ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আহমদ শরীফ

বিদ্যা দানের ও গ্রহণের রূপান্তর ধারা

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২০ নভেম্বর ২০১৫

বিদ্যা দানের ও গ্রহণের রূপান্তর ধারা

অকূল অজ্ঞতাসমুদ্রে জ্ঞানের দ্বীপ খুঁজে বেড়ানোর মতোই অজ্ঞ মানুষ মনোময় তত্ত্ব কল্পনা করে, প্রবোধ পাবার মতো বিশ্বাসের বীজ উপ্ত করে কল্পনা ও বিশ্বাসকে যুক্তি-বুদ্ধি যোগে সঙ্গত ও সমন্বিত করে তত্ত্ব ও তথ্যরূপে নিঃসন্দেহে গ্রহণ করে জিজ্ঞাসার সত্য আবিষ্কারে ও উদ্ঘাটনে আত্মপ্রসাদ লাভ করে মানুষ আবহমান কাল থেকেই নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছে। ফলে স্থানান্তরে ও গোত্রান্তরে কল্পনার মাত্রা ও বিশ্বাসের ভিত্তি অনুযায়ী স্রষ্টা, সৃষ্টি, জগৎ, জন্ম, জীবন, মৃত্যু এবং তার পরবর্তী পরিণাম সম্বন্ধে বহু, বিবিধ ও বিচিত্র ভাব-চিন্তা-অনুভব-উপলব্ধি স্থানিক, কালিক ও গৌত্রিকভাবে প্রকাশ, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এসব রহস্যচেতনার বা জিজ্ঞাসার মধ্যে কেবল কৌতূহল ছিল না, জৈব প্রয়োজনে এবং মানস-কাক্সক্ষায় চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে যে বাধাবিঘœ ছিল, অসহায় মানুষ অবচেতন মনেই তাতে কোন মিত্র বা অরিশক্তির নিয়ন্ত্রণ অনুভব করেছে। সর্বপ্রাণবাদ, যাদুশক্তি, ট্যাবু-টোটেম সংস্কার প্রভৃতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে এভাবেই। দার্শনিক চিন্তার উদ্ভবও তাই দেশ-কাল-প্রতিবেশ ও প্রয়োজন সাপেক্ষ। তাছাড়া স্রষ্টা বা নিয়ন্ত্রকশক্তি স্বীকার করলেই তার সঙ্গে স্বতই একটা সম্পর্ক-চেতনা জাগে। আর তার থেকেই জন্মে ভয়-ভরসার অনুভূতি এবং সে শক্তির প্রতি আনুগত্য ও দায়িত্ববোধ আর কর্তব্যবুদ্ধিও ক্ষতিভীরু প্রাপ্তিলোভী অসহায় মানুষের মনে না জেগে পারে না। এ দায়িত্ববুদ্ধির ও কর্তব্য-চেতনার প্রসারে ও বিকাশে অবশ্য-মান্য বিশ্বাস-সংস্কার, রীতি-রেওয়াজ, নীতি-আদর্শ, আচার-আচরণ, শাস্ত্র-সমাজ প্রভৃতি হাজারো স্বেচ্ছাবৃত নিয়ম-নিগড় মনের, রুচির, বুদ্ধির, যুক্তির এবং কল্পনার প্রসারে, বাস্তব জীবন-যাত্রার প্রয়োজনে শাস্ত্র-সমাজ-সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের ধারায় গড়ে উঠেছে। আমরা জানি, মানুষ মাত্রই সাধারণভাবে পরবুদ্ধি, পরশ্রম, পরজ্ঞান নির্ভর অনুকারক ও অনুসারক মাত্র। জিজ্ঞাসার ক্ষেত্রেও তারা স্ব-স্ব জিজ্ঞাসার উত্তর সন্ধানে সচেষ্ট হয় না, যার জ্ঞান-বুদ্ধি-প্রজ্ঞা সম্বন্ধে তার আস্থা রয়েছে, তেমন মানুষের কাছে গিয়েই সে তার মনে জাগা প্রশ্নের তৈরি উত্তর পেয়ে তুষ্ট থাকে। এরই নাম বিশ্বাস। কল্পনা থেকে সংস্কার আর সংস্কার দৃঢ়মূল হলেই তা বিশ্বাসরূপে পায় প্রতিষ্ঠা। মানুষের অধ্যাত্মজ্ঞানের উৎস হচ্ছে কল্পনা। যুক্তি ও বুদ্ধি সমর্থিত কল্পনাই অজ্ঞেয়কে জ্ঞেয়রূপে প্রতিভাত করে এবং আস্থাভাজনের মুখে তা উচ্চারিত হলে সাধারণ মানুষ তা অবিসম্বাদিত সত্য বলে মেনে নেয়। তাই অতীতে বিভিন্ন স্থানে ও কালে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর মধ্যে সৃষ্টিতত্ত্ব, জীবনতত্ত্ব আর মৃত্যু পরবর্তী আত্মাতত্ত্ব বিচিত্র শাস্ত্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং সে-সব তত্ত্ব স্বীকার করেই এবং সে-সব তত্ত্বজ পরিণাম অঙ্গীকার করেই মানুষ জীবন ও জীবিকানীতি অনুসরণ করেছে ব্যক্তিক ও গোষ্ঠীগত যৌথ জীবন। এবং এ দুটোই করেছে তাদের জগৎ-চেতনা ও জীবন-ভাবনা নিয়ন্ত্রত-শাস্ত্র-সমাজ, নীতি-নিয়ম, পাপ-পুণ্য, লাভ-ক্ষতি সবটাই ওই উদ্ভব ও বিনাশ চেতনাজাত। ক্রমবিকাশের ধারায় বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা যখন বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন মানুষ জগৎ সৃষ্টির মূল উপকরণ চিন্তায় হয়েছে তৎপর। তখন কেউ বলেছেন জল, কেউ মনে করেছেন বায়ু, কেউবা জেনেছেন আগুন, আর কারো চোখে মাটিই মূল উপাদান। এ হচ্ছে জড়জগতের বাহ্যস্বরূপ সন্ধানীর অনুমান। আর যাঁরা তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক-স্বরূপ সন্ধিৎসু, তাঁদের দিয়েই হয়েছে অধিবিদ্যার ও অধ্যাত্মবিদ্যার উন্মেষ ও বিকাশ। বাহন হয়েছে যুক্তিবিদ্যা, আর উত্তরণ ঘটেছে দর্শনে। স্রষ্টার স্বরূপ জিজ্ঞাসা, স্রষ্টা-সৃষ্টির সম্পর্কতত্ত্ব প্রভৃতিই ছিল গোড়ার দিককার জানার ও জানানোর বিষয়। যেহেতু অধিবিদ্যাও অধ্যাত্মবিদ্যা দুটোই কল্পনার, বুদ্ধির ও যুক্তির আপাত সঙ্গত ও সমন্বিত প্রয়াসের প্রসূন, সেজন্যে এ বিদ্যা শুরু থেকেই গ্রহণ করতে হয়। যেহেতু এতে কোন জড় বাস্তব বাহ্য প্রমাণ প্রয়োগ সম্ভব নয়, সেহেতু গুরুমুখে শোনা তত্ত্ব ও তথ্যই চরম ও পরম বলে মানতেই হতো। এ বিদ্যার নাম পরাবিদ্যা বা পরাজ্ঞান তথা ব্রহ্মবিদ্যা। যেহেতু এ একান্তভাবেই গুরুর মনীষা ও মনস্বিতার ফসল, সেহেতু এ জ্ঞান বাস্তব শাস্ত্রিক সামাজিক জীবনে, সুদুর্লভ অমূল্য অনন্য জ্ঞান। ফলে গুরুও ‘লাখে না মিলে এক’। তাই সেবায়, সাধনায়, সৌজন্যে গুরুকে তুষ্ট করেই এ পরবিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ সম্ভব। এভাবে সমাজে গুণ-মান-মাহাত্ম্য সম্পন্ন দুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞানী গুরুশ্রেণী সমাজের মাথা হয়ে পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজ করতে থাকে। গুরু-উস্তাদ, মোল্লা-পুরোহিত, শ্রমণ-শ্রাবক-ভিক্ষু-মুনি-ঋষি শ্রেণীর পরান্ন ও পরশ্রমজীবী নিশ্চিন্ত-নিষ্কর্মা জ্ঞান-প্রজ্ঞাধারী সিদ্ধ-সাধক মানুষের সমাজে প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি ঘটে এভাবেই। এ শ্রেণী-সুবাদেই পরবর্তীকালে সাধু-সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী-যোগী-ফকির-দরবেশ শ্রেণীরও মান-মর্যাদা ও প্রয়োজন অবিচল ও চিরন্তন হয়ে থেকেছে। গুরু-শিষ্য, উস্তাদ-সাগরিদ, পূজ্য-পূজক, খাদেম-মখদুম, সেবিত-সেবক, প্রভু-দাস সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, শেখা-শেখানোর বিদ্যা সুদুর্লভ ও ব্যক্তিগত সাধনায় অর্জিতব্য বলেই। সমাজে ওই জ্ঞান-প্রজ্ঞাবান সিদ্ধ সাধকদের সামাজিক ও বৈষয়িক ধন-মান-যশ-বিত্ত-বেসাত-প্রতিপত্তি বংশানুক্রমে চিরস্থায়ী করে রাখবার জন্যে এ বিদ্যায় অধিকারী-অনধিকারী ভেদও তাঁরাই সৃষ্টি করেন। বিদ্যাগুপ্তির ও মন্ত্রগুপ্তির কারণ এ-ই। তারপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে, হাতিয়ারের উৎকর্ষে, জীবন-চেতনার প্রসারে, কৌতূহলী উদ্যোগী মানুষের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে জীবিকার প্রসারে ও জীবনোপকরণের চাহিদা বৃদ্ধির দরুন শেখার ও শেখানোর বিষয় ক্রমেই বহু, বিবিধ ও বিচিত্র হয়ে ওঠে। তখন আর পরাবিদ্যা, অমৃতত্ত্ব, মোক্ষবাঞ্ছা ও স্বর্গসুখই কেবল মানুষের ঐকান্তিক চাওয়া-পাওয়ার বিষয় রইল না। ভূমার থেকে মানব-দৃষ্টি ক্রমে ভূমির দিকে নিবদ্ধ হচ্ছিল, আকাশই কেবল আর আকর্ষণের ও আকাক্সক্ষা পূর্তির অবলম্বন হয়ে থাকল না। দেবতার ও দিব্যতার পাশে এবার মাটি ও মানুষ, প্রিয়া আর পৃথিবীও গুরুত্ব পেতে থাকে। যেহেতু গোত্রীয় জীবন-পদ্ধতি দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়েছিল, বিদ্যাও ছিল নগণ্যসংখ্যক লোকের আয়ত্তে, সেহেতু গুরু-উস্তাদ-শিক্ষকের দুর্লভ্যতাজাত গুরুত্ব ও সামাজিক মর্যাদা ছিল প্রায় দেবতুল্য। শিক্ষাদান পেশা হিসেবে স্বীকৃত ছিল না বলে বিদ্যাদান ও গ্রহণ ছিল অনুগ্রহের ও অনুগৃহীতের বিষয়। নিতান্ত কৃপার দান। তাই গুরুগৃহে থেকে বিদ্যা তিলে তিলে অর্জন করতে হতো সেবার, শ্রমের, ভিক্ষার্জিত অন্যের এবং গুরুগৃহে ভৃত্যের কাজের বিনিময়ে। গুরুর গ্রাসাচ্ছাদন শিষ্যনির্ভর ছিল বলেই গুরুও শিষ্যকে সহজে ও স্বল্প সময়ে বিদ্যাদান করতেন না। শিষ্যের প্রায় অর্ধজীবন অতিবাহিত হতো গুরুগৃহে জ্ঞানার্জনে। বিদ্যাদানে-গ্রহণে এমনি মন্থরতা ছিল বলেই ব্যাকরণ, অলঙ্কার, ন্যায়, স্মৃতি, গণিত প্রভৃতি যে কোন বিষয় শিখতে শিষ্যের লাগত বারো বছরের সাধনা। আদিতে যে বিদ্যা ছিল পরমার্থ বিষয়ক তা ক্রমে পার্থিব ও বৈষয়িক বিদ্যায় হলো রূপান্তরিত। এ ক্ষেত্রে বিদ্যা বিনয় দান করবে, জ্ঞান ব্রহ্মাস্বাদ দেবে এমন আশা করা নিশ্চয়ই বাতুলতা। পরাবিদ্যার লক্ষ্য ছিল পরমার্থজ্ঞান অর্জন, জীবন-চেতনার উৎকর্ষ সাধন এবং সমাজ সদস্য হিসেবে প্রয়োজনীয় গুণের অনুশীলন। এ ধারণাবলেই আজো আমরা বলি যে, বিদ্যা বিনয়ী করে, ন্যায়-অন্যায় ধারণা দেয়, বিবেকবান করে, বিদ্বান, সুজন জ্ঞানী গুণবান ও সদাচারী হয়, হয় দায়িত্বশীল ও কর্তব্য সচেতন। কিন্তু যখন পরাবিদ্যা থেকে ঐহিক বা পার্থিববিদ্যা গুরুত্ব বেশি পেতে থাকে এবং বিদ্যালয়ও গুরুগৃহ থেকে যৌথ বারোয়ারী প্রতিষ্ঠানে স্থিতি পেল তখনো গুরু-উস্তাদ বিদ্যাগুপ্তি বা মন্ত্রগুপ্তি কালের মান-যশ-ভক্তি-শ্রদ্ধা ও মর্যাদা দাবি করতে থাকেন। একদিন যা ছিল ভক্তের বা জিজ্ঞাসুর প্রতি কৃপার দান, তা পয়সায় প্রাপ্য হওয়ার পর গুরু-উস্তাদের দাবি যৌক্তিকতা হারায়। হাতিয়ার প্রভৃতির উৎকর্ষে ও নতুনত্বে যদিও জীবন-চেতনায় ও জীবিকা-বিন্যাসে কালান্তর ঘটে, সে অনুসারে সমাজের নিয়ম-নীতির পরিবর্তন ঘটে, তবু বিশ্বাস-সংস্কার নিয়ন্ত্রিত মানস-জীবনে ভাব-চিন্তার ক্ষেত্রে সব সময়ে সমকালীনতা থাকে না, তাই গুরু-উস্তাদের ঠাঁই মা-বাপের পাশেই সমমর্যাদায় ও গুরুত্বে আজো রয়ে গেল। আজ বিদ্যা মানে কেবল ঐহিক ও বৈষয়িক বিদ্যাই বোঝায়। মানব মনীষার বিচিত্র আবিষ্কারের উদ্ভাবনে জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-সন্তোষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে হয়েছে নানা বিদ্যার অনুশীলন, নানা ব্যবস্থার উদ্ভাবন, নানা চাহিদার সৃষ্টি ও বিস্তার। এর দরুন বিদ্যালয়েও বিচিত্র বিদ্যা শেখানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছে, হচ্ছে, হবে। যেমন সাহিত্য, গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, চিত্রকলা, সঙ্গীত প্রভৃতিও আজ আর ঋজু বিষয় নয়- নানা সূক্ষ্ম শাখা-প্রশাখায় তা নিত্য প্রসারশীল, তেমনি পদার্থবিদ্যা, রসায়ন প্রভৃতিও নানা সূক্ষ্ম শাখা-প্রশাখায় বিকাশমান, রসায়নই অর্গেনিক, ইনর্গেনিক, ফলিত, জৈব, জৈববীজাণু, রসায়ন, ভেষজ ও মৃত্তিকা বিজ্ঞান অবধি আত্মবিস্তারে বিপুল। এমনি করে জীববিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান কিংবা বাণিজ্যবিজ্ঞানও আজ হিসাববিজ্ঞানে, বিপণনবিজ্ঞানে, ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানে পুঁজি বিনিয়োগ বিজ্ঞানে হচ্ছে প্রসারিত। এগুলো ছাড়াও চিকিৎসা, কৃষি, সমুদ্র, খনি প্রযুক্তি, প্রকৌশল, কৃৎকৌশল, স্থাপত্য, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান, সুচিবিজ্ঞান প্রভৃতি বিদ্যাও বিচিত্র বিকাশে বিস্ময় উদ্রেক করে। এসব ঐহিক, পার্থিব, বৈষয়িক ও আর্থিক জীবন-লগ্ন এবং একালে বিদ্যাও পণ্য। বিদ্যালয়ও তাই বিপণী। অর্থের বিনিময়েই অন্যসব বেচা-কেনার সামগ্রীর মতো বিদ্যাও হয় বেচা-কেনা। নীতিটা হচ্ছে ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’। এর পরেও গুরু-উস্তাদ শিক্ষার্থীর ভক্তি-শ্রদ্ধা ফাও হিসেবেও নয়Ñ একেবারে মৌরুসী ন্যায্য প্রাপ্য হিসেবে দাবি করেন কী করে। যে দেশে পরাশক্তি-নিয়ন্ত্রিত মুৎসুদ্দী-সরকার শিক্ষায় মানুষের জন্মগত অধিকার স্বীকার করে না, অন্তত নানা অজুহাতে মৌলমানবাধিকার থেকে গণমানবকে বঞ্চিত রাখে, যেখানে মানুষের স্বাধীন-চিন্তারোধকল্পে মানুষকে অতীতমুখী এবং শাস্ত্রানুগত রাখার সুপরিকল্পিত সরকারী প্রয়াস চলে, যে দেশে কালের দাবি অনুগ যুক্তিবাদে, সামাজিক নীতিতত্ত্বে (বঃযরপং) আনুগত্য কিংবা আত্মমর্যাদাবোধের প্রতীক সাংস্কৃতিক নৈতিকতা (সড়ৎধষরঃু) নেই, অনুশীলনের গরজবোধ পর্যন্ত নেই, সে দেশে আমাদের বাস। তাই এ দেশে সন্তান মানুষ্যত্বে মানুষ হওয়া নয়, মানুষ হওয়া মানে অর্থ অর্জনের সমর্থ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। ঊঃযরপং-এর ও সড়ৎধষরঃু-এর গুরুত্ব উপলব্ধির জন্যে যে শিক্ষা প্রয়োজন তা হচ্ছে মানববিদ্যা বা ঐঁসধহরঃরবং. সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, সমাজে-বিজ্ঞানে এবং আইন ও নীতিশাস্ত্র। এসব এ যুগে অর্থকর নয় বলে নিতান্তই অবহেলিত, অনন্যোপায় মন্দ-মাঝারি শিক্ষার্থীর পাঠ্যমাত্র। অথচ পরিবর্তিত পরিবেশে মূল্যবোধের কালিক রূপান্তর সম্ভব হতো এসব বিদ্যার নিষ্ঠ চর্চায়। আজ যে দেশে-সমাজে শ্রেয়োবোধের ও নীতি-নিষ্ঠার বা নৈতিক-চেতনার বা মূল্যবোধের ঐকান্তিক অভাব সর্বত্র দৃশ্যমান, তার কারণ এ-ই। বলাবাহুল্য, শাস্ত্রানুগত্যে বা শাস্ত্রশিক্ষায় নীতি-নিষ্ঠা আসে না। ন্যায়বোধ, আত্মসম্মানচেতনা ও নিয়ম-নীতির প্রতি আনুগত্যই এ নীতি-নিষ্ঠার ও নৈতিকতার জনক। শাস্ত্রানুগত্যে মন-মনন কেবল যান্ত্রিকতাদুষ্ট হয় মাত্র। যে কোন বিদ্যা জ্ঞান তথা শক্তি বা নৈপুণ্য দান করে। কিন্তু জ্ঞান মাত্রই বন্ধ্যা, যদি না তা তাৎপর্য সচেতন করে, অর্থাৎ জ্ঞান প্রজ্ঞার ও শ্রেয়োচেতনার স্তরে উন্নীত হলেই তা সার্থক হয়। যে বিদ্যা বা জ্ঞান মননে লালন পায় না, মনীষায় ও মনস্বিতায় যুক্ত হয় না, তা আবিষ্কারে উদ্ভাবনে, বিচারে বিশ্লেষণে জীবন ও সমাজ সম্পৃক্ত হয়ে বহুজনহিতে বহুজনসুখে নিয়োজিত হবার যোগ্যতা রাখে না। বিদ্যা অর্জনের লক্ষ্য অর্থোপার্জন হলেও তার সঙ্গে ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনের একটা আদর্শও থাকা আবশ্যিক। পেটের ক্ষুধা মেটানো প্রাণী হিসেবে মানুষের প্রাথমিক লক্ষ্য হলেও, মানুষের দেহ-মনের অশেষ সুপ্ত শক্তির বিকাশ সাধনই মানুষের চেতন-অবচেতন লক্ষ্য, এ লক্ষ্যে উত্তরণের অব্যাহত প্রয়াসের ফলেই মানুষ শাস্ত্র, সমাজ, সরকার, রাষ্ট্র তৈরি করেছে, আচারিক ও মানসিক জীবনের উৎকর্ষে মানুষ অভাবিতকে বাস্তব, অসম্ভবকে সম্ভব, অজানাকে জ্ঞাত করেছে। অন্য প্রাণী চলে সহজাত স্বভাবে, মানুষ প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করে, প্রকৃতিকে ও প্রতিবেশকে দাস ও বশ করে রচনা করেছে কৃত্রিম জীবন-পদ্ধতি, ভাষা, সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা-সংস্কৃতি। কাজেই মানুষের লক্ষ্য কেবল জীবিকা-সৌকর্যে নিবদ্ধ থাকতে পারে না, তার লক্ষ্য হবে মানবশক্তির চরম বিকাশ আর মানব অনুভবের, মনীষার ও মনস্বিতার পরম অভিব্যক্তি। মানব মহিমার, মনুষ্যত্বের ও মানবতার পরিপূর্ণ রূপে উত্তরণই হবে তার লক্ষ্য। বৃত্তিক শিক্ষার সঙ্গে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে চিত্তলোকের, চেতনা-জগতের, মানবিক বোধ-বুদ্ধি-বিবেকের অনুশীলনের ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ অনুশীলনে সাহিত্য-দর্শন-ইতিহাস-সমাজতত্ত্ব-মনোবিজ্ঞান-আইন ও নীতিতত্ত্ব সহায়ক হবে বলেই মানি। এমনি কোন ব্যবস্থা হলেই কেবল সমাজে সৎ-অসতের, সুনীতি-দুর্নীতির, ন্যায়-অন্যায়ের, ভালো-মন্দ-মাঝারির, ইতর-মহতের ভারসাম্য বজায় থাকবে। এর জন্যে প্রয়োজন ব্যক্তিক জীবনে আত্মমর্যাদাবোধের, দায়িত্ববোধের ও কর্তব্যবুদ্ধির অনুশীলন রাখা, সামাজিক জীবনে সৌজন্যের, শালীনতার ও পারস্পরিক আস্থার অঙ্গীকারে নিষ্ঠ থাকা ও কেবল নিরাপদে বাঁচতে দেয়ার নীতির অনুগত থাকা মাত্র। মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কে সমস্বার্থে সহিষ্ণুতার, সহযোগিতার ও সহাবস্থানের পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনে শিক্ষা ব্যবস্থায় এথিকস্ ও মরালিটি শেখানোর ব্যবস্থা রাখা আবশ্যিক। কাজেই আমাদের বিদ্যালয়ে সমকালীন হওয়ার স্বীকৃতি থাকা বাঞ্ছনীয়। পুরনো অকেজো রীতিতে গুরু-উস্তাদের প্রাপ্য ভক্তি-শ্রদ্ধায় দাবি পরিহার করে, বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর, ভক্ত-ভগবানের বা পিতা-সন্তানের পবিত্র সম্পর্কের কথা বিস্মৃতি হয়ে, শিক্ষাঙ্গনেরও পরিবত্রতা অস্বীকার করে জীবন-জীবিকার কল-কারখানার আর দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো ন্যায়ভিত্তিক যুক্তিগ্রাহ্য নিয়মনীতির অনুগত হয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এ যুগে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারেন, বেচা-কেনার বাজারে এর অতিরিক্ত কিছু প্রত্যাশা করা বাঞ্ছনীয় নয়- যুক্তিসঙ্গত নয় বলেই। শিক্ষক অতিরিক্ত সম্মান-শ্রদ্ধা পাবেন বিদ্বান বলে, কর্তব্যপরায়ণ বলে, ন্যায়নিষ্ঠ সজ্জন বলে। শিক্ষার্থীও পাবে স্নেহ তার বুদ্ধি, বিদ্যানুরাগ ও সৌজন্যের দরুন। এ হবে ব্যক্তিত্বের আকর্ষণজাত সম্পর্ক। জীবনের শারীর দিক অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মানুষের সব চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে একটা দার্শনিক চিন্তা-চেতনা না থাকলে, একটা আদর্শিক প্রেরণা ও লক্ষ্য না থাকলে মানুষের যৌথ জীবনে সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ হয় না। সৌজন্যই সংস্কৃতির, মানবতার ও মনুষ্যত্বর শেষ কথা। সে সৌজন্য অকৃত্রিম হলে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে মানুষের কাম্য ও প্রত্যাশিত কোন গুণেরই অভাব হবার কথা নয়। অর্থবিত্ত অর্জনের বিদ্যার সঙ্গে সৌজন্য অর্জনের বিদ্যার যোগ তাই জরুরী।
×