ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জাভেদ-বিন-এ হাকিম

ঝর্ণার মন মাতানো ছন্দ

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২০ নভেম্বর ২০১৫

ঝর্ণার মন মাতানো ছন্দ

কর্মব্যস্ত ভ্রমণ পিয়াসীদের জন্য দুই দিন ছুটি পাওয়া যেন হাতে চাঁদ পাওয়া। মিন্টু মোড়ল যখন দুই দিন ছুটির সংবাদ জানালেন, তখনই শুরু হয়ে যায় আমাদের দৌড়ঝাঁপ। ছুটি পেয়ে রাতেই মাইক্রোতে করে রওয়ানা হই সীতাকু-ু রেঞ্চের মীরসরাইয়ের পথে। আবারো পাহাড়ে। ঝিরি, জঙ্গল, পাহাড়ে হাইকিং, ট্রাকিং, ট্রেইল মনে হলেই মনের মাঝে করে ঝিলমিল। সারারাত খোশগল্পে মেতে সকাল সাতটায় পৌঁছাই মীরসরাইয়ে। বাড়ইহাট থেকে গাইড নিজাম রিসিভ করে নেয় আমাদের। আমবাড়িয়া ছোট বাজারের ঝুপড়ি হোটেলে চলে সকালের নাস্তা। তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল আটটা। আজ সারাদিনের জন্য দু-পা’ই হবে ভরসা। সাইজমতো বাঁশ নিয়ে প্রথমেই ছুটি বোয়ালিয়া ঝর্ণার পানে। দেশ-বিদেশে নানান পদের বাঁশের হরেক রকমের ব্যবহারে, পাহাড়ী পথে আপনার সবচাইতে কাছের জড় বন্ধু হবে এই চিকন চিকন মসৃণ বাঁশগুলো। খুব স্বল্প সময়েই চলে যাই বোয়ালিয়া ঝর্ণার প্রান্তরে। বোয়ালিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখেই যেন সব আত্মহারা। অবিরাম ঝড়ে পড়া পানিতে চলে জলকেলি। এরপর আনন্দে এতটাই আত্মভোলা হয়ে যাই যে, বোয়ালিয়ার পাশে আব্বাসের কলাবাগানে রুটি, বিস্কুট, পানি সবই ভুলে রেখে যাই। তখন শুধু দেহ-মন চোখে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখার অদম্য বাসনা। কিছু দূরেই পেয়ে যাই পালাকাটা কুম। কারও কারও মতে বাউশ্যা ঝর্ণা। নামে কি আসে যায়, সৌন্দর্যই তার মুখ্য বিষয়। রিমঝিম শব্দ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই হলো ঝর্ণার প্রধান অলঙ্কার। এবার উঠন পাহাড়ের ঝিরি পথ ট্রেইল করে যাই আন্ধারমানিক ঝর্ণায়। দু’পাশের গাছের ডালগুলো এমনভাবে একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়েছে, যেন দিনের আলো সেখানে মুখ লুকিয়েছে। ভর দুপুরেও মনে হবে সন্ধ্যা। আন্ধারমানিকের ট্রেইল পথের সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়া সত্যিই কঠিন। তা কেবল অনুভব করাই সম্ভব। প্রায় সত্তর ফুট উপর থেকে অবিরাম ধারায় ঝরে পড়া পানিতে ভিজে একাকার হয়ে যাই। দৃষ্টিনন্দন ক্যাসকেড ও রোমাঞ্চকর ট্রেইল অতিক্রম করে চলে যাই ঝর্ণার রাজা নোহায়েতে খুমে। ওয়াও! উচ্চতা খুব একটা নয়, তবে নোহায়েতের নৈসর্গ অপার। ঝর্ণার চারপাশে পাথরের ভাজে ভাজে প্রাকৃতিকভাবে খাঁজকাটা বেঞ্চের মতো, এ যেন ভ্রমণ পিয়াসুদের কাছে টানার জন্য প্রকৃতির নিঃস্বার্থ প্রেমের উজ্জ্বল আবেদন। বেশকিছুটা সময় নোহায়েত খুমের সাহচার্যে থেকে ছুটেছি কলাতলী ঝর্ণার পথে। হাঁটু পর্যন্ত দেবে যাওয়া কাঁদা, গা ছমছম করা প্রকৃতি, কালো চিংড়ির ছোটাছুটি, ডুমুরের বুনো গন্ধ, নাম না জানা বাহারী রঙের ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের চাঁইÑ আরও কত কি দেখতে দেখতে কানে ভেসে আসে রিমঝিম শব্দ। সবাই কিছুটা ক্লান্ত তাই ঝিরির পানিতে শুয়ে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবারও হাঁটা। অল্প সময় পরই দেখা মিলে রূপসী কন্যার। ভিন্ন পরিবেশে এক অন্য রকম সৌন্দর্যের কলাতলী ঝর্ণা। কাপ পাহাড় থেকে প্রায় একশত ফিট ওপর থেকে (মতান্তর) সরাসরি ঝরছে ঝর্ণার পানি। মনমাতানো কলাতলী ঝর্ণার পানিতে মেতে উঠি আনন্দে। এই ঝর্ণার প্রধান বৈশিষ্ট্য গড়িয়ে নয়, সরাসরি পাহাড় থেকে পড়ে। বাড়ির শাওয়ার থেকে যেমনি পানি পড়ে, ঠিক তেমনি কলাতলীর পানীয় ধরা আপন মহিমায় ছন্দ তুলে অবিরাম ধারায় ঝরে পড়ে। বিশ্বাস করুন ঝর্ণার পানিতে রয়েছে এমন এক দুর্নিবার আকর্ষণ- আপনি যতই ভিজেন না কেন ভেজার স্বাদ যেন মিটবে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছয়টি ঝর্ণার অবগাহনের পরও তৃপ্তি মেটেনি দে-ছুট ভ্রমণ পিপাসুদের। এবার ফেরার পালা। ফিরছি বৈ-বাঙ্গা পাহাড় দিয়ে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় বারোশ ফুট উচ্চতা। হাঁটছি পাহাড়ি জংলী পথে। কোথাও কোথাও এতটা ঘন জঙ্গল আর খাড়া পথ যে, পড়লেই শেষ নিশ্বাস। তার মধ্যে আবার সারাদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি। পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ। তবে এসব কিছুই তুচ্ছ মনে হবে রিয়েল এ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের কাছে। ভ্রমণ পিপাসুরা তবে আর দেরি কেন? ছুটে যান মন মাতানো ছন্দ তোলা ঝর্ণার গান শুনতে।
×