ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

দুই বাংলার সঙ্গীতাসরে অনুপমের সুরে মোহিত শ্রোতা

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২৪ নভেম্বর ২০১৫

দুই বাংলার সঙ্গীতাসরে অনুপমের সুরে মোহিত শ্রোতা

মনোয়ার হোসেন ॥ গানের গহীনে বিচরণকারী এক শিল্পী অনুপম রায়। একইসঙ্গে গান বাঁধেন এবং তাতে সুর বসিয়ে কণ্ঠ মেলান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এই শিল্পী একইসঙ্গে দুই বাংলার শ্রোতার কাছেই জনপ্রিয়। হেমন্ত সন্ধ্যায় সোমবার ঢাকার গানপ্রেমীরা শুনলেন এই শিল্পীর গান। অনন্য কণ্ঠ আর সুরের মায়ায় মাতালেন শ্রোতাদের। অনুষ্ঠানে সঙ্গীতানুরাগীদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ ছিল এদেশের জনপ্রিয় দুই শিল্পী ন্যান্সি ও পারভেজ। এরাও রাঙিয়েছেন সুররসিকদের অন্তর। বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটির নবরাত্রি হলে এই তিন শিল্পীর এ কনসার্টের আয়োজন করে অন্তর শোবিজ। সঙ্গীতানুষ্ঠানটি মনোমুগ্ধকর হলেও শুরুটা ছিল চরম বিরক্তিকর। সন্ধ্যা সাতটা থেকেই শ্রোতারা ছিলেন সুরের প্রতীক্ষায়। অপেক্ষার প্রহর বাড়লেও মেলে না কোন শিল্পীর। রাত আটটার পর মঞ্চে আসেন অনুষ্ঠানের প্রথম শিল্পী পারভেজ। পরে সুরের সঙ্গে কথার মায়াজাল বুনে বিড়ম্বনার শিকার শ্রোতাদের উচ্ছ্বাসে রাঙিয়ে দেন অনুপম। প্রতীক্ষার প্রহর গোনা সুররসিকদের মাতিয়ে তোলা এই শিল্পী ও তার ব্যান্ডদল যখন মঞ্চে আসে ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত দশটা। মঞ্চ আবিভূত হলে। বিপুল করতালিতে অভিনন্দন হন অনুপম। উচ্ছ্বসিত সঙ্গীতানুরাগীদের মন রাঙিয়ে প্রথমেই গেয়ে শোনানÑ আমি আজকাল ভাল আছি/তোকে ছাড়াও রাতগুলো আলো হয়ে আছে ...। প্রথম পরিবেশনার পরই কথা দিয়ে শ্রোতার সঙ্গে ঘটিয়ে নেন আপন সংযোগ। বলেন, লাভ ইউ ঢাকা। লাভ ইউ বাংলাদেশ। যতবার বাংলাদেশে আসি মনে হয় যেন চেনা রাস্তায় হাঁটছি। আজ আবেগ আপ্লুত হয়ে আপনাদের শোনাব বেঁচে থাকার গান। এরপর কথার সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়ে গাইলেন ‘বেঁচে থাকার গান’। এ গানের সুর থামতেই শ্রোতার দিকে হাত বাড়িয়ে গাইলেন ‘বাড়িয়ে দাও তোমার হাত/আমি আবার তোমার আঙ্গুুল ধরতে চাই’। এরপর মোহাবিষ্ট শ্রোতাকে আলোড়িত করে গাইলেন হিন্দীর সঙ্গে বাংলা শব্দ মেশানো পিকু ছবির গান ‘দ্য জার্নি সং’। হিন্দী সুর ছেড়ে মুগ্ধতার রেশ নিয়ে আবার ফিরে এলেন বাংলা সুরের মোহনায়। গাইলেন ‘এক অদ্ভুত মুগ্ধ চাই।’ এরপর ৩৩ বসন্ত পার করা শিল্পী গাইলেন শ্রোতানন্দিত গান ‘বসন্ত এসে গেছে’। এ গানের সুরের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হওয়া শ্রোতার করতল থেকে ঝরে পড়েছে করতালি। ঘণ্টা পেরুনো পরিবেশনার পুরোটা সময় ধরেই শ্রোতাকে মোহাচ্ছন্নস করে রাখেন অনুপম। একে একে গেয়ে শোনান ‘এখন অনেক রাত/তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস’, ‘ফিরে গেছে কত বোবা টানেলের বুক চিরে’. ‘ফাঁকা প্রেম’, ‘নেই তো কেউ নেই’ পিকু ছবির গান ‘বে জুবা’সহ একগুচ্ছ গান। সবশেষে পরিবেশন তার তুমুল জনপ্রিয় গান ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও/আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি।’ পরিবেশনা শেষে আবার ঢাকায় আসার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেন অনুপম। অনুপমের গানের মাঝেই ছিল সঙ্গীতানুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা। মঞ্চে আসেন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও অন্তর শোবিজের চেয়ারম্যান স্বপন চৌধুরী। শিল্পীকে শুভেচ্ছা স্মারক তুলে দেন বেনজীর আহমেদ। সঙ্গীতাসরের প্রথম শিল্পী পারভেজ প্রথমে গেয়ে শোনান ‘এ মনের গহীন বাসনায়।’ এরপর গাইলেন হৃদয় খানের সুরে ‘এ জীবন হারিয়ে যায়।’ এরপর একে একে গেয়ে শোনান নচিকেতার জনপ্রিয় দুটি গান ‘স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন দেখে মন’ ও ‘একদিন স্বপ্নের দিন, বেদনার বর্ণবিহীন।’ পারভেজের শেষ পরিবেশনা ছিল ‘পথ গেছে বেঁকে পথের আড়ালে।’ পারভেজের প্রায় আধা ঘণ্টা পর সোয়া ৯টায় মঞ্চে আসেন তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ন্যান্সি। তার পরিবেশিত প্রথম গানের শিরোনাম ছিল ‘পৃথিবীর যত সুখ, যত ভালোবাসা।’ এরপর একে একে পরিবেশন করেন ‘বাহির বলে দূরে থাকুক, ভেতর বলে আসুক না’, ‘বলে তো দিয়েছি হৃদয়ের কথা’ ও ‘আমি তোমার মনের ভিতর একবার ঘুরে আসতে চাই।’ সঙ্গীতানুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন দুই অভিনয়শিল্পী তানিয়া হোসেন ও আরমান পারভেজ মুরাদ। অনুপম রায় ছোটবেলা থেকেই গান করলেও তার সঙ্গীত জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে ২০১০ সালে। ওই বছর সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত ‘অট্রোগাফ’ ছবিতে অনুপমের লেখা, সুর করা ও কোম্পাজিশনে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ গানটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। সেই ছবিতে তিনি ‘বেঁচে থাকার গান’ নামে আরেকটি গান লিখেছেন ও সুর করেছেন। এটি গেয়েছিলেন শিল্পী রূপম ইসলাম। এই গানটিও বেশ জনপ্রিয় হয়। এর পরের বছর ‘চলো পাল্টাই’ চলচ্চিত্রে অনুপম রায় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন। ২০১২ সালে অনুপম রায় ‘হেমলক সোসাইটি নামে আরেকটি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার ও গায়ক হিসেবে কাজ করেন। এই ছবির গান ‘এখন অনেক রাত’ তাকে এনে দেয় অভাবনীয় সাফল্য। ২০১৪ সেেল তিনি ‘হাইওয়ে’ ও ‘চতুষ্কোন ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। সেখানকার ‘বোবা টানেল’ ও ‘বসন্ত এসে গেছে’ গান দুটি সুপার হিট হয়। ২০১৫ সালে অনুপম রায় ‘পিকু’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে বলিউড জগতে পা রাখেন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে। এর বাইরে অনুপম রায় এখন পর্যন্ত তিনটি একক এ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। এগুলো হচ্ছেÑ দূরবীনে চোখ রাখবো না (২০১২), দ্বিতীয় পুরুষ (২০১৩) ও বাক্যবাগীশ (২০১৪)। এই এ্যালবামগুলোর ‘বিজলি বাতি’, ‘তিস্তান’, ‘বেঁচে থাকার গান’, ‘অদ্ভুত মুগ্ধতা গানগুলো শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে। জাদুঘরে প্রাচ্যরীতির চিত্রকর্ম প্রদর্শনী ॥ সোমবার থেকে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে শুরু হলো ‘বাংলাদেশের প্রাচ্যশিল্পের বিস্তার’ শীর্ষক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। শিল্পকলায় প্রাচ্যের স্বতন্ত্র ধারা প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে যৌথভাবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে জাতীয় জাদুঘর ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট। প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশে প্রাচ্যধারার বিশিষ্ট শিল্পীদের চিত্রকর্ম। যেসব খ্যাতিমান শিল্পীর চিত্রকর্ম দিয়ে প্রদর্শনী সাজানো হয়েছে তারা হলেনÑ শফিকুল আমীন, রশিদ চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, অধ্যাপক মু. আবুল কাশেম খান, তাজুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. মোঃ আব্দুস সাত্তার ও নাসরীন বেগম। এছাড়া ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ১২২ শিল্পীর চিত্রকর্ম উপস্থাপিত হয়েছে প্রদর্শনীতে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। সম্মানিত অতিথি ছিলেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল হামিদ, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহম্মদ আজিজ খান, বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খান, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, কবি ও শিল্প সমালোচক রবিউল হুসাইন। সভাপতিত্ব করেন জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। প্রধান অতিথির বক্তব্যের গওহর রিজভী বলেন, চীন, জাপান, কোরিয়া, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশসহ প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গুরুত্বসহকারে প্রাচ্য শিল্পকলার চর্চা। এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে প্রাচ্যের শিল্পীদের শিল্পকর্মের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় মিলেছে। একইসঙ্গে প্রাচ্যধারার শিল্পকর্মের প্রতি তরুণ প্রজন্ম খুঁজে পাবে নতুন দিকনির্দেশনা। সভাপতির বক্তব্যে ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, এ কথা নির্র্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার পুষ্টধারাদি শুরু থেকে পাশ্চাত্য শিল্প চেতনায় আপাদমস্তক অধ্যুষিত। অথচ বঙ্গের নিজস্ব শিল্পকলার শিকড় প্রোথিত রয়েছে ইতিহাসের অনেক গভীরে। এ এক ঐতিহাসিক সত্য যে, পশ্চিমা শক্তিশালী শিল্পচর্চার বিপরীতে প্রাচ্য ধারাটিও কর্ম সমৃদ্ধ নয়। আগামী ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী। শিল্পকলায় ভাওয়াইয়া গানের উৎসব ॥ সোমবার সন্ধ্যায় ভাওয়াইয়া গানের সুরে মুখরিত হলো শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তন। আবহমান বাংলার শেকড়সন্ধানী সঙ্গীতের সুরে সুরে মুগ্ধ হলো শ্রোতাকুল। ভাওয়াইয়ার পঞ্চগীতিকবি মহেশচন্দ্র রায়, আব্বাসউদ্দিন, কছিমউদ্দিন, হরলাল রায় ও আব্দুল আজিজের গান দিয়ে সাজানো হয় শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত সঙ্গীতানুষ্ঠানটি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব বেগম আক্তারী মমতাজ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেন কণ্ঠশিল্পী নাদিরা বেগম, রথীন্দ্রনাথ রায়, ড. নাশিদ কামাল ও বিশিষ্ট গবেষক জেসমিন বুলি। স্বাগত বক্তব্য রাখেন একাডেমির সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের পরিচালক সোহরাব উদ্দীন। আলোচনা শেষে অনুষ্ঠানে শুরু হয় সঙ্গীতাসর। সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণ বিভাগের ভাওয়াইয়া প্রশিক্ষণার্থী দল। একক সঙ্গীত পরিবেশন করে শিল্পী নাদিরা বেগম, রথীন্দ্রনাথ রায়, ড. নাশিদ কামাল, ভূপতি ভূষণ বর্ম, রুখনা আক্তার রূপসা, সুচিত্রা সূত্রধর, আব্দুল্লাহেল রাফি তালুকদার, বিপাশা, সুজিতা রায়, রণজিৎ কুমার রায়। ফারহানা চৌধুরী বেবীর পরিচালনায় লোকজ আঙ্গিকের সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে স্পন্দন।
×