ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লিট ফেস্টের সমাপ্তি

পৃথিবীর সব দেশ এক ছাতার নিচে আসার দিকেই এগোচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২২ নভেম্বর ২০১৫

পৃথিবীর সব দেশ এক ছাতার নিচে আসার দিকেই এগোচ্ছে

মনোয়ার হোসেন ॥ সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই বিজ্ঞানীদের ভিন জগতের মানুষ বলে মনে করেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বিজ্ঞানীরাও বাকি সব মানুষের মতো শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীত, খেলাধুলাসহ নানা বিষয়ে আগ্রহী হয়ে থাকে। বিজ্ঞানের একটি অসম্ভব শক্তি হচ্ছে এটি চাইলেই বিশ্বের সকল দেশকে নিয়ে আসতে পারে এক ছাতার নিচে। দিনে দিনে সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। এভাবেই বিজ্ঞানীদের মানবিক প্রকৃতি ও সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে নিজের ধারণাকে উপস্থাপন করলেন নোবেলজয়ী মার্কিন চিকিৎসাবিজ্ঞানী হ্যারল্ড ভারমাস। শনিবার ঢাকা লিট ফেস্টের সমাপনী দিনের এক অধিবেশনে এসব কথা বলেন তিনি। হ্যারল্ড এদিন অংশ নেন ‘জীবনে বিজ্ঞান ও শিল্প’ শীর্ষক সেশনে। বিশ্ব পরিম-লে বাংলাদেশের বিজ্ঞানের অবদান নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বললেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় বাংলাদেশ তেমনভাবে এগোয়নি। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে সরকার নতুন করে চিন্তা করতে পারে। গবেষণার জন্য পৃথক তহবিল করতে হবে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক টেনে প্রথম জীবনে সাহিত্যে স্নাতক করা এই বিজ্ঞানী বলেন, বিজ্ঞানকেও সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য-কর্মগুলোর একটি পৃথক ভাষা আছে। এ বিষয়ে প্রচুর মানসম্মত বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার মনে হয় পাঠকরা সেই বইগুলোও পাঠ করতে পারেন। সব মিলিয়ে বিজ্ঞান হচ্ছে অনেক বেশি মানবিক কার্যক্রম। বৈশ্বিক রাজনীতি প্রসঙ্গে এই বিজ্ঞানী বলেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ধারা নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হতে থাকে, যা রাষ্ট্রীয় উন্নতিতে প্রভাব ফেলে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দিকনিদের্শনা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি একসঙ্গে কাজ করে তবে রাষ্ট্রের উন্নয়নে সময় লাগে না। সেজন্য নেতৃত্বের স্বচ্ছতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব প্রাকৃতিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে হ্যারল্ড বলেন, এমনিতেই পৃথিবী জলবায়ু পরিবর্তনের খুব ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনকে আমরা ঠেকাতে পারব, না পারলেও ক্ষতির পরিমাণ কমাতে কাজ করতে হবে। আর সেখানেই রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বকে কাজ করতে হবে। স্থাপত্যশিল্পের প্রতি রয়েছে হ্যারল্ডের বিশেষ অনুরাগ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমেরিকাতেও লুই কানের নক্সায় একাধিক স্থাপনা দেখেছি আমি। যখন জানতে পারলাম, এদেশের সংসদ ভবনের নক্সাটিও তার তৈরি, তখন সেটি দেখার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। আমি যতদূর জানি স্থাপত্যশৈলীতে এ ভবনটি অসাধারণ। ঢাকা লিট ফেস্টের সমাপনী দিনটিও ছিল দীপ্তিময়। শনিবার ছুটির দিনে সকাল থেকে রাত অবধি গোটা উৎসব প্রাঙ্গণ ছিল আনন্দময়। দিনভর শিল্প-সাহিত্য নিয়ে চলে আলোচনা। ফাঁকে ফাঁকে দেশ-বিদেশের লেখকদের আড্ডা। উৎসব আঙ্গিনা বাংলা একাডেমির গোটা প্রাঙ্গণজুড়ে সজ্জিত ছিল বেশ কয়েকটি মঞ্চ। শেষ দিনে সব মঞ্চই আলোকিত করেন দেশ-বিদেশের বরেণ্য লেখক-কবি-সাহিত্যক, শিল্প-সমালোচক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীসহ নানা ভুবনের উজ্জ্বল মানুষ। তাদের প্রাণোচ্ছল কথায়, আলোচনায় উঠে এলো বিশ্বসাহিত্যের নানা দিক। তেমনইভাবে উঠে এলো বাংলা সাহিত্যের ভুবন। সব মিলিয়ে মননের আলোকিত আয়োজনে শেষ হলো এ আন্তর্জাতিক সাহিত্য আসর। তিন দিনের সম্মেলনে অংশ নিলেন বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফিলিস্তিন, কেনিয়াসহ পৃথিবীর ১৪টি দেশের ২৫০ জন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ নানা ভুবনের উজ্জ্বল ব্যক্তিরা। সাধারণত সাহিত্যের আলোচনা সভা হয় গুরুগম্ভীর। গভীর কোন বিষয় নিয়ে সুগভীর আলোচনা করেন বরেণ্য ব্যক্তিরা। ধৈর্য নিয়ে তা উপভোগ করেন শ্রোতারা। আবার কেউ ধৈর্য হারিয়ে উঠেও যান। তবে এ উৎসবের সেশনগুলো ছিল অন্যরকম। গুরুগম্ভীর আলোচনা হলেও তার আঙ্গিকটা ছিল ভিন্ন। আলোচকরা আড্ডার ছলে, সহজভাবে মেলে ধরেছেন কঠিন কথাগুলো। অনেকটা বৈঠকী আড্ডার ভঙ্গিমায় তারা শিল্প-সাহিত্যকে উপস্থাপন করেছেন। দর্শক-শ্রোতাদের কাছে তা ছিল চিত্তাকর্ষক। শেষদিনে উৎসব শুরু হয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। সকাল ৯টায় মূল মঞ্চে দেখানো হয় ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘ইন্ডিয়াস ডটার’। তারপর শুরু হয় সমাপনী দিনের নির্ধারিত ৩০টি অধিবেশন। প্রথম দিনের মতোই শেষ দিনের উৎসবেও আপন ভাবনার কথা বলেছেন ভারতের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নয়নতারা শেহগাল। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর এই ভাতিজি এদিন রাজনীতির সঙ্গে তাঁর নিজস্ব লেখালেখির সম্পর্ক এবং ভারতের উদারনৈতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাসহ চলমান নানা বিষয়ে আলোকপাত করেন। তার আত্মজীবনীর লেখিকা ঋতু মেননও অংশ নেন এ অধিবেশনে। জওয়াহেরলাল নেহরুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা তুলে ধরে বলেন, বাবা-মার পরে তিনি ছিলেন আমার তৃতীয় অভিভাবক। আমার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, সাহিত্যচর্চা- সবকিছুতেই তিনি আমাকে প্রভাবিত করেছেন। নিজের লেখালেখি সম্পর্কে বলেন, প্রকৃত অর্থে লেখক তার লেখার বিষয়কে বেছে নেন না বরং বিষয়ই লেখককে তাড়িত করে। এ কারণেই আমার সাহিত্যকর্মে রাজনীতির সঙ্গে ইতিহাসের সমন্বয় ঘটেছে। ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, বহু ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতির সমন্বিত দেশটিকে এখন হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারা চলছে। হিন্দু সম্প্রদায়কে ব্যবহার করা হচ্ছে এ অপতৎপরতায়। তবে আমরাও বসে নেই। চালিয়ে যাচ্ছি আমাদের প্রতিবাদ। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে দুপুর আড়াইটায় শুরু হয় সাহিত্য নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা। তাতে ‘সবার জন্য সাহিত্য’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, ভারতের কবি ও সাংবাদিক পৌলমী সেনগুপ্ত, কবি আতা সরকার, কথাসাহিত্যক আনিসুল হক ও কথাসাহিত্যিক আন্দালীব রাশদী। ঘরোয়া আড্ডার ভঙ্গিমায় তারা তুলে ধরেন সাহিত্যের অলিগলি। ইমদাদুল হক মিলনের সঞ্চালনায় এ সময় বক্তারা বলেন, জীবনধারণের জন্য খাদ্য যেমন অপরিহার্য, সাহিত্য তেমন নয়। কিন্তু জীবনের সঙ্গে যখন আত্মা জড়িত, তখন ওই আত্মার অন্যতম খাদ্য হচ্ছে সাহিত্য। সাহিত্য আত্মাকে কোমল করে, ভালবাসতে শেখায়। একাডেমির বর্ধমান হাউসে দুপুরে বসে প্রথিতযশা কবিদের কবিতা পাঠের অধিবেশন। শামীম রেজার সঞ্চালনায় এ অধিবেশনে কবিতা পাঠ করেন- মুহম্মদ নুরুল হুদা, নির্মলেন্দু গুণ, কামাল চৌধুরী, সাজ্জাদ শরিফ ও ভারতের কবি চিন্ময় গুহ। কবিতার চরণে চরণে মানুষের প্রেম, ভালবাসা ও অনুভূতি তুলে ধরেন। নিজের কবিতা ছাড়াও বিদেশী কবিদের কবিতা পাঠ করেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রেম ও অনুভূতির কবিতা পাঠ করেন। একই সঙ্গে কবিতার মানে তুলে ধরেন। কামাল চৌধুরী পাঠ করেন তার লেখা স্মৃতিকাতরতা, শেষ বেলার ট্রেন, অতল, তোমার অক্ষরসহ বেশ কয়েকটি কবিতা। অন্যদিকে ভারতের কবি চিন্ময় গুহ কবিতা পাঠ ছাড়াও মানুষের প্রেম, অনভূতি প্রকাশের নানা দিক তুলে ধরেন। এর আগে একই মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়। ‘অনুবাদের অধিকার’ শীর্ষক অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয় একাডেমির আমতলার নিকটবর্তী কসমিক টেন্টে। বিশেষ করে কবিতা যখন অনুবাদিত হয় এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় তখনই তার সূক্ষ্ম অনুভূতি হারিয়ে যায়। কেন হারিয়ে যায় কিংবা আসল কবিতা কোনটি সে বিষয়ে আলোচনা করেন আলোচকরা। অরুণাভ সিনহার সঞ্চালনায় এ পর্বে আলোচক হিসেবে অংশ নেন ফরিদা হোসেন, মাসুদ আহমেদ, সায়েদা আরিয়ান জামান। ‘নগর আমার হৃদয়ে’ বিষয়ে ভিন্নধর্মী এক সেশন বসেছিল বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান স্মৃতি মিলনায়তনে। উৎসব উপলক্ষে এ মঞ্চটির নাম দেয়া হয় কেকে টি মঞ্চ। নগর সভ্যতার বিকাশ সেই সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে। নগরকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠা- সংস্কৃতি ও সাহিত্য কী শুধুই নাগরিক সাহিত্য নাকি জনমানুষের হৃদয়ের সাহিত্য হয়ে উঠেছে প্রায়শ- এ বিষয়ে আলোচনা করেন সলিমুল্লাহ খান, তিলোত্তমা মজুমদার, ইমতিয়ার শামীম। সঞ্চালনা করেন হামীম কামরুল হক। ‘ফেমিনিজম : দি নেক্সট এফ ওয়ার্ড’ বিষয়ক অধিবেশন ছিল একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের লনে। এ অধিবেশনে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেন ভারতীয় সাংবাদিক শোভা দে, ভারতের নারীবাদী প্রকাশনা সংস্থা কালী ফর উইমেন এবং জুবানের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক উর্বশী বাটালিয়া ও প্যারিসে রয়েল শেক্সপিয়ার কোম্পানি হয়ে ১০০টি নাটকের নিদের্শক জুথ কেলি এবং তাসাফি হোসেন। পৌনে এক ঘণ্টার এ অধিবেশনে তর্ক-বির্তকের মধ্য দিয়ে তারা নারীবাদের নবজাগরণের নানা দিক তুলে ধরেন। তাদের যুক্তি-তর্ক যাই হোক না কেন, তাদের বক্তব্য ছিল নারীবাদ উন্নয়নের কথা। সাহিত্যচর্চা ছাড়াও সমাজকল্যাণের দিকে ঝুঁকতে হবে, তবেই নারীবাদ আরও প্রতিষ্ঠিত ও দৃঢ় হবে। আদিবাসী নিয়ে একটি সেশন ছিল কেকে টি মঞ্চে। সাহিত্যে আদিবাসী বা নৃগোষ্ঠীর ভূমিকা কী রকম আছে এবং ভবিষ্যতে কী রূপ- এ বিষয়ে আলোকপাত করেন প্রখ্যাত লোক ইতিহাসবিদ ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, আনিসুল হক, কুমার চক্রবর্তী, সঞ্জীব দ্রং। সঞ্চালনা করেন জাফর সেতু। বিকেলে বর্ধমান হাউসের পূর্বপার্শে^র লনে মঞ্চস্থ হয় আদি লোকগাঁথা ‘মনসা’ অবলম্বনে লোকনৃত্যনাট্য ‘বেহুলা লাচারি’। এটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশের লুবনা মরিয়াম।
×