ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনে প্রাণের উচ্ছ্বাস

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২২ নভেম্বর ২০১৫

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনে প্রাণের উচ্ছ্বাস

ঘড়িতে সময় সকাল ১০টা। মুহূর্তের মধ্যে কালো গাউন, ক্যাপ, টাই পরা গ্র্যাজুয়েট আর ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে ভরে উঠল গোটা ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্পটে ছবি তোলায় ব্যস্ত সবাই। একক, দ্বৈত, গ্রুপসহ বিভিন্ন ধরনের ও ভঙ্গিতে ছবি তোলা শুরু করল তারা। যেন ছবি তোলার প্রতিযোগিতা চলছে। এ দৃশ্য রাজধানীর বুকে কৃষি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনের। গত ১৬ নবেম্বর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমার্বতন অনুষ্ঠিত হয়। সমাবর্তনে উপলক্ষে অংশগ্রহণকারী গ্র্যাজুয়েটদের পদভারে মুখর হয়ে উঠেছিল গোটা ক্যাম্পাস। সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করতে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বছর আগে পাস করে যাওয়া মাহমুদুল হাসান। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর কথা খুবই মনে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে যা শিখেছি তা অন্য কোথাও থেকে শেখা যাবে না। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আজ সার্টিফিকেট নিতে এসে আমি আবার যেন ক্যাম্পাস জীবনে ফিরে এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতির হাত থেকে মেধার স্বাক্ষর রাখার জন্য সনদপত্র গ্রহণ করা জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় সময়। এমন সময় সারাজীবনে একবারই আসে। আর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের নিকট সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি ছিল ১৬ নবেম্বর। কারণ ওই দিনটি ছিল শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম সমাবর্তনের দিন। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সমাবর্তনের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। সমাবর্তন এলাকা, একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, হলসমূহ, রাস্তাসহ প্রবেশদ্বারে আগে থেকেই আলোকসজ্জা করা হয়েছিল। সড়ক, গাছপালা ও ককশিটের গায়ে শিল্পীর তুলির ছোঁয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছিল শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অন্যরকম দিন। ক্যাম্পাস যেন নবীন-প্রবীণের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। সমাবর্তনের মূল কর্মসূচী শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের সামনে কৃষিতত্ত্ব মাঠে বিশাল প্যান্ডেলে। দুপুর ২টায় গ্র্যাজুয়েটরা সমাবর্তন প্যান্ডেলে আসন গ্রহণ করেন। বিকেল ৩টা ১ মিনিটে জাতীয় সঙ্গীত ও কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবর্তনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। মাননীয় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বিকেল ৩টা ৮ মিনিটে সমাবর্তন উদ্বোধন করেন। এরপর উপাচার্য প্রফেসর মোঃ শাদাত উল্লা স্বাগত বক্তব্য রাখেন। উপাচার্য প্রফেসর মোঃ শাদাত উল্লা বলেন, এ দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের অন্ন যোগাতে, কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে সচল রাখতে এ প্রতিষ্ঠানের গ্র্যাজুয়েটগণই অগ্রদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এ দেশের মৌলিক ও প্রাথমিক কৃষি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এই ইনস্টিটিউটের গ্র্যাজুয়েটগণই। উনবিংশ শতাব্দীর দুর্ভিক্ষ ও বিংশ শতাব্দীর খাদ্যাভাব নিরসনে এ প্রতিষ্ঠানের গ্র্যাজুয়েটগণ নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিয়ে কৃষিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়ন করেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টগণ এ ইনস্টিটিউটের কোন উন্নয়ন সাধন না করে দিনের পর দিন অবনমিত করার নানান প্রক্রিয়া চালু রাখে। এর উন্নয়নের লক্ষ্যে ইনস্টিটিউটের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ছাত্রছাত্রীগণ বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ইনস্টিটিউটের এলামনাইগণ প্রধানমন্ত্রীর নিকট এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার আবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালে বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউটকে রূপান্তর করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে তা লেখা থাকবে বলে তিনি জানান। এরপর বিকেল ৩টা ১৪ মিনিটে দেশের সার্বিক উন্নয়ন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষা, গবেষণায় অসামান্য অবদান রাখায় প্রধানমন্ত্রী কৃষকরতœ শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী ‘ডক্টর অব দ্য ইউনিভার্সিটি’ প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রতি শিক্ষাবর্ষে প্রথম হওয়া ২২ জন স্বর্ণপদক এবং স্নাতকে ২১১০ জন, স্নাতকোত্তরে ৫১২ জন এবং পিএইচডিতে তিনজন গ্র্যাজুয়েটকে ডিগ্রী প্রদান করা হয়। প্রফেসর ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস পিএইচডি ও এমএস ডিগ্রীধারীদের নাম চ্যান্সেলরের সমীপে উপস্থাপন করলে চ্যান্সেলর সাইটেশন পড়ে ডিগ্রীধারীদের ডিগী প্রদান করেন। বিকেল ৩টা ২৩ মিনিটে বিভিন্ন অনুষদের ডিনরা স্নাতক গ্র্যাজুয়েটদের ডিগ্রী গ্রহণের জন্য চ্যান্সেলরের কাছে উপস্থাপন করেন। ৩টা ৩০ মিনিটে চ্যান্সেলর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের স্বর্ণপদক প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে প্রতি শিক্ষাবর্ষে প্রথম হওয়া ২২ জন স্বর্ণপদক এবং স্নাতকে ২১১০ জন, স্নাতকোত্তরে ৫১২ জন এবং পিএইচডিতে তিনজন গ্র্যাজুয়েটকে ডিগ্রী প্রদান করা হয়। এরপর সমাবর্তন বক্তা হিসেবে ন্যাশনাল এমিরেটাস সায়েন্টিস্ট কৃষিবিদ ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা বলেন, কৃষি দিন দিন নানান রকম বৈরী পরিবেশের সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। দেশের প্রায় অর্ধেক পরিমাণ আবাদি জমি কোন না কোন বৈরী পরিবেশের শিকার। ফলে আজ কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার ধরনেও পরিবর্তন আনা জরুরী। আজ যারা গ্র্যাজুয়েট হিসেবে সনদ গ্রহণ করছেন, তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হবে। অবশ্যই সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনারা প্রস্তুত এটি আমি বিশ্বাস করি। বিশেষ অতিথি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, দেশে আজ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি বছরে ৩৮ কোটি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে, এটি একটি বিশ্বরেকর্ড। দেশে শিক্ষার হার দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭টি এবং বেসরকারী ৮৩টি, যাতে প্রায় ত্রিশ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন ও গবেষণা করছে। এটিও এ যাবতকালের সর্বোচ্চ সংখ্যা, যেগুলোর অধিকাংশই স্থাপিত হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। আমরা মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষ হতে নানাভাবে এগুলোর উন্নয়নে সহায়তা করছি। আমরা শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের যথাসম্ভব চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এরপর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোঃ শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া। ৩টা ৫০ মিনিটে চ্যান্সেলর ও ভাইস চ্যান্সেলর একে অপরের সঙ্গে ক্রেস্ট বিনিময় করেন। ৩টা ৫৫ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর আবদুল হামিদ ভাষণ প্রদান করেন। তিনি ২০৫০ সালকে সামনে রেখে দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা ও খাদ্য নিরাপত্তার আলোকে কৃষিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কৃষি বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি কৃষি শিক্ষার গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, এক সময় দেশে কৃষি ব্যবস্থা সনাতনী প্রথানির্ভর হলেও আজ তাতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। ফলে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এজন্য তিনি কৃষক, কৃষি বিজ্ঞানী, শিক্ষক, গবেষক, সম্প্রসারণকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির কারণে কৃষি উৎপাদন পূর্বের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। রেজিস্ট্রার শেখ মোঃ রেজাউল করিম সমাবর্তন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। পরে রাষ্ট্রপতি সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। সন্ধ্যায় এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়।
×