ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লিটন আব্বাস

ঘুরে এলাম বাঘা যতীনের আত্মবলিদান ভূমি

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২০ নভেম্বর ২০১৫

ঘুরে এলাম বাঘা যতীনের আত্মবলিদান ভূমি

ভারতের উড়িষ্যার বুড়িবালাম নদীর তীরে বিপ্লবী বাঘা যতীন মৃত্যুশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বেনাপোল সীমান্ত পার হতেই অভ্যর্থনা শুরু। ফুলের তোড়া দিয়ে আমাদের বরণ করা হয়েছিল। আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য কলকাতা থেকে ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল এ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজের পক্ষ থেকে লেখক অর্ণব নাগ বর্ডারে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন দুটো জিপ নিয়ে। জিপে চড়ে গেলাম বারাসাতের বামনগাছির হোটেল অর্কিডে। সেখানে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিলাম সফরে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা এটিএম আবুর মনছুর মজনু, খান জালাল উদ্দিন, আ. হক, মো. কামরুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, হোসনেয়ারা, মেরী, হামিদুল ইসলাম, রাশেদ খান মেনন, আ. লতিফ এবং ঢাকা থেকে আগে থেকেই এসেই অপেক্ষা করা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির রুবেল ও পরাগ। বাংলাদেশের ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দলের প্রধান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার কবির ও বাঘা যতীন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব কাজী মুকুল আগে থেকেই কলকাতায় আমাদের জন অপেক্ষা করে ছিলেন। দমদম এয়ারপোর্টের পাশে বিগবাজারের উল্টোদিকে হোটেল অতিথি ইন এ আমাদের থাকবার বন্দোবস্ত ছিল। আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানে। অনেক অভিজ্ঞতা, মজার রাবরী-তুবড়ি, মান অভিমান মিলিয়ে সময়টা কেটেছে বেশ। আমাদের বারোজনের জন্য ট্রাভেল বাস এবং শাহরিয়ার কবির ও কাজী মুকুলসহ কলকাতার কয়েকজনকে নিয়ে প্রাইভেট গাড়ি ছুটে চলে বুড়িবালামের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে থাকা অর্ণব নাগ ও স্নেহাংশু মমতার ময়দা মিশিয়ে সবকিছু দেখভাল করছিলেন। ন্যাশনাল হাইওয়ে দেখার মতো মসৃণ ধবধবে। সিফন চওড়া বুক পেতে যেন শুয়ে আছে শুধু গাড়ি চলার অপেক্ষায়। হোটেল এক্সপ্রেস ফুড প্লাজায় ছিল নাস্তার বন্দোবস্ত। এক্সপ্রেস ফুড প্লাজাটা দেখতে একবারে ট্রেনের মতো। চিকমিকে ধনীদের প্রাডোর মতো সুন্দর কমনীয় রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে। সেখানে আলু পরোটা, সবজি, অমলেট, চা পান শেষে আবার যাত্রা শুরু । ড্রাইভার সাহেব চুপচাপ। সাড়ে তিন শ’ কিলোমিটার যাওয়া এবং আসার পথে একটা কথাও বলেনি সে। কোন ওভার টেকিং নেই। বাসের মধ্যে আমরা যে যার মতো আড্ডা দিতে থাকি। কেউবা বাইরের দৃশ্য মুগ্ধচোখে অবগাহন করতে থাকে। আমরা যখন বালাশোর শহরের প্রবেশ করি, দেখতে পাই বেশ কয়েকটি তোরণ, বিলবোর্ড, ফ্লাগ সবই বাঘা যতীন মৃত্যুশতবার্ষিকী ঘিরে। বাস থেকে থেকে নেমে যাই ফকির মোহন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফকির মোহন উড়িষ্যার একজন প্রখ্যাত লেখক ও কবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউজে পৌঁছাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরা আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। গেস্ট হাউজের রুমে আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে সোজা চিত্রনাট্য মোতাবেক চলে গেলাম বিজনেস পার্ক হোটেলে। সেখানে লাঞ্চ সেরে চলে গেলাম বালাশোরের মহাত্মা গান্ধী সদনে অনুষ্ঠিত মূল অনুষ্ঠানে। মূল তোরণ দিয়ে ঢোকার সময় আমাদের অর্ভ্যথনা জানান অরিন্দম মুখার্জী। তার সঙ্গে আমাদের পূর্ব পরিচয় ছিল। গতবছর কয়ায় অনুষ্ঠিত হওয়া ৯৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি ছিলেন এবং দুই বাংলারযৌথ আয়োজনে এবারের ২ তারিখের অনুষ্ঠানেও এসেছিলেন ১৪ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধি নিয়ে। তার কাছ থেকে পার হতেই অপেক্ষা করা কয়েক হাজার দর্শকের করতালি আর বিনয়ী জোড়াহাতের সম্মান জানানোর নান্দনিকতা বাংলাদেশী প্রতিনিধি দলের প্রত্যেকের হৃদয়ে আনন্দের বান বইয়ে দেয়। পার্শ্ব মঞ্চে আমাদের ঠাঁই হলো। মূল মঞ্চে প্রধান অতিথির আসনে বসেন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। অতিথি হিসাবে মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন শাহরিয়ার কবির, বাঘা যতীন পৌত্র ইন্দু জ্যোতি মুখোপাধ্যায়, বালাশোর জেলা প্রশাসক সনাতন মল্লিক, কলকাতা চারুচন্দ্র কলেজের অধ্যাপক বিমল শঙ্কর, দুইবাংলায় বাঘা যতীন মৃত্যুশত বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানের অন্যতম রূপায়ক ইন্সটিটিউট অব সোস্যাল এ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ, ভারতের সম্পাদক শ্রী অরিনদম মুখার্জী প্রমুখ। প্রায় আড়াই হাজার দর্শকদের উপস্থিতি সেখানকার স্থানীয় এমএল এ, প্রাক্তন মন্ত্রী, বিশিষ্টজন, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষকসহ সুধীমহলের আনাগোনায় পুরো অনুষ্ঠান অন্যরকম অনুভূতিতে বাঙময় হয়ে ওঠে। আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শন করে স্থানীয় শিল্পীরা। উড়িয়া ভাষায় সঙ্গীত অনেকটা বাংলা ভাষার মতই প্রাঞ্জল ও রিদমিক। অনেকই বলেন উড়িয়া আর বাংলা ভাষা হলো ভাই-বোন। অনুষ্ঠান শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার বেরিয়ে পড়া ঐতিহাসিক কাপ্তিপোদার চষাখ- জঙ্গলে, যেথায় বিপ্লবীর ইহধাম। বালাশোর শহর থেকে অনুমান ২০ কিলোমিটারের মতো পথে আমাদের ছুটলাম ওই জঙ্গলের উদ্দেশে। সেই ঐতিহাসিক জঙ্গল দেখে শিহরিত হলাম। ব্রিটিশ বিরোধী যুগান্তরের নেতা, ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য সন্তান বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন) ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর গোধূলিলগ্নে উড়িষ্যার বালাশোরের কাপ্তিপোদার চষাখ- জঙ্গলে চারকিশোর মাদারীপুরের চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী, মনোরঞ্জন সেন গুপ্ত,, নরেন্দ্র নাথ দাস গুপ্ত (নীরেন) ও কুষ্টিয়ার যতীন পাল (জোতিষ)-এর সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি এবং সেনাপ্রধান ট্রেগার্ট বাহিনীর কয়েকহাজার সৈন্যের সঙ্গে লড়াই করেন আড়াইঘণ্টা মতান্তরে সাড়ে তিনঘণ্টা ব্যাপী। ঘটনাস্থলে চিত্তপ্রিয় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। বাঘা যতীন গুলিবিদ্ধ হন এবং অপর তিন কিশোর ধরা পড়েন। বাঘা যতীন পরদিন ১০ সেপ্টেম্বর বালাশোরের সামরিক হাসপাতালে ইহলোক ত্যাগ করেন। ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর মনোরঞ্জন ও নীরেনের ফাঁসি হয়। জ্যোতিষ পালকে আন্দামান দীপে নির্বাসন দিয়ে পরে নির্যাতন করলে পাগল হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পুরো জঙ্গল ঘুরলাম। সেই ঐতিহাসিক পুকুরটি এখনো বহাল তবিয়তে নতুন প্রজন্মকে আহ্বান করে যাচ্ছে দেখে যাও, হে উত্তর প্রজন্ম দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে কেমন ত্যাগ আর রক্ত ঝরাতে হয়। বিপ্লবী বাঘা যতীন নিজেই বলেন, দেশের সুরাহা বাইরে থেকে নয়, তা আসবে অভ্যন্তর থেকে। আর পালানো নয়...যুদ্ধ করে আমরা মরব, এতেই দেশ বাঁচবে। অন্তিম নিশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বে তিনি বলেছিলেন, আমরা মরব, দেশ জাগবে।
×