ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

চুলার পিঠে বসে পিঠা তৈরি দেখাও ছিল আনন্দের

শীতের পিঠা-পুলি ॥ বাঙালীর শেকড় সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২১ নভেম্বর ২০১৫

শীতের পিঠা-পুলি ॥ বাঙালীর শেকড় সংস্কৃতি

ছেলেবেলার শিশুপাঠের গল্পে-এক ছিল টোনা আরেক ছিল টুনি। টোনা বলিল টুনি পিঠা তৈরি করো। টুনি বলিল বাজার হইতে চাউল আনো, আটা আনো, গুড় আনো, তেল আনো, খড়ি আনো, পাশের বাড়ি হইতে আগুন আনো...। এই গল্প চিরন্তন হয়ে আছে, যেমন চিরকালীন হয়ে আছে বাঙালীর শেকড়ের সংস্কৃতির পিঠা। বাংলা ভাষা সাহিত্যে কাব্যে গানে কবিতায় নাটকে চলচ্চিত্রে শীতের পিঠা এবং মেয়ে জামাইকে শীতের পিঠার নিমন্ত্রণের পালা নানা অনুষঙ্গে যোগ হয়েছে। দিনে দিনে এর পরিধি বেড়েছে। বাঙালীর পিঠা এখন দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশ বিভূঁইতে পৌঁছেছে। বিশ্বের দেশে দেশে শীতকাল আসে, তবে বাঙালীর শীতকাল পিঠা ছাড়া একেবারেই বেমানান। শীত আসবে, উনুনে পিঠা চড়বে না তা কি হয়! বর্তমানে শীতের কমন পিঠা ভাপা। হেমন্তের শুরুতে গোধূলী বেলায় হালকা কুয়াশা নেমে আসতে না আসতেই দেশের প্রতিটি শহরে রাস্তার ধারে এবং গ্রামের হাটে ভাপা বানাবার মাটির ছোট্ট চুলায় মাটির পাতিলে পানি ভরে মুখ লেপে ছোট করে তার ওপর পাতলা কাপড়ের আস্তরণ দিয়ে বসে পড়ে পিঠার কারিগর। সঙ্গে থাকে চালের আটা, গুড়, নারকোল আর ছোট্ট বাটি (মাপ অনুযায়ী)। আটা নারকেল গুড় পরিমাণ মতো বাটিতে ভরে পাতলা কাপড়ে মুড়ে পাতিলের ওপর বসিয়ে আগুনের তাপে পানির বাষ্প উঠে তৈরি হয় ভাপা পিঠা। পথের ধারে বেচাকেনার এই ভাপা পিঠা শখের বসে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের পিঠা বানানোর আয়োজন শুরু হয়ে যায়। এই ভাপা পিঠার স্বাদেই শীতের পিঠাপুলির দুয়ার খুলে যায়। তারপর আর ঠেকায় কে...। শহুরে জীবনে শীতের পিঠা অনেকটা ‘আর্টিফিশিয়াল’। অর্থাৎ শীতের সময়টায় হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে প্রায় সকল ধরনের পিঠা বিক্রি শুরু হয়। পৌষ মাস পড়লেই বিভিন্ন সংগঠনের পিঠা উৎসব ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। তবে এর মধ্যেও পিঠা উৎসবে বাঙালীর চিরন্তন সত্ত্বাটুকু হারিয়ে যায়নি। উৎসবের আয়োজনকারীরা নতুন পুরনো সকল ধরনের পিঠা বানিয়ে আনার কথাটি অংশগ্রহণকারীদের আগেভাগেই বলে দেয়। ফলে দেখা যায় আগের রাতে পিঠা বানানোর শিল্পীরা (পরিবারের সকল সদস্যই) নানা জাতের পিঠা বানাতে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে। স্টলগুলোতে কত জাতের পিঠা যে দেখা যায়...। এইসব পিঠার নামও সুন্দর। প্রকৃতির অনুষঙ্গের সঙ্গে মিল রেখে নামকরণ করা হয়। দেখা যায়, একই ধরনের পিঠা নানা ফর্মে বিচিত্র নামে পরিবেশিত হয়েছে। শহরের পিঠা যতই ফ্যাশনেবল বা আর্টিফিশিয়াল হোক, এর শেকড় গ্রামে। গাঁয়ের মাটির গন্ধেই পিঠার ম ম সুবাস। একেক অঞ্চলে একেক পিঠার প্রচলন। পিঠার রকমফেরও আছে। তবে গোড়াপত্তন এক জায়গায়। যেমন গড়গড়ে পিঠা। বৃহত্তর বগুড়া ও রংপুর অঞ্চলে চালের আটা ছেনে হাতের মুঠোয় ছোট বড় মন্ড করে মাটির পাতিলে ফুটন্ত পানিতে ছেড়ে দিলে একেকটি দলা হয়ে যায়। এর নাম গড়গড়ে পিঠা। রাজশাহী অঞ্চলে এর নাম দমদমা। পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে এই শক্ত পিঠার সঙ্গে লবন মরিচ মিশিয়ে আরেক নামকরণ। পাটিসাপটা পিঠাকে বলতে গেলে সর্বজনীন পিঠা বলা যেতে পারে। এমন কোন স্থান নেই যেখানে এই পিঠার কদর নেই। চালের আটা মিষ্টি দিয়ে গুলে তাওয়ায় ছড়িয়ে তার মধ্যে গুড় দিয়ে নারকেল কোরা ভাজা ভরে ডিমভাজির মতো করে বানানো হয়। পাটিসাপটার ভিতরের মসলা আগেই বানানো হয়। পাটিসাপটার ভিতরে অনেকে নারকেলের বদলে ক্ষির বা ফিরনিও দেয়। দুধ পিঠার নাম শুনলেই জিহ্বায় জল আসে। দুধ পিঠার যে কী স্বাদ! মাটির হাঁড়ির একাংশ গোলাকৃতি ফাঁকা করে চুলায় বসিয়ে তার মধ্যে চালের আটা গুলে ভেজে রাখা হয়। এর নাম চিতই পিঠা। আরেক হাঁড়িতে দুধের মধ্যে গুড় মিশিয়ে জাল দিয়ে কিছুটা ঘন করে তার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয় চিতই। রাতভর দুধে ভিজে চিতই নরম হয়ে যায়। শীতের সকালে এই পিঠার যে কী স্বাদ! কুশলি পিঠার নাম অনেক। কেউ বলে পুলি পিঠা, কেউ বলে কুলি পিঠা। শীতের পিঠাপুলি কথায় সকল ধরনের পিঠার সমষ্টিগতভাবে এসেছে পিঠা, সঙ্গে পুলি এসেছে পিঠার মহাসঙ্গী হয়ে। পুলি পিঠা দেখতে অনেকটা ইংরেজী অক্ষর ‘ডি’ এর মতো। আটা ছেনে বেলুন দিয়ে ছোট রুটির মতো বানিয়ে তার মধ্যে ফিরনি পায়েস বা নারকেল কোরা অথবা ঝাল খাবার ভরে ডি এর মতো ভাঁজ করে এঁটে দিয়ে তেলে ভেজে নিলেই হয়ে গেল পুলি পিঠা। কুশলি পিঠা হিসেবেও এর পরিচিতি আছে। এই পিঠা ঝাল মিষ্টি দুই পদেরই হয়। প্রায় একইভাবে ভাজা হয় আরেক পিঠা যার পরিচিতি তেল পিঠা নামে। তবে এই পিঠার ভিতরে কিছু থাকে না। মিষ্টি দিয়ে আটা গুলে তেলে ভাজলেই হয়ে গেল তেল পিঠা। এই তেল পিঠা নিয়ে গ্রামাঞ্চলে অনেক মজার ঘটনা আছে। তেল পিঠা ভাজতে বসলে কেউ এসে যদি বলে এই পিঠা ফুলবে না এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা না ফুললে বলা হয় পিঠা ভাঞ্জি দেয়ার কেরামতি দেখাল। রসের পিঠা- বিশেষ করে খেজুর রসে চিতই পিঠা ডুবিয়ে রেখে বানানো। এই পিঠার কদর বেশি দক্ষিণাঞ্চলে। অবশ্য ওই এলাকায় খেজুর গাছের বাগান বেশি। হালে নকশি পিঠা নামে নানা ধরনের পিঠা বের হয়েছে। মূলত এই পিঠা আগের সব পিঠার আধুনিক সংস্করণ। বাজারে নানা ধরনের পিঠার ছাঁচ পাওয়া যায়। মিষ্টি দিয়ে আটা গুলে বা ছেনে নিয়ে ছাঁচের মধ্যে ফেলে তেলে ভেজে নিলেই হয়ে গেল নকশি পিঠা। শীতের পিঠার শেকড় গ্রামে। একটা সময় শীতের পিঠার জন্য শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। গ্রামের আঙিনায় মাটির চুলার ওপর মাটির হাঁড়িতে পিঠা বানানোর যে দৃশ্য, তা এখন আর সহসা মেলে না। শীতের সন্ধ্যা ও রাতে পিঠা তৈরির সময় চুলার চারপাশে বসে পিঠা বানানো দেখার মধ্যেও আছে আনন্দ। আজ আর কেউ শীতের পিঠা খাওয়ার আয়োজন করে গ্রামে যায় না। পিঠাপুলির সঙ্গে বাঙালীর মিলনমেলার সেই আনন্দও ফিকে হয়ে আসছে। এখন সবই যান্ত্রিকতার মোড়কে মিশে গেছে। তারপরও শীতের আগমনে পিঠাপুলির নিমন্ত্রণ চিরন্তন হয়েই থাকবে। শীত চলে গেলে টোনাটুনির গল্পের মতো পিঠাপুলি স্মৃতি হয়ে টুনটুনটুন সুর তুলবে। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×