে বিহারীদের অপমান করেন। ‘নীতিশ-লালু-কংগ্রেস জোট বিহারে জিতলে পাকিস্তানে পটকা ফাটবে’ এই উক্তি বিহারের সর্বস্তরের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে, এমনকি উচ্চবর্ণের মানুষকেও, যারা সম্প্রতি সব নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। তাদের এক বিরাট অংশ রাগে-ক্ষোভে বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মহাজোটকে ভোট দেয়। যে কারণে বিজেপির আসন গত ২০১০ বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে বেশ ভালরকম হ্রাস পায়। গত বিধানসভা নির্বাচনে নীতিশের সঙ্গে আঁতাত করে বিজেপি যেখানে ৯১টি আসন জিতেছিল এবার সেখানে তারা পেয়েছে মাত্র ৫৩টি আসন। এর আরেকটি কারণ হলো, উচ্চবর্ণের ভোটাররা, রাজপুত, ভূমিহার, ব্রাহ্মণ, কায়স্থরা এবার তাদের পুরনো দল কংগ্রেসকে বিশালভাবে সমর্থন দিয়ে ২৭টি আসনে জিতিয়েছে। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় কংগ্রেস যে ২৩টি আসন বেশি পেয়েছে তার পেছনে উচ্চবর্ণের ভোটারদের অবদান রয়েছে। অমিত শাহর পাকিস্তান সম্বন্ধীয় বক্তব্য ও গো-মাংস নিয়ে বিজেপির নির্বাচনী প্রচার দলের ফলে যে এক বিরূপ প্রভাব ফেলে তা বোঝা যায় শেষ ও পঞ্চম রাউন্ডের ফল থেকে। সীমাঞ্চলের ৫৭টি আসনের মধ্যে বিজেপি পায় মাত্র ১১টি এবং মহাজোট পায় ৪৫টি। এই আসনগুলোতে রাজ্যের ১৭ শতাংশের মুসলিম জনগণের একটা বড় অংশের বাস। তারাও মহাজোটের পক্ষে ব্লক ভোটিং করে বিজেপির ভোটবাক্সে ধস নামিয়ে দেয়। ফলে বিজেপির ভোট গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই নির্বাচনে বিজেপির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো হিন্দী গো-বলয়ে মোদি ও বিজেপি তাদের ভুল প্রচার কৌশলের জন্য তারা সাধারণ মানুষের কাছে তাদের আবেদন হারিয়েছে। দেশজুড়ে মোদির কর্তৃত্ব দলের ভেতরে ও বাইরে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। দলের তিন বর্ষীয়ান মার্গদর্শক নেতা নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহর ভ্রান্ত নির্বাচনী কৌশলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এই জুটিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন। গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে মোদি-অমিত শাহ ধর্ম ও হিন্দুত্ববাদকে প্রচারের বাইরে রেখেছিলেন। দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নকে মূল প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু করেছিলেন বলে তাঁরা প্রচুর রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সাফল্য পান। বিজেপির নেতৃত্ব যে বিহারের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন তার নমুনা পাওয়া যায় নির্বাচনী ফল ঘোষণার আগের দিনে তাদের বক্তব্য থেকে। বিহার থেকে নির্বাচিত রবিশঙ্কর প্রসাদের মতো বিজ্ঞ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বুক ফুলিয়ে টিভি চ্যানেলে বলেছিলেন, আমরা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি জনাদেশ পেতে চলেছি। তিনি মোদির জনসভায় যুব সম্প্রদায়ের উপস্থিতিকে ভিত্তি করেই তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। গয়া জেলার রফিগঞ্জের মতো মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় মধ্যরাতে বিশ-পঁচিশ হাজার মানুষ তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য অপেক্ষা করার ঘটনাকে তিনি বিজেপির প্রতি সাধারণ বিহারীদের আস্থার প্রকাশ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু যে অপ্রিয় সত্যটি তিনি বলতে পারেননি তা হলো, অমিত শাহর বক্তৃতা শুনতে ১০০০-১৫০০-এর বেশি মানুষ হাজির না হওয়াটাও বিজেপির ‘বাহারি’ নেতাদের প্রতি বিহারীদের অনাস্থার প্রকাশ। তবু এটা বলতে হয়, বিহারের মানুষের নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগ পর্যন্ত বিজেপির প্রতি আসক্তি ভালমাত্রায় ছিল। বিশেষ করে ১.২৫ লাখ কোটি টাকার বিহার প্যাকেজের ঘোষণার পর তারা চাইছিল বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে নীতিশ জমানার উন্নয়ন প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হবে। তাদের ধারণা ছিল কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার থাকলে এটা ঘটতে বাধ্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদি ও অমিত শাহ অনর্থক বক্তব্য রেখে বিজেপির বাড়া ভাতে জল ঢেলে দেন। বিহার নির্বাচনে বিজেপি বুঝেছে, আগামী বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে সঠিক সহযোগী দল তার পাশে না থাকলে নিজের কোমরের জোরে সাফল্য পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার। কিন্তু বিজেপির বর্তমান নেতৃত্ব যেভাবে বিভাজনের রাজনীতির পথ ধরে এগুচ্ছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে কোন আঞ্চলিক দল বিজেপি জোটে যোগ দিতে চাইবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। আরও যে প্রশ্নটি বিহার বিপর্যয়ের পর বিজেপিকে কুরে কুরে খাবে তা হলো বর্ষীয়ান নেতারা যেভাবে দলের নেতৃত্বের ভুল নীতিকে দায়ী করে তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অনাস্থা প্রদর্শন করেছেন তা দলের মধ্যে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। যে বিষয়গুলো নিয়ে বর্ষীয়ান নেতারা বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন তার সুষ্ঠু ফয়সালা কিভাবে হয় তার দিকে দেশের আঞ্চলিক দলগুলো অতি আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য রাখছে। বিজেপির বর্তমান নেতৃত্ব যদি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে দলকে এক নতুন আশার দিশা দেখাতে পারে তাহলেই আঞ্চলিক দলগুলো বিজেপির সহযোগী হতে চাইবে, নচেত নয়। লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক ও বাংলা দৈনিক স্টেটসম্যানের সম্পাদক
×