ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ ঋয়াদ

বেগম নূরজাহান এবং আমাদের নারী

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২০ নভেম্বর ২০১৫

বেগম নূরজাহান এবং আমাদের নারী

বাঙালী মুসলিম নারীদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা ‘বেগম’। এদেশের নারীদের বিকাশ ও অগ্রযাত্রায় ‘বেগম’ পার করেছে ছয় যুগেরও বেশি সময়। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক মহীয়ষী নারীর গল্প। তিনি বেগমের সম্পাদক নূরজাহান বেগম। তখন পর্যন্ত বাঙালী নারীদের কোন পত্রিকা ছিল না। খুব কমসংখ্যাক নারী পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে। আর পড়াশোনা করলেও চাকরি করার মতো কোন অবস্থা সেভাবে তৈরি গড়ে ওঠেনি। ঠিক সে সময় পিতা নাসির উদ্দিন নারীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সাপ্তাহিক প্রকাশ করার কথা ভাবল। অবশ্য তিনি সওগাত পত্রিকার সম্পাদক থাকার সময় সেখানে বিভিন্ন সময়ে নারীদের নিয়ে পূর্ণ সংখ্যা বের করেছেন। তিনি ভাবলেন বাৎসরিক এসব সংখ্যা ঠিক নারীদের অগ্রগতিতে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না। তাই তিনি কবি সুফিয়া কামালকে সম্পাদক করে ১৯৪৭ সালে ‘সাপ্তাহি বেগম’ নামে পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন। তখন নূরজাহান বেগম সবে কলেজে পড়েন। তাই তিনি তাঁকে সম্পাদক করতে পারলেন না। তবে পিতা নাসির উদ্দিন সওগাত এ কাজ করার সময় থেকেই লেখা এবং প্রকাশনা বিষয়ে বেশকিছু কাজ শিখে যান নূরজাহান বেগম। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর সুফিয়া কামাল দেশে চলে আসেন এবং নূরজাহান বেগম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক থেকে সম্পাদক হয়ে গেলেন। শুরু থেকেই এই পত্রিকাটি চালাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কারণ বাঙালী নারীরা তখনও সেই অর্থে শিক্ষার সঙ্গেও সম্পৃক্ত হতে পারেনি। তাই একটি পূর্ণাঙ্গ নারী পত্রিকা চালানো প্রায় অসম্ভবই বটে। তা সত্ত্বেও তখন ‘বেগম’ হয়ে ওঠে নারীদের প্রিয় পত্রিকা। ‘বেগম’ যে বছর প্রকাশ হলো সে বছরই পাক ভারত ভাগ হয়ে গেল। তখন পত্রিকাটি চালাতেও বেশ কষ্টও হয়। সে সময়ে সাময়িকভাবে চালানোর জন্য বিভিন্ন ফিচার অনুবাদ করে বিভিন্ন মানুষের নামে চালানো হতো। আর এরই মধ্যে কিছু নতুন নারী লেখকও যুক্ত হলো। তবে প্রকাশের পর নারী লেখকদের লেখা দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা বের করা যাচ্ছিল না। তাই নারী পত্রিকার জন্য এটি বেশ সমস্যারই কথা। ১৯৪৮ সালের ঈদ সংখাটিই ‘বেগম’ এর প্রথম মহিলা সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করা হয়। ওই সংখ্যায় শুধু মহিলাদের ছবি, মহিলাদের লেখা প্রকাশ করা হয়। তখন নারীর ছবি পত্রিকায় থাকা বিরাট ব্যাপার। আরএমন প্রচলনও ছিল না। ফলে নারীদের মধ্যে বেশ সাড়া পরে যায় আর সে সময়ে যারা বেগমকে দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর, তাদের মধ্যে সুফিয়া কামাল, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, শামসুন নাহার মাহমুদ ও নূরজাহান বেগম প্রমুখ। তবে শুরু থেকেই এই পত্রিকায় নূরজাহান বেগম একটি বড় ভূমিকা পালন করে আসছেন। একটি নারী পত্রিকাকে সমৃদ্ধ কারর জন্য তিনি এর সঙ্গে আরও নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করার প্রয়াস পেয়েছে। আজকে দিনের দৈনিকগুলোর যে নারীবিষয়ক জনপ্রিয় ফিচার পাতা তৈরি হয়েছে বা হচ্ছেÑ এই পথটা নূরজাহান বেগমই প্রথম তৈরি করেছেন। বাঙালী নারীরা যখন ঘরকন্যার কাজে ব্যস্ত ঠিক তখনই বেগমের মতো একটি সাহসী নারী পত্রিকা নারীদের একটি ভিন্ন জগতের স্বাদ এনে দেয়। যদিও তখন অফিস আদালত কিংবা বাইরে বের হয়ে আসা বেশ কষ্টকর ব্যাপরই বটে। পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে যে মানুষটি সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছেন তিনি ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমের পিতা নাসির উদ্দিন। পিতার সহযোগিতায় সঙ্গে নূরজাহান বেগমের দৃঢ় সংকল্পই এই পত্রিকাটিকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসে। বাঙালী নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন নূরজাহান বেগম। তিনি তার পত্রিকাকে দিনের পর দিন শ্রম ও মেধা দিয়ে একটি আধুনিক চিন্তামনস্ক পত্রিকা হিসেবে রূপ দিলেন। তখনকার সময়ে ‘বেগম’ এ তিনি নারী, শিশু সাস্থ্য, রান্না-বান্নার মতো ফিচার দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। নারীদের দৈনন্দিন শিক্ষার একটা বড় প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে এটি। বর্তমান সময়ে নারীরা যে বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন ঠিক সেটা এই মহীয়ষী নারী অনেক আগে থেকেই ভেবেছিলেন। একটা কথা বলা প্রয়োজন, ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এটি প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে। কলকাতা থেকে নূরজাহান বেগম ঢাকায় চলে আসেন ১৯৫০ সালে। তখন কলকাতা ফেরত মানুষকে খুব ভালভাবে দেখা হতো না। তাই কলকাতার জীবনের সমস্যা এখানেও তাড়া করে ফেরে। ওই অবস্থায় লেখা সংগ্রহ প্রকাশ করা আরও দুরূহ ব্যাপার ছিল। নারীদের তো আরও পরাধীন অবস্থা। ঠিক তখন আমেরিকান এক মহিলা জার্নালিস্ট খোঁজ নিয়ে ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমের সঙ্গে দেখা করে। পাটুয়াটুলির একটা ভাঙ্গা টিনের ঘরে ওই বিদেশী জার্নালিস্ট মহিলার সঙ্গে আমাদের মিটিং হয়। তার বুদ্ধিতেই বেগম ক্লাব গঠিত হয়েছে। নারীদের একটা ক্লাব সেখানে নারী আসবে তাতে তো কারও আপত্তি নেই। ঠিক এই বুদ্ধিটা তিনি নূরজাহান বেগমকে দিলেন। কøাবের সেক্রেটারি করা হয় নূরজাহান বেগমকে আর প্রেসিডেন্ট করা হয় মুসলিম লীগের বেগম শামসুন নাহার মহমুদকে। বেগম ক্লাবের মাধমে বেগম পত্রিকা একটি নতুন দিকের সন্ধান পেল। সেই থেকে শুরু করে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এসে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে বেগম পত্রিকা একটি বড় পাঠক সমাজ ও নারী লেখক তৈরিতে কাজ করেছে। প্রতিবছর বেগমের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে প্রচুর মানুষ হতো। আসলে একটি নারী পত্রিকা তখন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। নূরজাহান বেগম ১৯৫২ সালে বিয়ে করেন রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) কে। তিনি তখন দৈনিক ইত্তেহাদের শিশু বিভাগে কাজ করতেন এবং মাসিক সওগাত-এর নারী ও শিশু বিভাগেও কাজ করতেন। প্রথমে পরিচয় তারপর দুজনের মধ্যে সম্পর্ক। নূরজাহান বেগমের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে ফ্লোরা নাসরিন ও ছোট মেয়ে রীনা ইয়াসমিন। বেগম পত্রিকাটি এখন আর নিয়মিত প্রকাশ করতে পারছেন না। তবে পত্রিকাটি এখন শুধু ঈদ ও বাৎসরিক সংখ্যাই করা হয়। অসুস্থ নূরজাহান বেগমের ইচ্ছা মাসিক হোক আর ত্রৈমাসিক হোক তার বেগম বেঁচে থাকুক। বেঁচে থাকুক বেগমের গর্ব নিয়ে, বেঁচে থাকুক বাঙালী নারীর প্রিয় পত্রিকা হিসেবে। কারণ বেগমই তাকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে আসে। আর তিনি বেগমের মধ্যদিয়ে তৈরি করেছন বাঙালী নারীদের এক অনন্য ইতিহাস। [email protected]
×