ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্যারিসে বোমা ॥ উত্তাল সাগরের নাবিক হাসিনা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১৯ নভেম্বর ২০১৫

প্যারিসে বোমা ॥ উত্তাল সাগরের নাবিক হাসিনা  -স্বদেশ রায়

প্যারিসে বোমা হামলা বা এ ধরনের বোমা হামলা হবে এটা খুব আকস্মিক কিছু ছিল না। পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে যাচ্ছে তাতে এ ঘটনা প্যারিসে না ঘটে জার্মানি, ব্রিটেন এমনকি ওয়াশিংটনেও ঘটতে পারত। এমনকি ভবিষ্যতে অনেক দেশও নিরাপদ নয়। ইউরোপ শুধু নয়; দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, রাশিয়াসহ অনেক দেশে ঘটতে পারে এমন হামলা। বর্তমান পৃথিবী এই বাস্তবতায় এসে দাঁড়িয়েছে। কে এই বাস্তবতায় এনে পৃথিবীকে দাঁড় করিয়েছে তা খুব মোটা দাগে হিসাব করলে হবে না। শুধু রাজনৈতিক কারণে পৃথিবী এখানে আসেনি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কারণ শুধু নয়- পাশাপাশি শিক্ষা ও সংস্কৃতির রূপান্তর এবং অবক্ষয় এমন অনেক কিছু এর সঙ্গে জড়িত। এসব মিলে একটি জটিল অঙ্কে এসে দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। তাই খুব সহজে এ অঙ্কের সমাধান খোঁজার কোন উপায় নেই। অন্যদিকে পৃথিবীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এমনকি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে এমন কোন নেতা নেই যিনি পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। পৃথিবী এমন দুঃসময়ে খুব কমই পড়েছে। কারণ, মধ্যম মানের নেতারাই সমগ্র পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। যে কারণে এ মুহূর্তের পৃথিবীর প্রতিটি সমস্যাই জটিল হচ্ছে। সমাধান দেবার মতো যোগ্যতা নিয়ে কেউ এগিয়ে আসতে পারছে না। পৃথিবী যে কতটা নেতৃত্ব ক্রাইসিসে তা এ মুহূর্তের আমেরিকার আগামী প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থিতার দৌড়ে আলোচিত হিলারি ক্লিনটন। অথচ, সেদেশের ৬২ ভাগ মানুষ মনে করে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় অসততার পরিচয় দিয়েছেন। অসত্য বলেছেন। ৫০ ভাগের ওপর মানুষ মনে করেন- সিনেটর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমনকি ফাস্টলেডি হিসেবে তার কোন সফলতা নেই। অথচ তার কোন বিকল্প পাচ্ছে না ডেমোক্র্যাটরা এখনও। অন্যদিকে রিপাবলিকানদের প্রার্থী ট্রাম্প যে কথা বলছেন, তা আমেরিকার সমাজ ও সংবিধানের মূল চেতনা বিরোধী। কারণ, তা আমেরিকার সমাজের ডাইভারসির বিপরীতে। অন্যদিকে জেব বুশ কী বলতে চান তা তিনি এখনও স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। তাই পৃথিবীর এ মুহূর্তের এ সঙ্কট থেকে মুক্তি পাবার পথ কে খুঁজে বের করবেন তার কোন দিশা কিন্তু নেই। অনেকটা সান্ত¡না হিসেবে বলা হয়, মানুষের ভেতর থেকে মানুষের প্রয়োজনে নেতা বের হয়ে আসবেন। কিন্তু একে কি সান্ত¡নার বেশি কিছু বলা যায়? কারণ, কমিউনিস্ট বিপ্লবেও কিন্তু মানুষকে নেতৃত্বের জন্য হাত পাততে হয়েছিল লেনিন বা মাও-এর মতো নেতার কাছে। অর্থাৎ ব্যক্তির কাছে। যে ব্যক্তি বড় মাপের নেতা। যাক! তবু আশা থাক, মানুষের ভেতর থেকে নেতৃত্ব আসুক। পৃথিবী এখন যে জটিলতর রোগাক্রান্ত সে রোগ থেকে মুক্তি পাক। পৃথিবীর এই গভীরতর অসুখে কারা মারা যাচ্ছেন? কী ক্ষতি হচ্ছে পৃথিবীর? প্যারিসের বোমা হামলায় ১২৮ জন নিহত হয়েছেন। প্যারিসের ওই বোমা হামলার পর গত কদিনে সারা পৃথিবীর নানান পত্র-পত্রিকা, ব্লগ ও অন্যান্য সোশ্যাল ফোরামে প্রায় সারাক্ষণ চোখ রাখার চেষ্টা করেছি। এর ভেতর দিয়ে বোমা হামলাকারী, ঘটনার বিবরণ নানানভাবে জেনেছি। কিন্তু কিছু পত্র-পত্রিকা ও সোশ্যাল ফোরামের মাধ্যমে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য জানতে পেরেছি তা হলো মৃত ৮০ জনের পরিচিতদের বক্তব্য। যারা আরও বেশি এভাবে তথ্যের জগতে ঘুরতে পেরেছেন তারা আরও বেশিজন মৃতের পরিচিতের বক্তব্য পেয়েছেন। প্যারিসে নিহত এই আশি জনকে যারা চেনেন তাদের দেয়া নানান তথ্যের ভেতর একটি হলো, এরা সকলে তরুণ ও প্রগতিশীল। অর্থাৎ আগামী দিনে প্রগতির নেতৃত্ব দিতে পারত এমন আশি জন নিহত হয়েছেন। এমনকি এমনও তো হতে পারত এই ৮০ জনের ভেতর থেকে একজন রোম্যাঁ রোঁলা, একজন বেরলিওজ, একজন লুলি বা একজন মোপাঁসাকে পেতে পারত পৃথিবী। পৃথিবীর এ মুহূর্তের এ গভীরতর অসুখে সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে এটাই- এ অসুখের ভেতর দিয়ে নিহত হচ্ছেন প্রগতিশীলরা, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আধুনিক শিক্ষা। ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশ অবধি সর্বত্র নিহত হচ্ছেন প্রগতিশীলরা। সর্বত্র নিহত হচ্ছেন যারা আগামী পৃথিবীকে এগিয়ে নেবে, তারাই। আমরা একজন মালালাকে জানি। একজন মালালার মনের অভিব্যক্তি জানি। কিন্তু পৃথিবী কি খোঁজ নিতে পেরেছে নাইজিরিয়ার জঙ্গলে যে সাড়ে তিন শ’ মালালাকে বোকোহারামরা আটকে রেখেছিল, আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের অপরাধে তাদেরকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছিল। ধর্ষণের ফলে রক্তক্ষরণে অনেকে মারা গেছে। নাইজিরিয়ার ওই কিশোরী মালালাদের মনের ভাষা, আধুনিকতাকে এগিয়ে নেবার জন্য তাদের মনের আকুতির খোঁজ কি এ পৃথিবী নিতে পেরেছে! বাংলাদেশে যারা মারা যাচ্ছেন তাদেরকে কুৎসিতভাবে চিহ্নিত করছেন একটি শ্রেণী। অন্যদিকে সমাজের অনেক উঁচু স্তরে যারা, যাদের দায়িত্ব সমাজ-প্রগতিকে এগিয়ে নেয়া, তারা অর্থবিত্ত রোজগারের স্বার্থে এদের প্রতি বিরূপ ভাষা ব্যবহার করছেন। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের তথাকথিত নোংরা ভোটের রাজনীতিরও শিকার হচ্ছে এই প্রগতি। বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে এই কলামে উল্লেখ করেছি, পৃথিবীর এই গভীরতর অসুখে আক্রান্ত শুধু প্যারিসে যারা বোমা মেরেছে তারা নয়, এই গভীর রোগে আক্রান্ত পৃথিবীর সবাই। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রগতি নামক পাখিটিকে শরবিদ্ধ করছে। এই অবস্থার ভেতর বাংলাদেশ নামক ছোট্ট একটি দেশকে পাড়ি দিতে হচ্ছে এক ভয়াবহ উত্তাল সমুদ্র। কারণ, এ দেশের পাশে আছে হিন্দুত্বের নামে অন্ধত্ব। কিন্তু তারপরও তাদের আঙুল অনেক বেশি মুসলমানিত্বের নামে যে অন্ধত্ব গ্রাস করছে তার প্রতি। আবার পাশের আরেক শক্তি বৌদ্ধত্বের নামে তীর মারছে মুসলমানদের। ঠিক তেমনি ক্রিশ্চিয়ানিটির নামে এক মহা-অন্ধত্ব গ্রাস করেছে অনেক আগের থেকে। যার প্রথম উদাহরণ- বুশ ইরাক যুদ্ধকে বলেছিলেন ‘ক্রুসেড’। তাই- কী পশ্চিমা আঙুল, কী প্রতিবেশীদের আঙুল সবই কিন্তু নির্দেশিত হচ্ছে বাংলাদেশের মুসলমানিত্বের নামে যে এক ধরনের অন্ধত্ব কিছু লোককে গ্রাস করেছে তাদের প্রতি শুধু নয়, সমগ্র দেশটির প্রতি। এমনি একটি কঠিন সময়ে বাংলাদেশে- যেখানে মানুষের মনোজগতের একাংশ ধর্ম দ্বারা নির্দেশিত, আরেক অংশ সংস্কৃতি দ্বারা নির্দেশিত। আবার সামাজিকতায়ও ধর্ম এবং সংস্কৃতির উপস্থিতি বিশালভাবে। সংস্কৃতি ও ধর্মীয় উৎসব মানুষকে আনন্দিত করে ও মানবিক করে। অন্যদিকে প্রগতিশীল, আর্গুমেনটেটিভ সমাজ হিসেবে বাঙালী এই ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলন ঘটিয়ে সব সময়ই সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে আধুনিকতার পথ ধরে। এমন একটি সমাজে এ মুহূর্তে বর্তমান বিশ্বের উন্মাদনার সুযোগ নিয়ে প্রগতির পথ বন্ধ করতে নেমে পড়েছে একটি শ্রেণী। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে, এমনকি ফ্রান্সে যে শক্তি প্রগতির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ করেছে, প্রগতিশীলদের হত্যা করছে এদের সঙ্গে বাংলাদেশের এই শক্তির চরিত্রগত পার্থক্য আছে। বাংলাদেশের এই শক্তি মূলত চায় -এ সন্ত্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে। কারণ, বাংলাদেশ একটি ট্রানজিট কান্ট্রি। এ ধরনের দেশের ক্ষমতা দখল করতে পারলে অস্ত্র, মাদক, নারীসহ আন্তর্জাতিক নানান চোরাচালানের পথ তৈরি করা যায়; যা খালেদা ও নিজামীর আমলে তারেক ও নিজামীরা করেছিল। অঢেল অর্থ তারা উপার্জন করে। যে অর্থ এখনও ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এই অর্থ উপার্জনই তাদের মূল উদ্দেশ্য। আর এ কাজে তারা ব্যবহার করছে ধর্মীয় উন্মাদনা। পৃথিবীর একটা বড় অংশে যেখানে ক্রিশ্চিয়ানিটি, হিন্দুত্ব, বৌদ্ধত্ব দ্বারা মুসলিমরা নানানভাবে অপমানিত হচ্ছে সে সময়ে ৯২ ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি দেশে এই অপমানের ক্ষোভকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা খুবই সহজ। বাংলাদেশ যদি এ মুহূর্তে মিডিওকার নেতৃত্বের হাতে থাকত এবং যদি বাঙালী সংস্কৃতির স্বয়ম্ভু ক্ষমতা না থাকত তাহলে এতদিনে বাংলাদেশ একটি রক্তাক্ত ভূমি হতো। কিন্তু বাঙালী সংস্কৃতির স্বয়ম্ভু শক্তি ও শেখ হাসিনার অপরিসীম সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্ব এই উত্তাল পৃথিবীতে বাংলাদেশকে রক্তাক্ত ভূমি হওয়া থেকে শুধু রক্ষা করেনি; বিচারের মাধ্যমে একের পর এক রাজনীতির ও মানবিক পৃথিবীর নষ্ট কীটদের নিশ্চিহ্ন করছেন শেখ হাসিনা। একটির পর একটি বিজয় তিনি বাঙালীর জন্য এনে দিচ্ছেন। তাও একক শক্তিতে, নিঃসঙ্গ শেরপা তিনি। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা, রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনা এ মূহূর্তে যে যুদ্ধ করছেন তা একটি সমাজের প্রগতি ও আধুনিকতা রক্ষার যুদ্ধ। আগামীদিনের প্রগতিশীলদের বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ। তাই এ যুদ্ধে তিনি রাজনীতিবিদদের সকলকে পাশে পাবেন না। কারণ, সব রাজনীতিক সমাজ ও প্রগতিকে এগিয়ে নেবার কাজ করার যোগ্যতা রাখেন না। তাই এ যুদ্ধে শেখ হাসিনার পাশে যেতে হবে এই সমাজের প্রগতিশীল শক্তি ও আধুনিক তরুণ সমাজকে। শেখ হাসিনাকেও তাই তাঁর রাজনীতির পাশাপাশি এ ফ্রন্টটিকে বড় করতে হবে। আর সেখানে সুবিধাবাদী প্রগতিশীল নয়, সংস্কৃতি ব্যবসায়ী নয়: যারা বুকে প্রগতিকে ধারণ করেন, যারা পিপিলিকার মতো দল বেঁধে চলেন না, নিজের প্রজ্ঞা দ্বারা সিংহের মতো পরিচালিত হন তাদেরকে সেখানে নিয়ে আসতে হবে। আর নিয়ে আসতে হবে সেসব তরুণ প্রাণকে যাদের নতুন বোধ ও নতুন রক্ত আগামী প্রগতি- আধুনিক পৃথিবীর স্রষ্টা। [email protected]
×