মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সংক্ষেপে সাকা নামেই বহুল পরিচিতি তার। এই পরিচিতি সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে নয়, নিন্দিত এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম হিসেবেই চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে নিজেকে পরিচিতি করাতে সক্ষম হয়েছেন। পিতা তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরী ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী স্বঘোষিত রাজাকার। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার এবং ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। পিতা ফকার সকল অপকর্মের দীক্ষা সাকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল প্রোথিত। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত রাউজান ফকা জমানায় যেমন জিম্মি ছিল, তেমনি তার অপকর্মের সকল চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাকাচৌর কাছেও শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নয়, রাউজানবাসীই ছিল অসহায়। কারণ তার বিরোধিতা করে কেউ রক্ষা পেয়েছেন এমন রেকর্ড নেই। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চূড়ান্ত বিচারে ফাঁসির দ-ে দ-িত হয়ে তার শেষ ঠিকানা হয়েছে রাউজানের গহিরার নিজ বাড়ির আঙ্গিনার কবরস্থানে। নিস্তব্ধ নীরবতায় এই খলনায়কের শেষ পরিণতি দেখে যেতে পেরে রাউজানের আপামর জনতার মাঝে অতীতের অপমান ও নিগৃহীত হওয়ার দিকটিই যেন নীরবে উদয় ঘটেছিল।
নিন্দিত সাকা। খলনায়ক সাকা। মূর্তিমান আতঙ্ক সাকা। খুন, অপহরণ, গুমের নায়ক সাকা। সর্বোপরি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতাকারী সাকা। মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার নায়ক সাকা। রাজনীতির ডিগবাজ সাকা। মুসলিম লীগ, এনডিপি, জাতীয় পার্টি এবং সর্বশেষ বিএনপির রাজনীতিতে থাকাবস্থায় তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দ-িত হয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হলো। শনিবার রাতে তার ও আরেক রাজাকার মুজাহিদের প্রাণদ- কার্যকর হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সাকা ও তার পরিবারের সদস্যরা নাটকের যে শেষ দৃশ্যটি মঞ্চায়ন করেছেন তাও উৎসুক মানুষের মনে প্রশ্নের পর প্রশ্নের উদ্রেক ঘটিয়েছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
সীমাহীন ঔদ্ধত্যপূর্ণ একটি জীবনের অপরিহার্য পরিণতি ফাঁসির দড়ি। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জীবনের যবনিকাপাত যে এভাবে ঘটবে তা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী আরও অনেকেই আছেন। কিন্তু সাকার তুলনা শুধুই সাকা। তার সঙ্গে আর কারোরই তুলনা চলে না। সবচেয়ে বেশি সংশয় ছিল সাকাচৌর সাজা নিয়ে। অবশেষে ফাঁসির দ- কার্যকরের মধ্য দিয়ে দূর হয়ে গেল সকল অনিশ্চয়তা। প্রমাণিত হয়ে গেল শুধু প্রবল ক্ষমতা ও বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে যা ইচ্ছা তাই করে পার পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং এর পরবর্তীতে দশকের পর দশক যার ভয়ে কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করতে পারত না, তার করুণ ও নির্মম পরিণতির সময়ে রাউজানের কেউ টু শব্দ করল না। এটাই তার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হিসেবে বিবেচনায় এসেছে। শুধু রাউজান নয়, পার্শ্ববর্তী উপজেলা রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি এমনকি হাটহাজারী উপজেলার কিছু অংশ জুড়েও সাকার দৌরাত্ম্য, নিপীড়ন, নির্যাতনের ঘটনার ইতিহাস লিখে শেষ করা যাবে না। তার অপকর্মের বিরুদ্ধে যারাই সামান্যতম নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেছে তাদেরই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। রাউজানের মূর্তিমান আতঙ্ক সাকা চৌধুরী ছিলেন ভারতীয় মারদাঙ্গা ছবির জীবন্ত খলনায়ক।
সাকা চৌধুরী চট্টগ্রাম তথা দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত একটি নাম। তবে এই আলোচনা যতটা না তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কিংবা ভূমিকার জন্য, তারচেয়েও বেশি তার ব্যাঙ্গাত্মক-বিদ্রƒপে ভরা বাক্যবাণের কারণে। সব সময় সংবাদ মাধ্যমে তাকে নিয়ে আলোচনা পছন্দ করতেন তিনি। তার মুখে কোন লাগাম ছিল না। বলে যেতেন যখন যেমন ইচ্ছা। দম্ভোক্তি ও বিদ্রƒপ এতটাই তীর্যক ছিল যে, তা প্রায়শই শ্লীলতার সীমা ছাড়িয়ে যেত। অসম্ভব দাম্ভিক এই সাকা ভাবতেন, তাকে আটকে রাখা সম্ভব নয়। তাকে গ্রেফতার করলে পুরো চট্টগ্রাম অচল হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুধু আটক নয়, ঝুলতে হয়েছে ফাঁসির দড়িতে। অথচ তার নিজ উপজেলা রাউজানেও টু-শব্দটি হয়নি।
শুধু সংসদ সদস্য হওয়াই যে জনপ্রিয়তার মানদ- নয় তার প্রমাণ সাকা চৌধুরী। রাউজান, রাঙ্গুনীয়া ও ফটিকছড়ি থেকে ৬ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি ফলাও করে প্রচারও করা হয়। বিএনপি একটি বড় দল। কিন্তু বিএনপিতে আসার পূর্বে মুসলিম লীগ এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত এনডিপি থেকেও এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাই বলে ব্যক্তি হিসেবে সাকা যে খুব জনপ্রিয় ছিলেন তা নয়। বরং তার ভোটে জেতার নেপথ্যে ছিল পিতা ফকা চৌধুরীর মতোই বিশেষ অপ কৌশল। রাউজানে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু ভোটার। ভোটের আগের রাতে ওই এলাকাগুলোতে এমনভাবে ভয়ভীতি দেখানো হতো যে পরদিন তারা ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সাহস পেত না।
সাকার পিতা ফকা চৌধুরীও সংখ্যালঘু এলাকায় গিয়ে বলতেন, ‘আপনারা আমাকে ভোট দেবেন তো? জবাবে ভোটাররা ভয়ে বলতেন, আপনাকে বাদ দিয়ে আর কাকে ভোট দেব। তখন ফকা চৌধুরীর মন্তব্য ছিলÑ আপনাদের ভোট আমি পেয়ে গেছি। কষ্ট করে ভোট কেন্দ্রে যেতে হবে না।’ এ কৌশলেই সফল হতেন ফকা চৌধুরী। সাকা চৌধুরীও সেভাবেই এমপি হয়েছিলেন ছয়বার।
বিএনপির কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হলেও চট্টগ্রামের বিএনপির রাজনীতিতেও তার উল্লেখ করার মতো কোন প্রভাব কখনই ছিল না। চট্টগ্রামের তৃণমূল বিএনপি মূলত আবদুল্লাহ আল নোমান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ও ডাঃ শাহাদাত হোসেন প্রভাবিত। আন্দোলন সংগ্রাম তথা রাজনীতির কোন কর্মসূচীতে সাকা চৌধুরীর উপস্থিতি খুব একটা দেখা যেত না। বিএনপিতে উড়ে এসে জুড়ে বসা একজন নেতা ছিলেন সাকা। অনেক সিনিয়র নেতা স্থান হয়নি দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে। অথচ মুসলিম লীগ থেকে জাতীয় পার্টি ও এনডিপি হয়ে বিএনপিতে ঢুকেই তিনি হয়ে যান দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা।
স্বাধীনতাবিরোধী আরও অনেকেই আছেন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য গর্ববোধ করতেন একমাত্র সাকাচৌ। পিতা ফকা চৌধুরীও একজন রাজাকার ছিলেন, অখ- পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেনÑ এ নিয়ে গর্বের সীমা ছিল না তার। বিভিন্ন মিডিয়ায় তার দেয়া বক্তব্য এখন রয়েছে ইউটিউবে। নিজ দল ও দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করতেও ছাড়েননি। বলেছেন, ‘আগে কুকুর লেজ নাড়ত, এখন লেজ কুকুরকে নাড়ায়।’ দল থেকে একবার বহিষ্কার হওয়ার পর ফের দলে ফেরা প্রশ্নে বলেছিলেন, ‘তালাক হওয়া বিবির সঙ্গে সংসার করা যায় না।’
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: