ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প

মাটির তৈরি তৈজস এখন অনেকের কাছে শুধুই স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৩ নভেম্বর ২০১৫

মাটির তৈরি তৈজস এখন অনেকের  কাছে শুধুই স্মৃতি

মোঃ খলিলুর রহমান মাটির তৈরি জিনিসপত্র গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। এক সময়ে মাটির তৈরি জিনিসপত্র ছাড়া সংসার জীবনে চলাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াত। মনের আনন্দে গ্রামবাংলার গৃহবধূসহ সব বয়সী নারী-পুরুষ মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে নিপুন হাতের তৈরি মৃৎশিল্পের (মাটির তৈরি) তৈজসপত্র। মৃৎশিল্প একদিন বাংলাদেশের গৌরবের ভরপুর ছিল। কালের বিবর্তনে মাটির তৈরি অনেক জিনিসপত্র বিলীন হয়ে গেছে। এক সময়ে মাটির জিনিসপত্র তৈরিতে কুমার পাড়ায় মৃৎশিল্পীরা সারাক্ষণ ব্যস্ত সময় কাটাত। এখন আনুধিকযুগে কাঁচ, সিলভার, এ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক অথবা মেলামাইনের তৈজসপত্র বাজারে ভরপুর থাকায় মাটির তৈরি জিনিসপত্র হারিয়ে যেতে বসেছে। হাঁড়ি-পাতিল, ডাবর-মটকি থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছু যেমন মাটির ব্যাংক, শো-পিস, গহনা, কলস, ফুলের টব, ফুলদানি, ঢাকনা, পিঠা তৈরির ছাঁচসহ নানা রকম খেলনা তৈরি করেন মৃৎশিল্পীরা। এখনও অনেক সৌখিন পরিবারের বাসা-বাড়িতে মাটির তৈরি ফুলের টপ শোভা পাচ্ছে। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সভ্যতায় মৃৎশিল্প মর্যাদা লাভ করেছিল। আজ সে গৌরব ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার ভিড়ে মৃৎশিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। মাটির তৈরি জিনিসপত্র কিনে আনতে হাট-বাজারে ছুটে যেতে লোকজন। কিন্তু এখন আর মাটির তৈরি জিনিসপত্র কিনতে হাটে ছুটে যেতে কাউকে দেখা যায় না। হাটের নদীর ঘাটে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বোঝাই নৌকাও এখন আর ভিড়ানো থাকে না। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের অনেক পরিবারে মাটির তৈরি দু’একটা খেলনা ছাড়া আর কোন তৈজসপত্র খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা তাও সন্দেহ রয়েছে। অনেকের কাছে মাটির তৈরি জিনিসপত্র এখন শুধুই স্মৃতি। গ্রামবাংলায় ধান কাটার মৌসুমে এ শিল্পে জড়িত কুমারদের আনাগোনা বেড়ে যেত। সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে মাটির হাঁড়ি-পাতিল বোঝাই ভার নিয়ে বিক্রেতারা দলে দলে ছুটে চলত পাড়া-মহল্লা ও গ্রাম-গঞ্জে। রান্না ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন রকমের হাঁড়ি-পাতিল, সরা, গামলা, গাছা, থালা, যাঁতা, দোনা, ভাক্কুন, ঝাঁজর, মটকি, আইল্লা, গরুর খাবার দেয়ার চাড়ি, কোলকি, কড়াই, কুয়ার পাট, মাটির ব্যাংক, শিশুদের জন্য রকমারি নক্সার পুতুল, খেলনা ও মাটির তৈরি পশুপাখি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ছুটে যেত। অনেক সময় ধান, গম, মসুর, বুট, ছোলাস নানা উৎপাদিত পণ্য দিয়েও গৃহবধূরা মাটির তৈরি জিনিসপত্র সংগ্রহ করত। নারায়ণগঞ্জের বন্দরের লাঙ্গলবন্দের তাজপুর গৌরান্দ চন্দ্র পাল (৬৪) আটচল্লিশ বছর ধরে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে আসছেন। তার বাপ-দাদাও এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি জানান, মাটি তৈরি জিনিসপত্র একটি কুটির শিল্প। তিনি এখন সাভার, বরিশাল, শ্রীনগর, সিরাজদী খাঁসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কুমারদের তৈরি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে এসে লাঙ্গলবন্দের তাজপুর বিক্রি করছেন। তিনি জানান, আগের মতো আর মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে না। প্লাস্টিক, কাঁচ, মেলামাইন, এ্যালুমিনিয়াম ও সিলভারের তৈরি জিনিসপত্রের কাছে ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি তৈজসপত্র হারিয়ে যেতে বসেছে। তার মতে মাটির তৈরি ভাতের হাঁড়ি, দুধের হাঁড়ি, তরকারির হাঁড়ি ও কলসসহ অনেক জিনিসপত্র হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রতি মাসে কমপক্ষে হলেও এক হাজার মাটির কলস বিক্রি হতো। এখন এক বছরে মাত্র ২শ’ কলস বিক্রি হয়। ইতোমধ্যে মাটির তৈরি তামাক খাবারের কলকি, মটকি হারিয়ে গেছে। মাটির সরাও এখন আর তেমন চলে না। তবুও গ্রাম-গ্রঞ্জের লোকজন সরা, ডাকনা, কিনে নিয়ে যায়। কিন্তু শহরের লোকজন এগুলো আর কিনেন না। তবে মাটির তৈরি দুইয়ের পাতিল, মাটির ব্যাংক, বিভিন্ন খেলার প্রচলন এখনও রয়েছে। মাটির তৈরি অনেক খেলনা রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের বাসাবাড়িতে শোভা পাচ্ছে। খেলনায় নিপুন হাতে করা হচ্ছে নানা ধরনের নক্সা ও কারুকাজ। মাটির টপের এখনও বেশ চাহিদা রয়েছে। গৌরান্দ চন্দ্র পাল জানান, একটি মাটির তৈরি সরা ৪-৫০ টাকা, মাটির তৈরি ব্যাংক ১৫-১২০ টাকা, হাঁড়ি ১৫-৫০ টাকা, মটকি ৫০০ টাকায়, কলস ১০-১০০ ফুলের টপ ও ফুলদানি ১০-২৫০ টাকা ও দুইয়ের পাতিল ৬-১০ টাকায় বিক্রি হয়। গৌরান্দ চন্দ্র পাল ট্রলারযোগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাটির তৈরি জিনিসপত্র কিনে এসে খুচরা বিক্রি করছেন। গৌরান্দ চন্দ্র পালের বাড়িতে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মটকি, বিভিন্ন সাইজের কলসসহ মাটির তৈরি নানান তৈজসপত্র অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। দিন দিন এগুলো পড়ে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, পূজায় মাটির হাঁড়ি-পাতিল ব্যবহার করা হয়, তাই এ সময় বিক্রি বেশি হয়। এছাড়া মিষ্টির দোকানে দইয়ের পাতিল, ফুলের টবের চাহিদা এখনও আছে বলেই অনেকে এখনও পেশায় টিকে আছে। তবে আগের মতো চাহিদা না থাকায় মৃৎশিল্পীরা অন্য পেশায় ঢুকে পড়ছে। একই এলাকার শাহজাহান জানান, মাটির তৈরি জিনিসপত্র এখন আর তেমন চলে না। আমাদের খুব একটা প্রয়োজন হয় না। আমরা এখন প্লাস্টিক, মেলামাইন ও সিলভারের তৈরি জিনিসপত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। মাটির তৈরি জিনিসপত্র ভঙ্গুর। মাটিতে পড়লেই ভেঙ্গে যায়। প্লাস্টিক, মেলামাইন, এ্যালুমিনিয়াম ও সিলভারের তৈরি তৈজসপত্র মাটি পড়লেও ভাঙ্গে না। তিনি জানান, তবে কিছু কিছু মাটির তৈরি জিনিসপত্রের এখনও কদর রয়েছে। শাহজাহান ৭০ টাকা দিয়ে মাটির তৈরি মুড়ি ভাজার একটি পাত্র কিনে নিয়ে যান। তিনি জানান, মাটির তৈরি জিনিসপত্র এখন শহরের অনেকের কাছেই শুধু স্মৃতি।
×