‘প্রথম প্রণয়ী সে যে কার্তিকের ভোরবেলা
দূরে যেতে যেতে থেমে গেছে সে আমার তরে।...
হেমন্তের বৈকালে উড়ো পাখ-পাখালির পালে,
উঠানের পেতে থাকে কান-শোনে ঝরা শিশিরেরর গান,
অঘ্রাণের মাঝরাথে...’
[‘পিপাসার গান’, জীবনানন্দ দাশ’]
প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়ম ঢং বদলায়। রং বদলায়। কত বিচিত্র রং যে মিশে আছে প্রকৃতির পরতে পরতে! চোখ খুলে তা দেখলেও মনের গহিনে তা উপলব্ধি করলে মণপ্রাণ যায় জুড়িয়ে। বারংরার প্রকৃতি তাই বিশ্ব চরাচরে এক রহস্যের নাম। রহস্যে ভরা এর চারপাশ। বিশেষ করে বাংলা ঋতুর বহু বিচিত্র রূপ-রস-গন্ধ মানুষ মুগ্ধ করে। বিস্মিত করে। এক অভাবনীয় রূপবিভায় বাংলার ঋতু-প্রকৃতি প্রতিটি বাঙালীকে ভাবালুতায় নিমজ্জিত করে। অনাদিকাল থেকে চলে আসছে এ প্রক্রিয়া। বাংলা ঋতুর মধ্যে কোন্টা ছেড়ে কোন্টা রাখি- এই দো-টানায় বাঙালীর নাভিশ্বাস অবস্থা। সব ঋতুর মধ্যেই বাঙালী তার আপন সত্তা খুঁজে পায়-নিজেকে পুনঃপুন আবিষ্কার করে এমনকি সেই রূপসুধার ভেতর বাঙালী জীবন শতভাগ সমর্পিত হয়। প্রকৃতি বাঙালীর জীবনে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে কী প্রেমে, কী সংগ্রামে। জীবন আর প্রকৃতি হয়ে ওঠে অবিচ্ছেদ্য অংশ- এটাই বাংলার হাজার বছরের গৌরবের ইতিহাস, সংস্কৃতির ইতিহাস। সংগ্রামের ইতিহাস।
বাংলার ঋতুচক্রের পালাবদলে হেমন্ত তার আগমনী বার্তা দিতে থাকে শরতের শেষে। এ সময় মেঘ-বৃষ্টিতে ছাওয়া উন্মাতাল দিনগুলোর ভেতর হেমন্ত তার সম্ভাব্য আগামী বার্তা মেলে ধরে। শরতের নদী তীরে কিংবা খোলা প্রান্তরে কাশবনেরা যখন মাথা উঁচু করে অসীম বীরত্ব দেখায় তখন ধূসর মেঘে ভর করে শীতের আগামী হিম হিম কুয়াশায় মিশে কিংবা মিষ্টি মধুর পেলব রোদের ভেতর দিয়ে হেমন্ত গুটি গুটি পায়ে নেমে আসে। হেমন্তের ছোঁয়ায় এক নতুন প্রাণ পায়। আকাশে, বাতাসে, বৃক্ষে, চরাচরে ছড়িয়ে পড়ে হেমন্তের অসহ্য সুন্দর রূপবিভা। হেমন্ত বাংলার প্রকৃতিকে মানুষকে সুন্দরে সুন্দরে ভরিয়ে তোলে।
শরতের শুভ্রতা শেষের হেমন্ত বাংলার জীবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে আশ্বিন-কার্তিক দুই মাস হেমন্তকাল। স্থায়িত্ব মাত্র দুই মাস কিন্তু এর প্রভাব অসীম। হেমন্তের স্নিগ্ধ, মায়াময় প্রকৃতির মধ্যে মানুষ যেন তার জীবনকেই খুঁজে ফেরে। খুঁজে পায়। এই ঋতুতে মানুষের আসে প্রেম, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, অভিলাষ এক ভিন্নমাত্রা পায়। হেমন্ত বাংলার মানুষের মধ্যে এক অদ্ভুত রকমের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তৈরি করে। মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলে ভাব, প্রকৃতিপ্রেম, বাঙালিয়ানা আর নিরন্তর সৃজনশীল কর্মকা-। মন বিষণœ হয়ে ওঠে। জীবনের হিসাব-নিকাশ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। হেমন্তের ধূসর প্রকৃতিতে জন্ম-মৃত্যুর অনুভবও তাই মানুষের মধ্যে তীব্রভাবে অনুভূত হয়। কবি হৃদয় বিদীর্ণ হয় হেমন্ত উজানে। ধূসর পা-ুলিপি কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার প্রকৃতিকে যেভাবে পর্যবেক্ষণ ও অনুভব করেছেন তা আর কোন দ্বিতীয় কবির পক্ষে সম্ভব নয়। প্রকৃতিপ্রাণ এই কবি তাঁর অসংখ্য কবিতায় বহুমাত্রিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলার প্রকৃতিকে। প্রকৃতির সমস্ত অনুষঙ্গকে এই কবি গভীর থেকে গভীরতরভাবে আস্বাদন করেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় হেমন্ত বিশেষ রূপ পেয়েছেন। কবি হেমন্তকে ভালবেসে ফেলেছিলেন। তাই কবি তাঁর তীব্র ভালবাসার এই ঋতুকে কথার জানান দিতেও কার্পণ্য করেননি। ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় তিনি যখন নির্বিকারভাবে উচ্চারণ করেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়’- তখন মন অজানা ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে।
কী সাংঘাতিক উচ্চারণ!
মৃত্যুর পর এই বাংলায় এই হেমন্ত ঋতুতে তিনি যেন আবার ফিরে আসেন। তাহলে কী হেমন্তের বিবর্ণ রূপমাধুর্য কবির মনে মৃত্যুর জলছাপ এঁকে দিল! জীবনানন্দ দাশের অসংখ্য রচনায় বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, প্রকৃতি বন্দনা তুমুলভাবে মূর্ত হয়।
হেমন্ত ঋতুর গা-জুড়ে থাকে ধূসরতা। বিবর্ণতা। বিমূর্ত রূপ। প্রকৃতি পর্যালোনায় দেখা যায়, এই ঋতুতে কৃষক কোন ফসল পায় না। বর্ষা ও শরতের অনাবৃষ্টি কিংবা অতিবৃষ্টির কারণে এই ঋতু বরাবরই নিষ্ফলা থাকে। এ সময় কৃষকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে। শস্য স্বল্পতায় তাদের ঘরে অভাব উঁকি মারে। এ সময় কৃষককে তাই খুব হিসাব করে চলতে হয়। ‘পুলকে আর বিষাদে ভরা থাকে এই ঋতু’ কবির উচ্চারণে হেমন্ত ঋতু মানুষের মনে, চিন্তায়-চেতনায় এক ধরনের নির্লিপ্ততা তৈরি করে। জীবনযাপনে বেহিসেবী বাংলার মানুষ হেমন্তে এসে নতুনভাবে জীবনের হিসাব করে। নিজের মতো করে জীবনকে পরিচালিত করে। হেমন্ত বাংলা কৃষককে জীবনের নতুন এক অর্থ শেখায়।
শরতের বিভাময় কাশফুল, আর শিশির ভেজা দূর্বা ঘাস মাড়িয়ে প্রকৃতির মধ্যে হেমন্তের প্রবেশ সৃজনশীল মানুষের মন ও হৃদয়কে নানাভাবে চাঙ্গা করে- উজ্জীবিত করে। সহজিয়া মনের অলিন্দে অলিন্দে খেলা করে নিত্যনতুন সৃষ্টি। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, নাটক, যাত্রাপালা, বৈঠকী গান, পুতুলনাচ, জারি-সারি, বাউল গান, কবির লড়াই- সবকিছুতেই হেমন্ত এনে দেয় নতুন এক মাত্রা। বিস্তার করেছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রানাথ ঠাকুর অবশ্য হেমন্তকালকে একটু ভিন্ন চোখে দেখার চেষ্টা করেছেন। তিনি হেমন্তকালকে বরণ করেছেন। নিজের মতো করে তিনি তাঁর গানে গাইলেন,
‘হিমের রাতে এই গগনে দ্বীপগুলোর হেমন্তিকা করল গোপন, আঁচল ঘিরে ঘিরে,
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো
জ্বালো জ্বালো
আপন আলো সাজাও আলো ধরিত্রীরে।’
হেমন্তকে শুধু অন্যভাবেই অনুভব করলেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি এই ঋতুকে নিয়ে লিখলেন, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া। আমি দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।’
দেশের অন্যতম প্রধান নারী কবি সুফিয়া কামাল এই ঋতুকে নিয়ে লিখেছেন বেশ ক’টি কবিতা। তিনি ‘হেমন্ত’ কবিতায় এই ঋতুর ওপর তার বিশেষ অনুভূতির কথা লিখেছেন যা পাঠক মনে গভীর প্রভাব তৈরি করে। সুফিয়া কামাল ‘হেমন্ত’ কবিতায় কী লিখেছেন? তিনি লিখেছেন,
সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?
আনল ডেকে মটরশুঁটি,
খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।
সকাল বেলায় শিশির ভেজা
ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে
হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায়
শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।
আরও এল সাথে সাথে
নূতন গাছের খেজুর রসে
লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা
মিষ্টি রোদে খেতে বসে।
হেমন্ত তার শিশির ভেজা
আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়
চুপে চুপে রং মাখাল
আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।
হেমন্তের অপার সৌন্দর্য মানুষের মনকে নানা রঙে রাঙিয়ে তোলে এই সৌন্দর্য প্রেমিক হৃদয়কে মাতোয়ারা করে দিয়ে তার মনোলোকে তৈরি করে আশ্চর্য এক জগৎ যেখানে জীবন ও মানুষই হয়ে ওঠে মূল শক্তি। হেমন্তকাল নিয়ে কথা উঠলে তাই বার বার ঘুরেফিরে আসে জীবনানন্দ দাশের কথা। প্রকৃতির কবি, নির্জনতার কবি সর্বোপরি ধূসর পা-ুলিপির কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’-এ অসাধারণভাবে হেমন্তের ছবি এঁকেছেন,
‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামে
ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল
পৃথিবীর সব রং মুছে গেলে পা-ুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রং ঝিলিমিল
সব পাখি ঘরে আসে
সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন
থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন
হেমন্তের প্রকৃতিতে থাকে আলো-ছায়ার বিচিত্র খোলা। মায়াবী খেলা। থাকে রোদ-বৃষ্টির দাপাদাপি। গ্রাম-বাংলার মানুষের যত মাটিও এ সময় নরম থাকে। ভেজাও অঝোর বর্ষা আর শরতের বৃষ্টি জলধারা হেমন্তে শুকাতে থাকে। খাল-বিলে পানি কমতে থাকে। আর এক সময় ‘মাছে-ভাতে বাঙালী’, জাল, বর্শা, পলো, ছিপ, গামছা, লুইÑ যে যা পারে তা-ই নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ে। কাদা পানিতেও মাছ ধরার অনির্বাচনীয় আনন্দে জেগে ওঠে মানুষ। মাছ ধরা শেষে ডুলাভর্তি মাছ নিয়ে বীরবেশে ঘরে ফেরে মানুষ। কিষাণির রান্নাঘর থেকে তাজা মাছ ভাজার ম ম গন্ধ চারদিকে জানান দেয়, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে...’। গ্রামের ঘরে ঘরে এই আনন্দ প্রবহমান থাকে- জাগরূক থাকে। এছাড়া হেমন্তে নানা ধরনের উৎসব-পার্বণে গ্রাম-বাংলার জীবন মুখরিত থাকে। থাকে আনন্দময়।
[email protected]
শীর্ষ সংবাদ: