ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

‘বিডিএফ’ সভা ॥ পুরনো কথা আবার শুনলাম

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২০ নভেম্বর ২০১৫

‘বিডিএফ’ সভা ॥ পুরনো কথা আবার শুনলাম

উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আগে সভা হতো প্যারিসে। প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার আগে অর্থমন্ত্রীরা যেতেন সেই সভায়। আসতেন ভাল-মন্দ খবর নিয়ে। এরপর বাজেটের ভাগ্য নির্ধারিত হতো। এখন এমন হচ্ছে না। এখন সভা হয় ঢাকাতে। সর্বশেষ সভাটি হয়েছিল ২০১০ সালে। পাঁচ বছর পর এবার ঢাকায় বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে (বিডিএফ) আবার বৈঠক হয়েছে। সভাটি শেষ হয়েছে মঙ্গলবার। সভাশেষে যৌথভাবে ঘোষণা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে দুটো পরিবর্তন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হয়েছে অনেক আগেই, এমনকি ২০১৬-২০ সালের জন্য তৈরি সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও তৈরি হয়ে গেছে বেশ আগেই। এই অর্থে বলা যায় আলাপ করে, তাদের সম্মতি নিয়ে বাজেট ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি হয়নিÑ যা আগে ছিল একটা অলিখিত রীতি। এখন হচ্ছে আলোচনা। বাংলাদেশ তার করণীয় কাজ কী তা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে উত্থাপন করেছে। যুক্তি-তর্ক হয়েছে, বিতর্ক হয়েছেÑ আমরা আমাদের কথা বলেছি, তারা তাদের মতামত দিয়েছে, পরামর্শ দিয়েছে। এটা একটা ভাল দিক। আরেকটি বৈশিষ্ট্য এবারের সভায় দেখা গেলÑ আর সেটি হচ্ছে প্রথমবারের মতো ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ (এআইআইবি)Ñ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে বৈঠকে যোগদান করল। আপাতত এই ব্যাংকটি কোন বিকল্প অর্থায়নের উৎস না হলেও একটা পরিপূরক প্রতিষ্ঠান হতে পারবে বলে মনে হয়। আরেকটি কথা বলা দরকার, সভাটি হয়েছে দুটো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে। দেশীয়ভাবে দেখা যাচ্ছে, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কিছুটা শক্তিশালী, সুসংহত এবং স্থিতিশীল। বিগত ৫-৬ বছর যাবত বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে প্রশংসনীয় অর্জন দেখিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর ছয়-সাড়ে ছয় শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি পাচ্ছে যা প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় সন্তোষজনক। দ্বিতীয়ত, দেশের কৃষি খাত যথেষ্ট অগ্রগামী হয়েছে। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটি আর আমদানি করতে হয় না। বিগত ৪৩-৪৪ বছরে চালের উৎপাদন সাড়ে তিনগুণের চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও গম আমদানি করতে হচ্ছে যা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের লক্ষণ। মাছ উৎপাদন, মাংস উৎপাদন ও শাক-সবজি উৎপাদনে আমাদের সাফল্য আছে। দুধ উৎপাদন ও ফলমূলেও বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। আমদানি ও রফতানি ব্যবসা মোটামুটিভাবে অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে। উত্থান-পতন আছে, তবে গড়ে অগ্রগতি মোটামুটি সন্তোষজনক। রেমিটেন্সেও প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ স্থিতিশীল এবং সেটা অনেকদিন ধরে। অর্থনীতির এই মৌলিক উপাদানগুলো যখন অনুকূলে তখন এমন একটা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হলো তা মোটেই ভাল নয়। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন ইত্যাদি উন্নত দেশে মন্দা অব্যাহত রয়েছে। মন্দাভাব কেটে যাবে বলে অনুমান করা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। চীনের নতুন মন্দা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে কম। তেলের মূল্য সর্বনিম্ন। এতে সৌদি আরব, ইরাক, ইরানসহ রাশিয়া ইত্যাদি তেল উৎপাদনকারী দেশ ক্ষতির সম্মুখীন। এতে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জটিলতর হচ্ছে। ভারতের অর্থনীতির অবস্থাও পরিষ্কার নয়। একবার ভাল দেখালেও পরেই খবর হয় অন্যরকম। এদিকে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে নতুনতর দুশ্চিন্তার আবির্ভাব ঘটেছে। সিরিয়া পরিস্থিতির কারণে লাখ লাখ শরণার্থী ইউরোপে গিয়ে হাজির হয়েছে। মন্দার ওপর বাড়তি বোঝা। ঘটেছে প্যারিসে অমানবিক ঘটনা। সারাবিশ্ব এখন তটস্থ বলা যায়। এখন ‘শীতল যুদ্ধ’ (কোল্ড ওয়ার) নেই। কিন্তু এখন দেশে দেশে নতুন নতুন উৎপাত। জঙ্গীবাদ সভ্যতাকে গলা টিপে ধরেছে। উন্নয়নের পাশাপাশি এসব চলছে বিশ্বময়, বাংলাদেশেও আমরা শান্তিতে নেই। এমন পরিস্থিতিতেই ‘বিডিএফ’-এর সভা ঢাকায়। শুনেছিলাম সভায় কেউ কোন প্রতিশ্রুতি দেবে না। সহযোগীরা কথা শুনবে, পরামর্শ দেবে। কিন্তু দেখা গেল কেউ কেউ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অর্থের। যেমন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। এরা ৫০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের কথা বলেছে তিন বছরের জন্য। এটা সুখবর আমাদের জন্য। কিন্তু এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি যেমন দরকার তেমনি দরকার প্রতিশ্রুত সাহায্য ব্যবহার। দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে অব্যবহৃত সাহায্যের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার যা ৮০ টাকা দরে হয় এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ভাবা যায়! আমরা যখন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে সাহায্য চাইছি তখন আমাদের হাতেই রয়েছে এত বিপুল অঙ্কের টাকা যা অব্যবহৃত। এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। বার বার আমরা এ সম্পর্কে আলোচনা করি, কিন্তু দুর্ভাগা দেশে এর কোন সমাধান হয় না। আমলাতন্ত্র এমন এক জিনিস যা এই সমস্যার কোন সমাধান করে না। অন্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করলে বোঝা যায়, বর্তমান বৈঠকটিতে এমন কোন বিষয় আলোচিত হয়নি যা নতুন। কাগজে দেখলাম মোট সাতটি বিষয়ের ওপর আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, সুশাসন, স্বাস্থ্য ও মানসম্মত শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা ও লিঙ্গ সমতা। এগুলো এমন কোন বিষয় নয় যা নতুনভাবে আলোচনা করতে হবে। তবে যে কথাটি বলা দরকার তা হচ্ছে মুখে এক কথা, কাজে আরেক কথা বললে তো বড়ই মুশকিল হয়। যেমন মানসম্মত স্বাস্থ্য ও মানসম্মত শিক্ষা। এ দুটো মানুষের মৌলিক অধিকার। এখানে বরাদ্দ থাকা দরকার পর্যাপ্ত অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই দুই খাতে শতাংশের হিসাবে বিগত পাঁচ বছর যাবত সরকার বরাদ্দ কমিয়ে যাচ্ছে। এটা তো কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ হ্রাস করে কিভাবে মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চয়তা দেয়া হবে এই প্রশ্নটি বার বার আমার মনে জাগে। ভাবা যাক কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার কথা। এ নিয়ে তো বিতর্কের কিছু নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঘাটতি আমাদের পুষ্টিতে। পুষ্টির নিশ্চয়তা না দিতে পারলে খাদ্য নিরাপত্তা আসবে কোত্থেকে? গুদামে ১৫-২০ লাখ টন খাদ্যশস্য থাকা আর সুষম খাদ্যের অভাব দুটো চলছে সমান্তরালভাবে। এসব সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা জানেন, জানেন কর্মকর্তারা। কিন্তু এর কোন সুরাহা হচ্ছে না। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় লিখে রেখে তো সমস্যার সমাধান হবে না। যেমন ধরা যাক বিনিয়োগের কথা। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে হবে আমাদের। চার শতাংশ থেকে ছয়-সাড়ে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে আমাদের লেগেছে ৪০ বছর। আর পাঁচ বছরে আমরা করতে চাই ৮ শতাংশ। চার থেকে পাঁচ করা যত সহজ, ছয় থেকে আট করা তত সহজ নয়। দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন যাবত বিনিয়োগে মন্থরতা। সঞ্চয়েও রয়েছে মন্থরতা। এই দুটো খাতে আমাদের পারফর্মেন্স খুব খারাপ অথচ বিনিয়োগ ছাড়া ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। বড় কথা যে, বিদেশীদের আমরা রোডশো করে, বৈঠক করে ডাকছি বিনিয়োগ করতে, সেই বিদেশীরা কেন বাংলাদেশে আসবে? যদি স্বদেশীরা ভেগে যেতে চায় বিদেশে বিনিয়োগ করতে তাহলে বিদেশীরা কেন আসবে? শোনা যায়, স্বদেশী বিনিয়োগকারীদের অনেকের প্রচুর টাকা বিদেশে? কিভাবে? এত বড় কঠিন আইন থাকতে কিভাবে তারা বিদেশে টাকা নিয়ে যায়? সেসব দেশে কী ‘মানিলন্ডারিং প্রিভেনশন আইন’ নেই? সন্ত্রাস দমনের নামে আইন করে দেশের ভেতরে দশ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেয়া এবং উত্তোলন করাকে কঠিন করা হয়েছে। এমনকি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক আছে কিনা, তাও ঘোষণা দিতে হয়। এসব কারণে বাংলাদেশের বহু লোক বিদেশে টাকা পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে অথচ এখন জানা যাচ্ছে ভিন্ন কথা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, ‘আইএস’ জাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে ২০টি দেশ অর্থ সাহায্য দেয়। এর মধ্যে উন্নত দেশগুলোও আছে। খবর ছাপা হচ্ছে এসব সংগঠনের জন্মদাতা খোদ আমেরিকাসহ অনেক উন্নত দেশ। তাহলে কী দাঁড়াল? যারা সন্ত্রাসে টাকা যোগায় তারাই আমাদের বলে সন্ত্রাস দমনের জন্য ‘মানিলন্ডারিং’ প্রিভেনশন আইন’ করতে। অদ্ভুত বিচার! আরও আশ্চর্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঐ সমস্ত দেশ যা বলে তাই করে। দেশ থেকে প্রকারান্তরে টাকা পাচারে সাহায্য করছে। আর আমরা ভুগছি বিনিয়োগ সঙ্কটে। যাদের টাকা আছে তারা ভয়ে বিনিয়োগ করে না। এই সমস্যার সমাধান কী? লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×