ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনুবাদ : এনামুল হক

তৃতীয় বিশ্বের গ্রামীণ জীবনে সৌর বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৩ নভেম্বর ২০১৫

তৃতীয় বিশ্বের গ্রামীণ জীবনে সৌর বিপ্লব

উন্নয়নশীল বিশ্বে একটা বিপ্লব ঘটছে, যার নাম সৌর বিপ্লব। অর্থাৎ সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুতায়ন। সেই বিপ্লব তৃতীয় বিশ্বের জনগণের জীবনধারা বদলে দিচ্ছে। তাদের অন্ধকার জীবনকে আলোকিত করে তুলছে; বাড়তি আয়ের পথ করে দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যও বয়ে আনছে। প্রায় ৯শ’ কোটি লোকের এই পৃথিবীতে প্রায় ১শ’ ১০ কোটি মানুষ বিদ্যুতের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এদের প্রায় এক-চতুর্থাংশের বাস ভারতে। বিদ্যুতের সুযোগবঞ্চিত এই মানুষগুলো অন্ধকারের হাত থেকে রক্ষা পেতে কেরোসিন অথবা বড়সড় আকারের ব্যাটারির ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। তাতে বিড়ম্বনাও কম নয়। কেরোসিনের ধোঁয়া বিষাক্ত। তাছাড়া ব্যাটারি অনেক সময় লিক করে এ্যাসিড বেরিয়ে আসে। এই শ্রেণীর মানুষকে অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে এগিয়ে এসেছে শত শত কোম্পানি। তারা ছোট ছোট সৌরশক্তিচালিত ইউনিট বিক্রি করছে তাদের কাছে সুলভমূল্যে ও সহজে পরিশোধযোগ্য ব্যবস্থায়। ৪০ ওয়াটের সৌর প্যানেলের দ্বারা শক্তিচালিত এই ইউনিটের মাধ্যমে দুটো এলইডি বাতি জ্বলবে ও একটা পাখা চলবে। ইউনিটটি অতি ক্ষুদ্রাকায় একটা বিদ্যুতকেন্দ্রের মতো। এর সৌর প্যানেলে সূর্যের আলো পড়ে ইউনিটটি চার্জ হয়। পুরো চার্জ হতে লাগে একটানা প্রায় ১০ ঘণ্টা। দুটি এলইডি বাতি ও একটা ফ্যান চালানোর এমন একটি ইউনিটের পেছনে দৈনিক খরচের পরিমাণ প্রায় ৩৫ সেন্ট। ভারতের মতো দেশগুলোর গরিব পরিবারগুলোর আয় অতি সামান্য। দৈনিক ২৬ ডলারেরও কম। এই সামান্য আয় দিয়ে খাবার, ওষুধপত্র, লেখাপড়ার খরচসহ সংসারের যাবতীয় ব্যয় মেটাতে হয়। বিদ্যুতের পেছনে ৩৫ সেন্ট খরচ হওয়া মানে দৈনিক আয়ের এক-পঞ্চমাংশ চলে যাওয়া। তারপরও এই শ্রেণীর মানুষ বিদ্যুতের পেছনে এতটা খরচ করতে রাজি। তাদের মতে সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকার চেয়ে এ-ও ভাল। তাছাড়া ব্যাটারির পেছনেও একই পরিমাণ অর্থ খরচ হয়। উপরন্তু বাড়তি কিছু বিড়ম্বনা আছে। ব্যাটারি রিচার্জ করার জন্য ওটাকে কাঁধে বয়ে এক কিলোমিটার কি তারও বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে হয়। কখনও কখনও ব্যাটারি থেকে এ্যাসিড চুইয়ে পড়ে শরীরের ক্ষতি হয়, জামাকাপড় পুড়ে যায়। বিদ্যুতের এই চিত্রটা শুধু ভারতের গ্রামাঞ্চলের নয়, মিয়ানমার ও আফ্রিকার গ্রামেও একই দৃশ্য দেখা যাবে। বিদ্যুত সঙ্কট মেটাতে সেখানেও এগিয়ে এসেছে প্রাইভেট কোম্পানিগুলো। বিক্রি করছে সোলার ইউনিট ও প্যানেল। গড়ে তুলছে সোলার ফার্ম। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার হিসেবে আফ্রিকার সাহারা সন্নিহিত অঞ্চলের ৬২ কোটি ১০ লাখ মানুষ বিদ্যুতের সুযোগবঞ্চিত। ভারতে বিদ্যুত সরবরাহ লাইনের অপ্রতুলতার কারণে শুধু উত্তরপ্রদেশে ২০ কোটি অধিবাসীর মাত্র ৩৭ শতাংশ আলোর প্রধান উৎস হিসেবে বিদ্যুত ব্যবহার করে। সেখানে দুই কোটি পরিবার আলোর জন্য প্রধানত কেরোসিনের ওপর নির্ভরশীল। আর যাদের বাড়িতে বিদ্যুতের লাইন আছে তারাও দিনে মাত্র ২-৩ ঘণ্টা বিদ্যুত পায়। কখন বিদ্যুত যায় কখন আসে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। এসব এলাকার গরিব মানুষের তাই সৌরবিদ্যুতের চেয়ে ভাল বিকল্প আর কিছু নেই। স্বাভাবিকভাবেই তারা এই বিকল্পটির দিকে ঝুঁকছে। ছোটখাটো একটা সৌর ইউনিট দিয়ে গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারের বিদ্যুতের চাহিদা মিটে যায়। আলো জ্বালানো ছাড়াও এতে একটা পাখা চলে। সেলফোন চার্জ করা যায়। তেমনি আছে সৌর লণ্ঠন। এই লণ্ঠন দিয়ে গ্রামের মানুষ আঁধারে পথ চলে, ক্ষেতে-খামারেও যায়, অন্যান্য কাজ সারে। এভাবে বিশ্বের দরিদ্রতম নাগরিকরা সামান্য অর্থ খরচ করে বিশুদ্ধ, নবায়নযোগ্য এনার্জি কিনে তাদের জীবনযাপন সহজ করে তুলছে। দীর্ঘদিন ধরে নবায়নযোগ্য এই সৌরশক্তিকেই বিশ্বের জ্বালানি সঙ্কটের একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক দশক ধরে উৎপাদিত বিভিন্ন সৌরপণ্য যথেষ্ট ব্যয়বহুল ও অনির্ভরযোগ্য বলে পরিগণিত হয়। সম্প্রতি এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন একদল উদ্যোক্তার আগমন ঘটেছে। তারা সস্তা সৌর প্যানেল এবং ব্যাটারি ও এলইডি আলোর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে এমন এক বর্ধিষ্ণু শিল্প গড়ে তুলেছেন, যার মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদনের কাজটা সরাসরি নাগরিকদের হাতে ন্যস্ত হয়, অনির্ভরযোগ্য এনার্জি গ্রীডের ওপর নয়। এসব কোম্পানির অনেকেই ভারতের সর্ববৃহৎ এবং অতিদরিদ্র রাজ্য উত্তরপ্রদেশে গিয়ে ব্যবসা জমিয়ে বসেছে। তার মধ্যে একটি হলো সিমপা এনার্জি যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিমপা নেটওয়ার্কের ভারতীয় সাবসিডিয়ারি। এমন একটি কোম্পানির ভারতীয় প্রতিনিধি বলেন, আমরা আলোর সমাধান দিয়েছি যার জন্য মাসে দুই ডলারের মতো লাগে, সেখানে কেরোসিনের লণ্ঠন জ্বালিয়ে চলতে গেলে খরচ পড়ে চার ডলার। অর্থের সাশ্রয় ঘটানো ছাড়াও এর স্বাস্থ্যগত দিকটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেরোসিন জ্বালালে সে ধোঁয়া বেরোয় এবং কালি পড়ে তাতে শ্বাসযন্ত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। লোকে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভোগে। চিকিৎসার পেছনে ভালই অর্থ ব্যয় হয়। সৌরবিদ্যুত এদিক দিয়ে বিরাট সাশ্রয় এনে দেয়। আজ উত্তরপ্রদেশের গ্রামগুলোয় গেলে দেখা যাবে যে, ছোট ছোট দুগ্ধ খামারে রাতের বেলায় সৌরশক্তিচালিত এলইডি বাল্ব জ্বলবে। তাঁতীরা এই আলোয় রাতের দীর্ঘ সময় কাজ করে পরিবারের জন্য বাড়তি আয় বয়ে আনছে। দোকানিরা এই আলোয় কেনাবেচার কাজ করছে। ছেলেমেয়েরা রাতের বেলায় বিশুদ্ধ ও নিরাপদ আলোয় পড়তে বসছে। এমন আলোয় এক ফোঁটা কার্বন-ডাই অক্সাইড বাতাসে গিয়ে মিশছে না। রান্নাবান্না ও আলো জ্বালানোর কাজে জ্বালানির ক্ষতিকর উৎস যেমন জীবাশ্ম, তেমনি জ্বালানি ব্যবহারের ফলে পরিবেশের যে দূষণ ঘটে শুধু সে কারণেই প্রতি বছর সারাবিশ্বে প্রায় ৪০ লাখ লোক অকালে মৃত্যুবরণ করে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে জীবাশ্ম জ্বালানির প্রভাব তো আছেই। ইতোমধ্যে চরম আবহাওয়া, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত তো হয়েছেই। এটা উত্তরোত্তর পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে সেটা আর বিশ্বের গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কোন কাজ দিচ্ছে না। ভারতে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বৃহদাকায় বেশ কয়েকটি বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মিত হওয়ার কয়েক দশক পরও প্রায় ৪০ কোটি লোক এখনও বিদ্যুতবঞ্চিত। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থাও (আইইএ) বলেছে, যত চেষ্টাই করা হোক না কেন প্রচলিত ব্যবস্থায় বিদ্যুত সরবরাহ করা হলে ২০৩০ সাল নাগাদ সারাবিশ্বে প্রায় এক শ’ কোটি লোক বিদ্যুতবিহীন থাকবে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ একটাই। তা হলো নবায়নযোগ্য সৌরশক্তির ব্যাপক ব্যবহার। গত কয়েক বছরে এই খাতে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হওয়ায় সৌরশক্তির বহুল ব্যবহারের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠছেন অনেকে। তবে ২০৩০ সাল নাগাদ গোটা বিশ্বকে বিদ্যুতের আলো ঝলমল করে তোলার লক্ষ্যে মিনি-গ্রীডের নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য বছরে আরও ১২শ’ কোটি ডলার এবং অফ-গ্রীডের নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য ৭শ’ কোটি ডলারের বাড়তি বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে আইইএ। সংস্থাটি বলেছে, তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে শত শত কোটি ডলারের ভর্তুকি পায়। সেই ভর্তুকির একটা অংশ সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি আহরণের পেছনে ব্যয় করা হলে বিশ্বের অনুন্নত এলাকায় বিশেষত গ্রামগুলোয় সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বহুলাংশে বেড়ে যাবে। মানুষ জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×