ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জ্ঞানীরা বাঁচলে সমাজ বাঁচে

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৯ নভেম্বর ২০১৫

জ্ঞানীরা বাঁচলে সমাজ বাঁচে

খন্দকার মাহ্বুবুল আলম বন্দী মননের চাইতে ‘মুক্ত মনন’ অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী এবং গতিশীল। সেই প্রাচীন অন্ধকার যুগ থেকে আজকের এতটুকু আলোর পথে এগিয়ে আসা সম্ভবপর হয়েছে মুক্তবুদ্ধি চর্চার কারণেই। সেই অতীত থেকে মানব সমাজে মুক্তচিন্তা বা মুক্তবুদ্ধির চর্চা না থাকলে আজ অবধি মানুষ বন্যপশুর স্তরে থেকে যেত। বুদ্ধি-মননের বিকাশের মাধ্যমেই মানুষ পুরনোকে পরিহার করে নতুনের দিকে এগিয়েছে। এভাবে সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতেও সক্ষম হয়েছে। সমাজে মুক্তচিন্তার চর্চা না থাকলে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়বে, এতে কোন সন্দেহ নেই। যে কারণেই বলা হয়েছে ‘গতিতে জীবন- স্থিতিতে মরণ’। মুক্তচিন্তার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়াই হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা করা। যারা মুক্তচিন্তা বা মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে মানুষের জীবনকে যুক্তিবোধ সম্পন্নতায় গতিশীল করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, তাঁরা বারে বারে আক্রান্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিজ্ঞান লেখক ও প্রকৌশলী ড. অভিজিত রায়, রাজীব হায়দার, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নিলাদ্রি নিলয়সহ জাগৃতি প্রকাশনার ফয়সাল আরেফিন দীপনকে সর্বশেষ প্রাণ দিতে হলো। যারা অন্ধকারকে ভালবাসে তারা আলোর পথে কখনও হাঁটতে চায় না; তারাই মুক্তচিন্তার শত্রু। তারা মানবতা বোঝে না। মানবিক মূল্যবোধ তাদের কাছে অর্থহীন। বাঙালী জাতির দীর্ঘ সংগ্রাম আর ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশটিও মুক্তবুদ্ধির ফসল বলা চলে। বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র এই চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ছিল মুক্তচিন্তারই উপাদান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মধ্যে সেই ধারার উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেদিনও যারা তাদের নিজেদের মধ্যে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে অক্ষম ছিলেন, তারাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। তারা সেদিন পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর হয়ে ভিন্নমতাবলম্বী ও স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের হত্যার উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন। সেই মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীরাই আজ মুক্ত মননের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। মুক্তবুদ্ধি আজ হুমকির সম্মুখীন। একের পর এক মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা নির্মমভাবে খুন হয়ে চলেছেন। লেখক-প্রকাশক থেকে শুরু করে শেষাবধি পাঠকরাও হয়ত রেহাই পাবে না। তাহলে সমাজ-দেশ যাচ্ছে কোন্ পথে? যেই সমাজে বা দেশে মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন জ্ঞানীরা জ্ঞানচর্চার অপরাধে (!) আক্রান্ত হয়ে থাকেন, সেই দেশ বা সমাজ বস্তুতান্ত্রিকতায় এগুতে পারে কিনা? কলমের বিরুদ্ধে ছুরি-চাপাতি কেন, কলমের বিরুদ্ধে কলমই গর্জে উঠুক না। পরমতসহিষ্ণুতা হচ্ছে সভ্যতারই উপাদান। সভ্যতার এই উপাদানগুলো মানুষের মধ্যে না থাকলে সেই মানুষকে কিভাবে মানুষ ভাবা যায়! মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে মুক্তবুদ্ধির সম্পর্ক বিদ্যমান। মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা যখন আক্রান্ত হচ্ছে একের পর এক, তা কারও জন্য সুখকর হতে পারে না। কারণ জ্ঞানহীন মানুষ যেমন মূল্যহীন, জ্ঞানশূন্য সমাজও তেমন মূল্যহীন হয়ে পড়ে। বাঙালী সমাজকে মূল্যহীন করতে ’৭১ সালে অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। একথা অনস্বীকার্য যে, জ্ঞানীদের রক্ষা করতে পারলেই সমাজ বাঁচে। এ লক্ষ্যে দেশের আপামর জনগণসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলো আজ ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরী। শুধু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললে চলবে না, এই চেতনাকে মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে মুক্তবুদ্ধির সোপান বেয়ে। হালিশহর, চট্টগ্রাম থেকে
×