ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বল বীর, বল অবনত মোর শির!

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৩ নভেম্বর ২০১৫

বল বীর, বল অবনত মোর শির!

গত সপ্তাহে একজন অভিনেতা কাম চিত্র নির্মাতা মিডিয়াতে আলোচনায় চলে আসেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ছেলের নামের সঙ্গে তার নামের মিল রয়েছে। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘মা’ সম্বোধন করে ঢাকার পূর্বাচলে রাজউকের একটি প্লট চেয়েছিলেন। কেউ একজন সেই আবেদনপত্রটির ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছেন। সেই আবেদনপত্রে অভিনেতা জানিয়েছেন, অভিনয়ের কারণে তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। তাই যখন আবেদনপত্র চাওয়া হয়েছিল, তিনি তখন তা করতে পারেননি। পূর্বাচলে একটি প্লট তার স্বপ্ন এবং তার সন্তানের ভবিষ্যত বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন তার এই দ্বিতীয় ছেলের প্রতি মহানুভবতা দেখিয়ে একটি প্লট বরাদ্দ করেন সেই আর্জি করেছেন তিনি। এক খণ্ড জমির জন্য এভাবে নিজেকে বিসর্জন দেয়া যায়, এই চিঠিটি না দেখলে বুঝতে পারতাম না। পুরো শিল্পীসমাজ তার ওপর যারপরনাই ক্ষেপেছেন। সবাইকে এভাবে ন্যাংটা করে কাজটি তিনি ভাল করেননি নিশ্চয়ই। আমরা সবাই যে মনে মনে একটা প্লট চাই এবং তার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করি- তারই ক্ষুদ্র একটা ছবি এই আবেদনপত্রটি। আবেদনপত্রটি পড়ে আমি তার ওপর রেগে যাইনি। মায়া লেগেছে এই ভেবে যে, এই দেশের একজন শিল্পীকে এভাবেই তো বাঁচতে হয়। ভদ্রলোক একটু আগেভাগেই তার সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, এমন একটি কাজ করে ফেলেছেন। তা না হলে তো এই দেশে একজন শিল্পীকে চরম অর্থাভাবে রোগে-শোকে বিনা চিকিৎসায় এই গ্রহ ছেড়ে চলে যেতে হয়। এটাই তো বাস্তবতা, নয় কি? তিনি সেই ছবি দেখে ফেলেছেন। তিনি বাংলাদেশকে চিনে ফেলেছেন। শেষ বয়সে তার খাবার থাকবে না, চিকিৎসার ওষুধ থাকবে না, নোংরা বাড়িতে কোনও রকমে দিন যাপন করবেন এবং তিনি মারা যাবার পর একদিন সবাই মিলে শোকের মাতম করবেন। তিনি একটু বিখ্যাত হলে তাকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হবে। টিভিতে চেহারা দেখানোর জন্য কেউ কেউ ধাক্কাধাক্কি করে ক্যামেরার সামনে থাকতে চাইবেন। তারপর রাতে কোন এক লাল আড্ডায় চলে যাবেন ভিন্ন জগতে। ভদ্রলোক এদের নিশ্চয়ই চিনে ফেলেছেন। তার পরিণতি তিনি জানেন। তাই তিনি শিল্পতে মন না দিয়ে ‘অভিনয়ে’ মন দিয়েছেন। এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ নিত্যদিন অভিনয় করেই তো জীবন পার করছেন। অভিনয় ছাড়া আর উপায় কি! দুই. কাকতালীয়ভাবে গত সপ্তাহেই আরেকটি ঘটনা শুনেছি। মূল ঘটনাটি এরশাদ সাহেবের সামরিক শাসন আমলের। একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ ঘটনাটি আমাকে বললেন, যা আমি আগে জানতাম না। এরশাদ সাহেব তখন সামরিক শাসন দিয়েছেন। কঠিন অবস্থা। দেশের সবকিছু সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনেও তাই। একদিন শিল্পী হাসান ইমাম সাহেব টেলিভিশন ভবনের গেট দিয়ে ভেতর ঢুকছিলেন। তার কাঁধে ঝুলানো খদ্দরের ব্যাগ। নিয়মমাফিক তার ব্যাগ চেক করতে এগিয়ে এলেন নিরাপত্তাকর্মী। তাকে থামিয়ে দিয়ে হাসান ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আমার ব্যাগ কেন চেক করা হবে? এতকাল তো কেউ চেক করেনি! নিরাপত্তাকর্মী তাকে বললেন, নিরাপত্তার জন্য সবার ব্যাগই চেক করা হবে। ক্ষেপে গিয়ে হাসান ইমাম সাহেব বললেন, দেখেন, এই দেশের দু-দু’জন রাষ্ট্রপতিকে আপনারা মেরেছেন, আমরা মারিনি। তারপরও আমাদের ব্যাগ চেক করেন আপনারা? ঘটনাটির হুবহু বর্ণনার জন্য হাসান ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলা হয়ে ওঠেনি আমার। ইচ্ছে আছে, পুরো গল্পটি শোনার। তবে যিনি আমাকে এই ঘটনাটি বলেছেন, তাকে আমি বিশ্বাস করি। এই ছোট ঘটনাটি শোনার পর আমি অনেকটা সময় হা হয়ে বসে থাকি। এত নির্মম সত্যি কথাটি বলার মতো সাহস পেলেন কোথায় তিনি? তাকে এ্যারেস্ট করা হতে পারত, তাকে টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হতে পারত, তাকে মেরে ফেললেও কেউ টের পেত কিনা সন্দেহ! এগুলো সবকিছুই তো তিনি জানতেন। তারপরও এত সাহস তিনি পেলেন কোথা থেকে! বর্তমান সময়ের একজন শিল্পীর কি একই পরিমাণ সাহস আছে? এমন কেউ কি আছেন, যিনি ঠিক এভাবে কারও মুখের ওপর সত্যি কথাটি বলে দিয়ে আসতে পারেন? বায়ান্নতে আমাদের যে সাহস ছিল, ঊনসত্তরে, তারপর একাত্তরে, নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে গণজাগরণ মঞ্চ হয়ে ২০১৫ সাল। আমাদের সাহস বেড়েছে, নাকি কমেছে? সাহস কমে গেছে বলেই আমরা হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে খুব সহজেই একটি প্লট ভিক্ষা চাইতে পারি। সাহসের সঙ্গে সঙ্গে লজ্জাও কমে গেছে আমাদের। তিন. মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় বুদ্ধিজীবীদের হারানো। এই গ্রহে সকল প্রাণের মূল্য সমান, কিন্তু ব্রেইনের নয়। আমি ওই সময়টা দেখিনি। তবে বই পড়ে যেটুকু জানতে পেরেছি, সেটা মনে হলেই ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী প্রায় এক হাজারেরও বেশি বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। আমি সব বুদ্ধিজীবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক কয়েকটি নাম এখানে উল্লেখ করতে চাই। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র), ড. মুনীর চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজী সাহিত্য), ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা), এমএ সাদেক (শিক্ষা), সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা), এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা), হবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ), শরাফত আলী (গণিত), অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ), অধ্যাপক ডাঃ আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ), শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক), নিজামুদ্দীন আহমেদ (সাংবাদিক), আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার), রণদা প্রসাদ সাহা (সমাজসেবক এবং দানবীর), যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক), জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্রকার) এবং নূতন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)। তালিকা আরও লম্বা। আমি সেই তালিকায় যাচ্ছি না। আমি যাদের কম-বেশি জানি, তাদের কথাই এখানে লিখলাম। আরও কিছু প্রিয় মানুষের নাম না বললেই নয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন (১৮৮৯-১৯৯৪), ইবরাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮), সুকুমার সেন (১৯০১-১৯৯২), জসীমউদ্দীন (১৯০২-১৯৭৭), মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন (১৯০৪-১৯৮৭), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), মুহম্মদ কুদরাত-ই-খুদা (১৯০০-১৯৭৮) এবং সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯)। ওপরের যে নামগুলো লিখেছি তারা অনেক পুরনো দিনের মানুষ নন। এই গত ৫০ বছরের মধ্যেই তাদের অস্তিত্ব ছিল। আরও অনেক মানুষ আছেন বিগত এক শ’ বছরের ভেতর যাদের নাম আসতে পারে, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৪), অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১), আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ (১৮৬৯-১৯৫৩), সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮), দক্ষিণারঞ্জন মজুমদার (১৮৭৭-১৯৫৭) এবং জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। তবে এখানে মূল বিষয়টি তাদের নামের তালিকা তৈরি করা নয়। মূল প্রশ্নটি হলো, গত শতাব্দীর শেষ দিকে যেই মানুষগুলো ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও যেই মানুষগুলো ছিলেন- এই মাপের মানুষ বাংলাদেশে বর্তমানে কতজন আছেন? জনসংখ্যার দিক দিয়ে তো আমরা অনেক এগিয়েছি। আমাদের সম্পদ হয়েছে, লোকসংখ্যা বেড়েছে, দালান-কোঠা বেড়েছে, জামা কাপড়ে কেতা দুরস্ত হয়েছি। কিন্তু মান এত নিচে নেমে গেল কিভাবে? আমি বর্তমান সময়ে হাতেগোনা পাঁচজন মানুষ দেখি না, যারা ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে, জ্ঞানের দিক দিয়ে, সাধনার দিক দিয়ে, সাহসের দিক দিয়ে ওই মানুষগুলোর কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছেন। আমার চারদিকে এখন রাজনৈতিক দলের সাংবাদিক, লেখক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক ও ব্যবসায়ী। কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি, কেউ জামায়াত, নয়ত প্লট প্রত্যাশী! এই তো! চার. বাংলাদেশে একটি অদ্ভুত কালচার তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারণে বিষয়টি আমার নজরে আসেনি। আপনি যদি সরকারের কোন কাজের প্রশংসা করেন, সেই মুহূর্তেই আপনি হয়ে গেলেন সরকারের দালাল। বিনিময়ে আপনি নির্ঘাত কোন প্লটের মালিক হয়েছেন, নয়ত কোটি কোটি টাকার ভাগ পেয়েছেন। আর যদি আপনি সরকারের কাজের সমালোচনা করেন, তাহলে পর মুহূর্তেই আপনি হয়ে গেলেন বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠীর মানুষ। কি সাংঘাতিক সরলীকরণ! সরকার যেহেতু দেশ পরিচালনা করে থাকে, তাই পৃথিবীজুড়েই গণমাধ্যমগুলো সরকারের কাজের সমালোচনা করে থাকে। এটাই রীতি। সেই কারণেই গণমাধ্যমগুলোকে বলা হয়ে থাকে, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সরকার যেহেতু নানান কাজে নিয়োজিত থাকে এবং জনগণের স্বার্থ সেখানে সরাসরি যুক্ত- তাই সরকারেরই সমালোচনা হবে। বিরোধী দল সমালোচনায় আসার সুযোগ কম। বর্তমানের বাংলাদেশে সরকারের সমালোচনার অর্থই হলো আপনি ভিন্ন দলের। একজন লেখক কিংবা সাংবাদিক একটি দলের হয় কিভাবে? কিন্তু আমাদের দেশে হয়। এখানে নীল, সবুজ, সাদা যেমন শিক্ষক হন তেমনি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী হন। আর তাই পাঠকরা এখন আর লেখকদের কিংবা সাংবাদিকদের খুব একটা বিশ্বাস করেন না। একটি সরকার যেমন খারাপ কাজ করতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে অনেক ভাল কাজও করতে পারে। কিন্তু ভাল কাজটির কথা বলা মাত্রই পাঠক ধরে নেয়, সেই লেখক সরকারের মদদপুষ্ট। পাঠকদের এই ধারণা নিশ্চয়ই এমনি এমনি হয়নি। আমাদের বেশিরভাগ মানুষই নিশ্চয়ই চেয়ে-চিন্তে সরকারী জমি নেয়া ছাড়াও আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। লেখকরা আর নিরপেক্ষ থাকতে পারছেন না; কিংবা থাকছেন না। বুদ্ধিজীবীরা আর নিরপেক্ষ নন। তারা বিভিন্ন ছাতার তলে আশ্রয় নিয়েছেন। সারাজীবন বিশ্বাস করে এলাম, বুদ্ধিজীবীরা কোন একটি বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে যেতে পারেন; কিন্তু কোন দলের হয়ে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের জন্য এটা আর প্রযোজ্য নয়। বুদ্ধিজীবীরা তাদের ক্রেডিবিলিটি হারিয়েছেন। বুদ্ধিজীবী একটা গালিতে পরিণত হয়েছে এই দেশে। যেই দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাটা একটি গালির সমপর্যায়ে পৌঁছেছে, সেই দেশে আপনি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আশা করেন কিভাবে? আর যদি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করা না যায়, সেই দেশে লেখালেখি করে কী লাভ! কবিতা লিখে কী হয়? ভাল গদ্য লিখে কার কি আসে যায়? ভাল প্রবন্ধে কার আগ্রহ থাকে? সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, নিয়ম-নীতি, বাদ-প্রতিবাদ- এগুলোর দু’পয়সা মূল্য কে দেয়? মানুষ পতঙ্গের মতো ছুটতে থাকে টাকার পেছনে। প্লট আর টাকাই হয়ে যায় মুখ্য বিষয়- গৌণ হয়ে পড়ে থাকে অমূল্য সময়, মুখ্য হয়ে ওঠে অসভ্যতা। পাঁচ. আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের মানুষের সাহস কমে গেছে। বিষয়টি নিয়ে কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের ভেতরও দুই দল। একদল বলছেন, বাংলাদেশের মানুষের সাহস ওইভাবে কখনই ছিল না। ভারতবর্ষের এই অংশের মানুষ সবসময়ই ছোটখাটো হানাহানির ভেতর ছিল; কিন্তু কখনই বড় মাপের সাহসী ছিল না। আরেক দল মানুষ বলেন, এই ভূখ-ে মানুষের সাহস না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের সময় এত অল্প অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে উঠল কিভাবে? আমি ইতিহাসবিদ নই। তবে আমার জীবন দিয়ে যেটুকু দেখছি, তাতে আমার ধারণা আমাদের ব্যক্তিগত সাহসের পাশাপাশি সামগ্রিক সাহসও কমে গেছে। আগে একজন লেখক, নাট্যকর্মী, সাংবাদিক যে সাহস নিয়ে তার কাজটি সম্পাদন করতেন, যেই ঝুঁকি নিতেন, যেই ব্যক্তিত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন- বর্তমানে তা নেই। আমরা ‘টাইগার’-এর আইকন নিয়ে ভেতরে আসলে বিড়াল ছাড়া আর কিছুই না। আমাদের পূর্বসূরিরা বিড়াল হয়ে আমাদের সেই পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। এখন আমরা বিড়ালের মতো সন্তর্পণে হাঁটা শিখেছি। আমাদের পূর্বসূরিরা আরও বড় মাপের বিড়াল। তারা এই বয়সেই সরাসরি নিজের নামে কথা বলার সাহসটুকু হারিয়ে ফেলেছে; তারা বেনামে, ছদ্মনামে হাতি-ঘোড়া উজির-নাজির মেরে অস্থির করে রাখে! তাদের ভুয়া সিমকার্ড প্রয়োজন হয়, ভুয়া ফেসবুক আইডি তাদের পরিচয়! এই দেশ ক্রমাগত দুর্বলচিত্তের মানুষ তৈরি করছে। আমরা দিনকে দিন ভীরু জাতিতে পরিণত হচ্ছি। কেউ পূর্বাচলের প্লটের আশায়, নয়ত জীবননাশের আশঙ্কায়! তবে এই ভীরুতার মূল্য একদিন আমাদের সবাইকে দিতে হবে। একটি ভীতু জাতির ওপর মৌলবাদ ভর করা খুব সহজ এবং হচ্ছেও তাই। আমরা বিভিন্ন স্তরের মানুষকে বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে, নয়ত প্রাণহানির ভয় দেখিয়ে যেভাবে ভীতু করে তুলছি, তা কখনই এই ভূখ-ের জন্য শুভদিন বয়ে আনতে পারে না; আনবে না। এই ভূখ-ের ওপর কখনও কোন আঘাত এলে, তখন একটি মানুষও পাওয়া যাবে না যে চিৎকার করে বলতে পারবে- ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!’ ততদিন তার শির অবনত হয়ে গেছে। উন্নত হওয়ার আর সুযোগ নেই। ২০ নবেম্বর ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×