ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাসনাত মোবারক

পূর্ণায়ত জীবনের ছবি

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২০ নভেম্বর ২০১৫

পূর্ণায়ত জীবনের ছবি

চারদিকে বিবিধ ব্যাধের চটকদারি। সুযোগ আর সীমাবদ্ধতার নজরদারিতে সৃজনের সত্তা যখন থমকে যাওয়ার অবস্থা, তখনও কবি রতনতনু ঘোষ আপন গতিতে তার সৃজনশীল জগতে স্বস্থান গড়ে তুলতে তৎপর। শিল্প ও সাহিত্যের ঋদ্ধতম জায়গা কবিতা। আর এই কবিতার কাছে কবি রতনতনু ঘোষ ফিরেছেন বার বার। প্রকাশিত হয়েছে তঁাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার বই। যন্ত্র ও যুগের সমস্ত ধকল উজিয়ে পাঠককে উপহার দিতে পেরেছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা। শ্রেষ্ঠ কবিতার কবিতাগুলো প্রেম আর প্রকৃতির পরশে মাখা। এ প্রেম শিল্পের, এ প্রেম রুচির, এ প্রেম স্বদেশচেতনার, এ প্রেম জাগতিক শক্তির ধারক ও বাহক। তাবৎ চেতনা আর উন্নত মনমানসিকতার জায়গা থেকে বিচিত্র সত্তানির্ভর এই কবিতাগুলো। তার কবিতা পাঠে সহজেই অনুমিত হয়, কবি প্রথাবদ্ধ প্রবহমানতায় গতর ভাসিয়ে দেননি। বরং কবি স্বস্থান অটুট রেখেছেন আপন সুরের মহিমায়। ভিন্ন আঙ্গিকতার আলোকে বৈচিত্র্যের ডালি সাজিয়ে অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন তার কবিতার মন্দিরে। মেধা আর মননের সংযোগে পূর্ণায়ত জীবনবোধের বহুকণ্ঠ শুনতে পাই তার কবিতায়। কবির বিনির্মিত চেতনা আমাকে টানে, তার কল্পজগৎ কাছে ডাকে। তার কবিতা হৃদয়কে দোলা দেয়, পুলকিত করে। যেমনটি কবির ভাষায়- ‘কত নদী কল্লোলিত এই মনে/ জানা হলো না/ কত ইচ্ছা ডানা মেলে উড়লো হাওয়ায়/ দেখা হলো না।’ তার কবিতায় ব্যবহৃত সহজ শব্দজালে পাঠকের ভেতরের অন্তর্নিহিত বিষয়-আশয় উঠে আসে। কবি রতনতনু ঘোষ বরাবরই শব্দনিপুণ ও ছবিখচিত ভাবনা রূপায়নে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। আবেগ, প্রেম, দ্রোহ, জীবনভাবনা সবকিছুরই সম্মিলিত প্রয়াস ঘটিয়েছেন তার কবিতায়। সুনীতি আর মানবিকতার আবহে বেড়ে উঠেছে তার কবিতার চারাগাছ। তার কিছু কবিতা সহজবোধ্যতার টোপে গিলে ফেলেছে। কবিতা শুধু বৈষয়িক ব্যাপার নয়, তা আধ্যাত্মিক ব্যাপারস্যাপারও। বাংলা নীতিকবিতার গীতিময়তা তার কবিতায় আছে। কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয় তা নিরূপণ করার দায়ভার মহাকালের উপর ছেড়ে দিই। কিছুটা ঘুরে ফিরে আসুক না তার কবিতা অনাগত ভবিষ্যতের কাছে। ঘটনা থেকে রটে যাওয়া ইতিহাস অনেক কিছুই বলে, বর্তমানে যা খারিজকৃত তা যে দূরগামীর নিকট সোনারূপে ধরা পড়বে না, তা বলা যায় না। রতনতনু ঘোষ বহুসত্তাময় ও বহুস্বরের কবি। তার পুস্তকমালার পরতে পরতে চেতনার বহুতলের ছাপ লক্ষণীয়। যখন কবি লেখেনÑ ‘অদৃশ্য টানে টের পাই;/ আমাকে টানে আড়ালের কেউ’। (ঘুড়ি) এখানে কী টানে, সঠিকভাবে বলা কঠিন। অনেক কিছুই তো কবিকে টানতে পারে। এতে পাঠকমনও দোলায়িত হয়। ভিন্ন স্বাদের কাব্যরুচির তির্যকতায় কবিতা হয়ে উঠেছে অর্থময়। তার কবিতা যখন পাঠকের ভাব ও বোধের জায়গায় পৌঁছাবে তখনই তার সার্থকতা। কবিতা অনেকটা অন্তরে ক্লিক করার ব্যাপার। যা মুহূর্তের মধ্যে পাঠক মনকে দূর থেকে কাছে, নিকট হতে আরও বহুদূরে ঠেলে দেয় ঠিক রাডারের মতো। যেমন- ‘যে জীবনযাপন করেছি সেটি আমার জীবন নয়;/ এলোমেলো খসড়া খাতায় জীবন আমার কাম্য নয়’। রতনতন ঘোষ, শ্রেষ্ঠ কবিতা অসাধারণ বাচনিক শক্তিতে এ কবিতা মোহিত করে পাঠককে। তিনি পাঠককে সঙ্গী করে হেঁটে চলেছেন কবিতারাজ্যে। সুশোভিত শব্দমালার বৃত্ত থেকে বৃত্তান্তরে, বাহির থেকে ভেতরে, দৃশ্যমান থেকে অন্তরালে তার কবিতা গমন করে। সুনির্বাচিত শব্দে ছান্দসিক যাত্রাপথ অতিক্রম করে চলেছেন কবি আপন ভূমিতে। পাঠকের মনোজগৎকে কর্ষণ করে শব্দের ফসল ফলিয়ে চলেছেন। আমরা অনুভব করি- ‘জীবনের স্বপ্নময় স্রোত থামে না কখনো/ থেমে যায় মৃত্যুর হুঙ্কার;/ শিশুরা বেড়ে ওঠে স্বপ্নের গল্প শুনে/ স্বপ্নেরা মরে যায় বাস্তবের প্রতিঘাতে।’ রতনতনু ঘোষ, শ্রেষ্ঠ কবিতা এমন কথা পূর্বেও হয়তো বলা হয়ে থাকতে পারে বহুবার, তাতে কী কবি তার নিজস্ব সুরের দ্যোতনা, স্বতন্ত্র ভঙ্গিমায় যেভাবে গাইলেন সেটাকে বলা যেতে পারে নিজস্ব কবিভাষা তথা পরিশীলিত শিল্পরূপ। অনুসন্ধিৎসু ও সমাজচেতনার কবি রতনতনু ঘোষ প্রবহমান সমাজের মধ্যে বিরাজমান ঘটনাকে শিল্পরূপ দেয়ার সক্ষমতা মূর্ত করেছেন। জীবনের শিল্পতরুর ছায়ায় এবং প্রকৃতিবিন্যাসে আচ্ছাদিত তার শ্রেষ্ঠ কবিতা। তার কবিতায় সমাজ পরিবর্তনের সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ফুটে উঠেছে বার বার। কবির মানসলোকে ধরা পড়েছে স্বকীয় আবেগ। সেই আবেগ আশ্রয় পেয়েছে কবিতার শরীরজুড়ে। কবির চেতনালোক থেকে পাঠকের চেতনাকে নাড়া দেয়াটাকেও বলবো চেতনা রূপান্তরের সার্থকতা। এই বিষয়টি সাধারণের মনোজগৎকে পাল্টে দেয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টার প্রবণতা বলা যায়- ‘জীবনের পরম্পরার জীবনের আত্মনিবেদন,/ স্বপ্নপোড়া জীবনের বাস্তব উন্মোচন।’ খুব সহজ শব্দের গাঁথুনিতে জাতিস্মরের সারবত্তা উপস্থাপন করলেন তিনি। কবির শিল্প সাধনায় অনায়াসেই উঠে এসেছে, খাঁটি জীবনের কথা। মর্মসিক্ত বয়ানে তুলে ধরেছেন কেন্দ্র থেকে প্রান্ত ও প্রান্তিকের জীবন। ভাব ও অনুভবের মাত্রা ছুঁয়ে কবির খাতায় যখন লেখেন- ‘অচিন্ত্যকে চয়ন করে চিন্তার জাল বোনা হয় হিরণ¥য় জীবনে। কবিরা নিজেকে অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি করেন ‘চা বিক্রেতা সাহাবুদ্দিনের মতো’। জীবনসন্ন্যাসে ব্রত এই কবি কথার পরতে পরতে অসাধারণ পঙ্ক্তি জুড়ে দেন। বহুধা বৈচিত্র্যের ফসল এই কবিতা। কখনো চেতনার বহুরং ছুড়ে দিয়েছেন শিল্পের ঘনিষ্ঠতায়। আবার কখনো ফুঁসে উঠেছেন অন্তর্গত আপন সত্তায়। এক ধরনের শিল্পবাজদের মুখোশ তুলে ধরেছেন কবি রতনতনু ঘোষ। কবির আক্ষেপ ও আস্ফালনের ফসল হিসেবে কবিতাগুলো শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। বুনন ও বয়ানে শব্দগুলো শিল্পরূপ নিয়েছে এভাবেই- ‘গণকবিতামঞ্চের স্নিগ্ধ প্রহরে কবিতা পড়ি শান্ত সন্ধ্যায়;/ জীবনের ঘনীভূত ভোর সুদূর সন্ধ্যায় আছড়ে পড়ে।/ গণকবিতামঞ্চে ধ্বনিত আমার কবিতা,/ রাজকবিরা আসে না এখানে;/ রাজসভায় কবিতা পড়া হলো না/ আমার কবিতা পড়লো সমগ্র রাজসভা।’ কবি রতনতনু ঘোষের কবিতায় রূপায়িত হয়েছে ফুল, নদী, পাখি। মনোহর ঐতিহ্যের ছাপ, বাংলার ইতিহাস তাতে রয়েছে। জীবন-জোয়ারে কবি কখনো কবিতাকে আবেগঘন করে তুলেছেন। আবার কখনো কবিতাকে নিয়ে গিয়েছেন জীবনের যোগসূত্রের নিকটবর্তী। হ্যাঁ। কবি এমনই শক্তিমত্তা বহন করেছেন কবিতায়। মুহূর্তেই ফুঁসে উঠেছেন ন্যায্যভাবে। এমন সক্ষমতা কবি মাত্রই থাকা উচিত। সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার হিসেবে যদি বেছে নেয়া হয় কবিতা, সে ক্ষেত্রে কবির সাফল্য আছে বলা যায়। কবিতাকে পাঠকমুখী করতে তিনি কবিতাকে সহজবোধ্য করেছেন। অনেক কবি মাত্রাতিরিক্ত ‘ইমেজিস্ট’ হওয়ার কারণে ‘রিয়্যালিস্টিক’ হতে পারেন না। কারণ আসল ব্যাপারটি যখন হারিয়ে যায়, তখন পাঠক মুখ ফিরিয়ে নেন সে কবিতা থেকে। কিন্তু কবি রতনতনু ঘোষের কবিতার ব্যাপারে সে অপবাদ দেয়ার সক্ষমতা কারোর নেই। এসবই তার কবিতার বিষয়বস্তু অবলম্বনে বলা। স্বদেশচেতনা ও বিদ্যমান বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লিখিত পঙ্ক্তিমালায় কবি রতনতনু ঘোষের অভিজ্ঞতা বিনির্মিত হয়েছে কবিতায়। তিনি চেয়েছেন চেতনাসংস্কার। যথার্থভাবেই একথা বলা যেতে পারে, কবি রতনতনু ঘোষ স্বতঃসিদ্ধ শব্দের মেলবন্ধনে মলাটবদ্ধ করেছেন তার শ্রেষ্ঠ কবিতা।
×