ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

যোদ্ধা শাহাবুদ্দীন বনাম শিল্পী শাহাবুদ্দীন

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৩ নভেম্বর ২০১৫

যোদ্ধা শাহাবুদ্দীন বনাম শিল্পী শাহাবুদ্দীন

‘তিনকাল গেল, এককাল আছে, বুঝলা মিয়া। মরবার আগে একটাই আশা, রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী-হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখে যাইবার চাই। কও জয় বাংলা। চলো মিয়া, ভাত খাইবা। ঝাল-ঝুল খাও তো? আমি নিজে পাকাইছি, ভুনা গোস্ত। তুমার ভাবিজানের চুল শুকায় নাই, পাকঘরে আহে নাই। টেলিফোনে কার লগে কথা কয়।’ শিল্পীর হাতের রান্না, বলা যায় না, রংটং মিশিয়েছেন কি-না। লাল-নীল-হলুদ-কালোর বদলে ঝোল কেন সবুজ, প্রমাদ গুনলুম। বিস্তর কাঁচামরিচ। ঝাল কাকে বলে খেয়ে বুঝলুম। জিজ্ঞেস করি, ভাবিজান, ভাতিজিরাও কি এ রকম ভয়াবহ ঝালে অভ্যস্ত? উত্তর, হ্যাগো জিগাও। ভরসা পেলুম না। ভাবিজান টেলিফোনে কথা বলছেন, চুল শুকোচ্ছেন। ভাতিজিরা ঘরে নেই, তখন সন্ধে। বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও আড্ডা দিচ্ছেন হয়ত। কিছুক্ষণ আগেই বড় ভাতিজি চিত্র সেজেগুজে কালুবাবুর সঙ্গে বেরিয়েছেন। প্যারিসে সন্ধেয় তরুণ পোলাপান কি ঘরে থাকে? না। আমাগো মতো বুড়ারা বসে থাকে। কিন্তু তুমার ভাবিজান থাকে না। নানা কাজ। উনিই তো এই বাড়ির ডিরেক্টর জেনারেল। উনার কথায় উঠবস করি। বললেন শিল্পী শাহাবুদ্দীন। ‘কী বললে’? ভাবিজানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, ‘চলো মিয়া টিভিতে ফুটবল খেলা দেখি। আহ! কী আফসোস!! ভাইজান-ভাবিজানের কাজিয়া দেখলুম না। ভাবিজান টেলিফোনে মশগুল আবার। কাজিয়া করার সময়ই-বা কোথায় পাবেন। দুইজনের জগত আলাদা। শাহাবুদ্দীন ছবি আঁকেন। আনা ইসলাম সংসার, লেখা নিয়ে ব্যস্ত। দুই কন্যা চিত্র ও চর্যা লেখাপড়ায়। চিত্রও ছবি আঁকেন। একক প্রদর্শনীও করেছেন কয়েকটি। ছবি বিক্রির টাকা সাহায্য দিয়েছেন বিদেশের দুস্থ সংস্থাকে। চিত্র আবার বিপ্লবীও। ছাত্রনেতা তথা নেত্রী। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, হাজতবাস। টিভি, কাগজে, সংবাদ, ছবি। রক্তেই বিপ্লব। শাহাবুদ্দীন মুক্তিযুদ্ধে ভয়ঙ্কর মুক্তিযোদ্ধা। প্লাটুন কমান্ডার। চিত্রের মতো চর্যা পুলিশের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে যান না ঠিকই, তবে বিক্ষোভ-মিছিলে ঠিকই শামিল হন। চর্যা কী বিষয়ে গবেষণা করেন, অজানা। গবেষণার কাজে মাঝে মধ্যে উধাও। চলে যান আফ্রিকার কোন দেশে। অগুস্ত রদাঁর মন্ত্রে শাহাবুদ্দীন উজ্জীবিত। নিরন্তর কাজ। ফাঁকি দেয়া ধাতে নেই। যোদ্ধার ডিসিপ্লিন রক্তে, মজ্জায়। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে এই শিক্ষা। যেহেতু সৈনিক, নিয়ম-কানুনই আরাধ্য। পরিশ্রমী। সপ্তাহের পাঁচদিনই ঘরবন্দী। আট তলার ফ্ল্যাট থেকে লিফটেও নিচে নামেন না। দুই দিন ব্যতিক্রম। আলাদা রুটিন। বিকেল থেকে রাত ন’টা। পাক্কা চার-পাঁচ ঘণ্টা টেনিস খেলেন, শারীরিক ব্যায়াম। শরীর ঝরঝরে। ফিট। দুই দিনে যে এনার্জি, পাঁচদিনের সঞ্চয়। সরকারী অফিসে কাজ করলে বিস্তর ফাঁকি দেয়া যায়। সময়-অসময় বলে কিছু নেই। সওদাগরি অফিসে ওসব চলে না। ধরাবাঁধা নিয়ম ও সময়। শাহাবুদ্দীন ঠিক সকাল দশটায় স্টুডিওয় ঢোকেন। শুরু করেন কাজ। নতুন কাজ কিংবা গতদিনের কাজ বা ফেলে-রাখা কাজ। চলতে থাকে কাজ। মনঃপূত না হলে আবার শুরু। কোমরে গামছা বেঁধে। দশটা থেকে দুপুর দেড়টা। এক ঘণ্টা বিরতি। খাওয়া। বিশ্রাম। পাঁচটা পর্যন্ত আবার কাজ। মাঝে মধ্যে ওভারটাইমও করেন। ঘাড়ের ওপর প্রদর্শনী থাকলে যোদ্ধা ও শিল্পীর ওভারটাইম নেই। সব সময়ই ওভারটাইম, কথাটি বোধহয় পাউল ক্লে বলেছিলেন। শিল্পী শাহাবুদ্দীন কখনই ভোলেন না তিনি মুক্তিযোদ্ধা। যোদ্ধার যে মানসিক বল, শক্তি, গতি ওঁর ছবির রেখায়, অঙ্কনে, রঙেও স্পষ্ট, উজ্জ্বল, উদ্ভাসিত। এখানেই তিনি একক। এখানেই তিনি মহান, এখানেই তিনি বৈশ্বিক। এখানেই তিনি আর পাঁচজন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কতটা আলাদা দেখবেন কলকাতায়, যতীন দাস রোডে, স্মিতা বাজোরিয়ার গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে। অফিসিয়ালি শুরু হবে ১২ ডিসেম্বর থেকে। তবে গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে উদ্বোধন নয়। হবে আইসিসিআরের কমপ্লেক্সে। উদ্বোধন করবেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। সম্ভবত এই প্রথম রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী কোন শিল্পীর বা বাঙালী শিল্পীর ছবির প্রদর্শনী উদ্বোধন করবেন। করার কারণও আছে হয়ত। শাহাবুদ্দীন মুক্তিযোদ্ধা। প্রণববাবু মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের প্রতি দরদী। ১৯৭১-এ তিনি বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করেছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, সন্ধেয় উপস্থিত থাকবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানাও। তিনি এবং শেখ হাসিনা (প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ) তো প্রণববাবুর পারিবারিক। হ্যাঁ, উদ্বোধনী সন্ধেয় শাহাবুদ্দীন, আনা ইসলাম ওঁদের দুই কন্যা চিত্র ও চর্যাও থাকবেন। প্যারিসের ঘটনায় শাহাবুদ্দীনের মন ভারাক্রান্ত। চল্লিশ বছরের বেশি প্যারিসে বাস, কখনও এমন অঘটন, বিপর্যয়, জঙ্গীপনা দেখেননি। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে হাত নিশপিশ করছে। বয়স থাকলে জঙ্গী নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। হাতে এখন তুলি, ব্রাশ ও রং। ছবি আঁকবেন। শিল্পী আবার যোদ্ধার ভূমিকায়। ফধঁফযধরফবৎ২১@মড়ড়মষবসধরষ.পড়স
×