ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিয়াম সারোয়ার জামিল

নাফ থেকে সেন্টমার্টিন

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২০ নভেম্বর ২০১৫

নাফ থেকে সেন্টমার্টিন

পানির ওপর কাঠের তৈরি করিডরের মতো প্রায় দু’শ মিটার লম্বা ব্রিজ। ব্রিজে কড়া প্রহরায় বসানো তিনটি চেক শেষে জাহাজে উঠতে পারলাম আমরা। অক্টোবরের কড়া রোদ উপেক্ষা করেও অফসিজনে দেখা গেল প্রচুর পর্যটক। শ’পাঁচেক তো হবেই। দ্বিতল বিশিষ্ট জলযানটা পাক্কা দশটায় ছাড়ল। ‘কেয়ারি সিন্দাবাদে’ উঠেই মন নেচে উঠল। জাহাজ ছাড়ার পরে সকালের রোদে নাফ নদী ধরে সেন্টমার্টিনের যাত্রাটা দেখার মতো দৃশ্য। ‘টেকনাফে এত পাহাড়! আমি ভেবেছিলাম শুধু সাগর জল দেখব!’ বিস্ময় প্রকাশ করে কামরুল। নদীর কোল ঘেঁষে আছে গাছের সারি, নদীতে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, আর জাহাজের সামনের দিকে নীল আকাশ- সবমিলিয়ে এক কথায় অপূর্ব। সেন্টমার্টিন এবারই প্রথম হলেও বছর ছয়েক আগে নাফ নদী বেড়িয়েছিলাম। সেবার নাফ নদী দেখে যাওয়ার অনুভূতি ছিল প্রায় ভাষা হারিয়ে ফেলার মতো। মনে হয়েছিল অলঙ্কারে ডুবে থাকা অপ্সরীর নাম নাফ। সেই অপ্সরী একদম বুড়ি না হলেও, এখন অনেকটাই বিবর্ণ। স্বর্গীয় ভাবটা আর আগের মতো নেই। সবুজ জলে পোড়া ডিজেল আর ট্যুরিস্টদের আবর্জনা দেখলাম। টেকনাফের পাহাড়গুলো আগের মতো নেই, কেটে কুটে টাকের মতো দশা! আমরা সাতজন। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে নাফ নদী আর নদীর ওপারে মিয়ানমার সীমান্তের সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। মন সমুদ্রের লু হাওয়ায় ভেসে যেতে চাচ্ছে। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের দূরত্ব প্রায় ৪২ কিলোমিটার। ২৫ কিলোমিটার নাফ নদী আর বাকি ১৭ কিলোমিটার খোলা সাগর। যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। মূলত এটি কোন নদী নয়, বঙ্গোপসাগরের বর্ধিত অংশ, তারপরও স্থায়ী পরিচয় নাফ নদী। এর পানি সাগরের মতোই লবণাক্ত। নদী মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আর মিয়ানমারকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। পশ্চিম পাড়ে বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলা এবং পূর্ব পাড়ে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের আকিয়াব অবস্থিত। সাগরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সিন্দাবাদ। খোলা সাগরে প্রবেশ করতে হাল্কা দুলুনি পেলাম। বাঁয়ে মিয়ানমারের পাহাড়গুলো আপন মনে হলো, যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব না। পরক্ষণেই আফসোস। গান শুনতে ইচ্ছে হলো। দ্বারস্থ হলাম মাহাবুব ভাইয়ের কাছে। আমাদের টিম লিডার তিনি। তার সহধর্মিণী সোহেলী আপুও কম যান না। ঘণ্টার যাত্রাপথ কখন যে উড়ে গেছে, আমরা টের পাইনি কেউই। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে সেন্টমার্টিনের জেটি ঘাটে ভিড়তেই পানির রং দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলাম। পানিটা ঠিক পান্না-সবুজ না মনে হয়, তবে সবুজাভ। পান্না-সবুজ নাফ নদীর পানি। দুটোর মধ্যে হাল্কা ফারাক আছে, সেটা স্পষ্ট। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করে উঠল। ‘আবার তিনটায় ফিরতি জাহাজ। হাতে দু’ঘণ্টা।’ বললেন মাহবুব ভাই। বাজারে গিয়ে কয়েকটা হোটেলের সামনে দেখলাম তাজা মাছ রাখা। দুটো রূপচাঁদা আর তিনটে কোরাল কিনে ফেললাম আমরা। হোটেলে বারবিকিউ বানিয়ে দেবে। বাজার ঘুরে, বিচ ঘুরে, তড়িঘড়ি করে খেয়েদেয়ে, কেনাকাটা করে দ্বীপ অভিযান শেষ করলাম। প্রায় তিনটে বেজে গেছে। ফিরে যাওয়ার পালা। প্রচ- রোদে উঠে পড়লাম ফিরতি জাহাজে। মনে একরাশ আনন্দ আর বিস্ময় ভরা জলের দৃশ্য নিয়ে পড়ন্ত সূর্য দেখতে দেখতে ফিরে যেতে লাগলাম আবার টেকনাফ। ফিরে আসার সময় আমাদের সবার মনই বলছিল, এটা কেবল শুরু। সবুজ জলের টানে বার বার ফিরে আসব আমরা এখানে, বার বার। কিভাবে যাবেন বাংলাদেশের যে কোন স্থান থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য আপনাকে প্রথমে যেতে হবে কক্সবাজার। কক্সবাজার থেকে প্রথমে জীপে চড়ে টেকনাফ, টেকনাফ থেকে সি-ট্রাক, জাহাজ কিংবা ট্রলারে চড়ে পৌঁছাবেন সেন্টমার্টিনে। প্রতিদিন ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে যায় দূরপাল্লার বেশকিছু গাড়ি। বাসে ভাড়া লাগবে এসি ১২০০-১৪০০ এবং নন-এসি ৮০০-৯০০ টাকা। কক্সবাজার থেকে বাসে কিংবা মাইক্রোবাসে যেতে পারেন সেন্টমার্টিন। প্রতিদিন সকাল থেকে কক্সবাজার-টেকনাফ রুটে চলাচল করে এসব গাড়ি। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন সকাল থেকে আসা-যাওয়া করে সি-ট্রাক কেয়ারি সিন্দাবাদ। চমৎকার জাহাজের পাশাপাশি ট্রলার ও চলাচল করে এই সমুদ্র রুটে। জাহাজে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টার মতো। অন্যদিকে প্রতিদিনই বিকেল ৩টায় এসব জাহাজ সেন্টমার্টিন ছেড়ে আসে। শীত মৌসুমে সমুদ্র শান্ত থাকে এবং গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমে সমুদ্র্র্র উত্তাল থাকে, তখন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ।
×