ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী

সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ চাই

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৯ নভেম্বর ২০১৫

সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ চাই

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়েই আজ এ পর্যায়ে এসেছে। যারা সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এদের ধরিয়ে দিতে হবে এবং শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। দেশের জনগণ সচেতন হলেই আমরা দেশকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এগিয়ে নিতে পারব। শান্তিপূর্ণ দেশ গড়ে তোলাই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। তাই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। গণতন্ত্রের সুফল পেতে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে যাতে অনির্বাচিত বা অসাংবিধানিক কোন সরকার বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়েছে। তিনি বলেন, সংবিধানে ৭ (ক) অনুচ্ছেদ সন্নিবেশ করার মাধ্যমে অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করে এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দ-ের বিধান করা হয়েছে। বুধবার স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তরপর্বে একাধিক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। মূল ভূখ-ের মানুষ হিসেবে বিলুপ্ত ছিটমহল বাসিন্দার উন্নয়নে সরকারের সদিচ্ছার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে ছিটমহলবাসী বিচ্ছিন্ন ছিল। তাদের আমরা বিচ্ছিন্ন থাকতে দিতে চাই না। তারা এখন আমাদের মূল ভূখ-ের অংশ। সে হিসেবেই তাদের উন্নয়নের পদক্ষেপগুলো আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী মোঃ সেলিমের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে তার সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরে সংসদ নেতাকে বলেন, এ লক্ষ্যে নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত গঠিত সন্ত্রাস দমন কমিটির সদস্য সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের উন্নয়নে পরিকল্পনা আমরা যতই নেই না কেন তা বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা দরকার। আর সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ দমনে সর্বাগ্রে দেশের জনগণকে সচেতন করা দরকার। জনগণের এই সচেতনতা সৃষ্টি হলেই দেশকে আমরা শান্তিপূর্ণ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। তিনি বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলার মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে দেশকে যেমন রক্ষার কৌশল নেয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা প্রদানেও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের সম্পূরক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় তার সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবেলায় নিজস্ব অর্থায়নে ট্রাস্ট ফান্ড গড়ে তুলেছে। জলবায়ু মোকাবেলায় ১৩৫টি পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করছি। এক্ষেত্রে আমরা বিশ্বের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ জন্ম থেকেই পরিবেশ সচেতন। আর আওয়ামী লীগই দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল যাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক রয়েছে। সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগের মাধ্যমে প্রতিবছর পহেলা আষাঢ় সারাদেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বিশাল সমুদ্রসীমা থেকে ভূমি উত্তোলন করে কীভাবে আমাদের স্থলসীমানা বাড়ানো যায়, এসব স্থলসীমানা কৃষি ও শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করা যায়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ছিটমহল দাসিয়ারছড়াকে আলাদা ইউনিয়ন পরিষদ গঠনের জন্য বিরোধী দলের চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরীর দাবি নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এখন বাজেট থেকে বরাদ্দ দিয়ে ছিটমহলের উন্নয়ন করছি। কিন্তু আলাদা ইউনিয়ন করা হলে সেই বরাদ্দ সম্ভব নয়। তিনি বলেন, দাসিয়ারছড়ায় জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে ৭ হাজার। এই অল্পসংখ্যক মানুষ নিয়ে পৃথক ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করা যুক্তিযুক্ত হবে না। আমরা আর ছিটমহলবাসীকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই না, আমাদের মূল ভূখ-ের অংশ হয়েই থাকবে। বিরোধী দলের নেতার কাছ থেকে ছিটমহলে দুর্বৃত্তদের তালিকা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী ॥ বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ বহু যুগ পর ছিটমহলকে বাংলাদেশের ভূখ-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। একইসঙ্গে ওই ছিটমহলে কিছু দুর্বৃত্ত ঢুকে পড়েছে কিনা, সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জানতে চান। জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে ছিটমহলবাসী কোন দেশের সম্পদ ছিল না। তারা এতদিন বিচ্ছিন্ন ছিল। তখন সেখানে কিছু দুর্বৃত্ত বা সন্ত্রাসী থাকলেও থাকতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিলুপ্ত ছিটমহলের সেই অবস্থা এখন পাল্টে গেছে। সেখান থেকে এখন দুর্র্বৃত্তরা কোথায় পালিয়ে গেল জানি না। তবে বিরোধী দলের নেতার (রওশন এরশাদ) কাছে বিলুপ্ত ছিটমহলে দুর্বৃত্ত বা সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে কোন তথ্য বা তালিকা থাকলে আমাদের দিয়ে সহযোগিতা করুন। তালিকা পেলে আমরা দুর্বৃত্তদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে পারব। আমি বিরোধী দলের নেতাকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব আরও দীর্ঘায়িত করার ব্যাপারে বিরোধী দলের নেতার দাবির জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্কুল জীবনেও এত জোরে জোরে বড় প্রশ্নের উত্তর পড়িনি। এত বড় লম্বা প্রশ্নের উত্তর এ কারণেই সংসদে পড়ে শোনাই, যাতে দেশের মানুষ বুঝতে পারে: এ সংসদ ও সরকার তাদের কল্যাণে কি কি কাজ করে যাচ্ছে। আর অতীতের যে কোন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে আমিই সবচেয়ে বেশি সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থাকি, সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করি। সরকারী কাজে ব্যস্ত থাকলেও নিজ কার্যালয়ে বসে সংসদীয় কার্যক্রম শুনি। ছিটমহলে ২শ’ কোটি টাকা প্রতীকী বরাদ্দ ॥ জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ধারাবাহিকতায় ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় হওয়ায় ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের পুরাতন সমস্যা সমাধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ছিটমহলবাসীর পুনর্বাসন এবং তাদের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে অর্থ বিভাগের বাজেটে প্রতীকী বরাদ্দ হিসাবে ছিটমহলের উন্নয়নের জন্য ২শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী এ অর্থ ছাড় দেয়া হবে। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফারাজীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, জাতিসংঘের সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। এটাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়ে এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সরকার কার্যকর প্রয়োগ ঘটাবে। এসডিজি ফ্রেমওয়ার্ককে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বর্তমান সরকার ২০১৬-২০২০ মেয়াদী নতুন সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখল রাষ্ট্রদ্রোহিতা ॥ জাসদের সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রাম, লাখো মানুষের জীবন ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যখন বঙ্গবন্ধু উন্নয়নের সোপানের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। দীর্ঘদিন ধরে চলে সামরিক শাসন। তিনি বলেন, ১৯৮১ সালে আমি দেশে ফিরি। আওয়ামী লীগ সর্বসম্মতভাবে আমাকে সভাপতি নির্বাচন করে। শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সংসদ নেতা বলেন, বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনে যাতে অনির্বাচিত বা অসাংবিধানিক কোন সরকার বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে। সংবিধানের ৭ (ক) ও ৭ (খ) অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১- এ এই দুটি ধারা সন্নিবেশ করার মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভীতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ৭(ক) অনুচ্ছেদ সন্নিবেশ করার মাধ্যমে অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করে এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দ-ের বিধান করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য এবং সংসদীয় পদ্ধতিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের লক্ষ্যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। সংসদীয় পদ্ধতিকে আরও সুসংহত করার লক্ষ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীন মত প্রকাশে পূর্ণ সহযোগিতা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভীতকে মজবুত করে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত করব ইনশাল্লাহ।
×