ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, তিনি ভাঙ্গবেন তবু মচকাবেন না’

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৩ নভেম্বর ২০১৫

‘শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, তিনি ভাঙ্গবেন তবু মচকাবেন না’

সংসদ রিপোর্টার ॥ দুই কুখ্যাত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী) ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকরে সন্তুষ্টির রেশ ছিল জাতীয় সংসদেও। সংসদ সদস্যরা অনির্ধারিত দীর্ঘ আলোচনায় অংশ নিয়ে এই ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন একাট্টা হয়ে। তারা বলেন, এই ফাঁসির রায় কার্যকরে গোটা জাতির সঙ্গে তারাও আনন্দে আত্মহারা। এ রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতির ৪৪ বছরের কলঙ্কমুক্তির আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। একমাত্র শেখ হাসিনাই পারেন জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে। বিশ্বের কোন চাপের কাছে তিনি মাথানত করেননি। শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, উনি ভাঙঙ্গবেন, কিন্তু মচকাবেন না। তিনি যা বলেন, তা করেন। এছাড়া দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী নিজেদের দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষার আবেদনের ঘটনায় বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ হয়েছে এ বিচারের যৌক্তিকতা। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হলে সংসদ সদস্যরা অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকরে সন্তোষ প্রকাশ করেন। অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, চীফ হুইপ আসম ফিরোজ, সরকারী দলের আবদুল মান্নান, ডাঃ দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, ক্যাপ্টেন (অব) তাজুল ইসলাম, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, একেএম শামীম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবু, সামশুল হক চৌধুরী ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডাঃ রুস্তম আলী ফারাজী প্রমুখ। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জাতির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা ক্ষমতায় না থাকলে কেউ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতেন না। বঙ্গবন্ধুর মতো একই বৈশিষ্ট্য শেখ হাসিনার মধ্যে বিদ্যমান। তিনি যা বিশ্বাস করেন ও বলেন, তাই করেন। মৃত্যুকেও পরোয়া করেন না। তার ওপর অনেক আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো কারোর কাছে তাঁর কন্যাও মাথানত করেন না, মুত্যুভয়কে তুচ্ছ করে শেখ হাসিনা সাহসের সঙ্গেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে যাচ্ছেন। আমাদের কপালের কলঙ্কের তিলক উনি মুছে দিচ্ছেন। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়েছে। কয়েকটি ক্ষমতাধর দেশ ইনিয়ে-বিনিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমি প্রশ্ন করতে চাইÑ এই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীরা যখন দেশে গণহত্যা চালিয়েছিল, তখন তারা কোথায় ছিলেন? এরা কোনদিন আমাদের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি। একাত্তরে দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা ও সপ্তম নৌ-বহর পাঠানোর ইতিহাস বাঙালী জাতি ভুলে যায়নি। তাই আপনাদের অনর্থক খবর-দালালি অতীতেও কাজে লাগেনি, আগামীতেও লাগবে না। বর্তমান সরকার ফিস্ফাস করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে না। জাতিকে দেয়া নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। তাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, আবর্জনারা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত হবে। জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, অপরাধীদের বিচারহীনতার বাজে সংস্কৃতি পাকিস্তানী ও ’৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসকরা চালু করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসিকতার সঙ্গে দেশকে বিচারহীনতার সেই সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করেছেন। নির্বাচনী অঙ্গীকার অক্ষরে অক্ষরে উনি পালন করছেন। দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী প্রাণভিক্ষা প্রার্থনা করে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছেন। বিদেশী গণমাধ্যমের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা কোন ধর্মীয় নেতাকে ফাঁসি দেইনি, একজন কুখ্যাত রাজাকার, গণহত্যাকারীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন করেছি মাত্র। এর মাধ্যমে অপরাধ করলে যে দায়মুক্তির কোন সুযোগ নেই, সেটাও প্রমাণ হয়েছে। সরকারী দলের সিনিয়র নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে কোনদিনই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হতো না। পৃথিবীর কোন দেশে নেই পরাজিতরা সে দেশে রাজনীতি করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি যদি কেউ করে থাকে সে হলো মুক্তিযোদ্ধা নামধারী জিয়াউর রহমান। কারণ এই যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন উনি ভাঙ্গবেন, তবুও মচকাবেন না। অধিবেশনের শুরুতেই প্রশ্নোত্তর পর্বে নির্ধারিত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়া বীরবিক্রম বিষয়টির অবতারণা করে বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি আজ আনন্দে আত্মহারা। সারাদেশের মানুষও কেউ শনিবার রাতে ঘুমায়নি। ফাঁসি কার্যকর প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারা টেলিভিশনের সামনে বসেছিলেন। আজ সারাদেশের মানুষকে চিৎকার করে বলতে চাই, শেখ হাসিনা থাকলে বাংলাদেশে কোন রাজাকার, আলবদর, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কোনদিন এ দেশে মাথাচাড়া দিতে পারবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, শেষও হবে। আজ প্রমাণ হয়েছে, বাংলাদেশে কেবল স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। আবদুল মান্নান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, পুরো বিশ্বের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ, যেখানে স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। আর যারা এতো গণহত্যা করেছে, তাদেরই মন্ত্রী বানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনা যা বলেন, তা করেন। একমাত্র তার মতো সাহসী রাষ্ট্রনায়ক ক্ষমতায় আছেন বলেই সর্বশ্রেষ্ঠ বেয়াদব সাকা চৌধুরী ও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেন, এই ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিতই শুধু নয়, এদের মাধ্যমে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে জেনারেল জিয়া। আর একাত্তরের শহীদ, বীরঙ্গণা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বেঈমানী করে এসব যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে জোট গঠন এবং মন্ত্রিত্ব করেছিলেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করছেন। দেশকে জঞ্জালমুক্ত করছেন। বিশ্বের কোন চাপের কাছে বঙ্গবন্ধুর মতোই নতিস্বীকার করেননি প্রধানমন্ত্রী। চীফ হুইপ আসম ফিরোজ দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, এই যুদ্ধাপরাধীরাই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাসহ পুরো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে প্রধানমন্ত্রী দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, শেখ হাসিনা যা বলেন, তা বাস্তবায়ন করেন। জাতির কাছে তিনি ওয়াদা করেছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। শত ষড়যন্ত্র ও বৈশ্বিক উপেক্ষা করে তিনি সেই ওয়াদা রক্ষা করেছেন। দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকরের মাধ্যমে জাতি দীর্ঘদিন পর দায়মুক্তি পেয়েছে। আলোচনার সূত্রপাত করে সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) এবি তাজুল ইসলাম বলেন, দেশের ইতিহাসে একজন সবচেয়ে বেয়াদব সংসদ সদস্য ও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হয়েছে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতৃত্বের কারণে। দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী নিজের দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা প্রার্থনার ঘটনায় বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ হয়েছে তারা একাত্তরের গণহত্যাকারী ছিল। সরকারী দলের আবদুর রহমান বলেন, সাকা-মুজাহিদ একজন খুনী, ধর্ষক ও একাত্তরের গণহত্যাকারী। অথচ এদের গাড়িতেই রক্ত¯œাত জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। জাতি কোনদিন তাকে ক্ষমা করবে না। খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীরা দম্ভোক্তি করত, তাদের কেউ বিচার করতে পারবে না। কিন্তু তাদের বিচার হয়েছে, রায়ও কার্যকরের মাধ্যমে বিচারহীনতার কলঙ্কমুক্ত থেকে দেশ মুক্তি পেয়েছে। কোন চাপের কাছে প্রধানমন্ত্রী মাথানত করেননি। সরকারী দলের খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এই কুখ্যাত মুজাহিদ-সাকা চৌধুরীরা মুক্তিযুদ্ধকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। আজ সেই দু’জনই নিজেদের দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছে। একদিকে জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ, অগ্নিসন্ত্রাসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন খালেদা জিয়া, অন্যদিকে শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করছেন। চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী বলেন, শনিবার সন্ধ্যায় একবার আমরা ভেবেছিলাম, এটা (মৃত্যুদ- কার্যকর) মনে হয় স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা হয়নি। শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, উনি ভাঙ্গবেন, কিন্তু মচকাবেন না।
×