ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জাপানী নারীর মৃত্যুর পর গোপনে দাফন ॥ গ্রেফতার ৫

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৫ নভেম্বর ২০১৫

জাপানী নারীর মৃত্যুর পর গোপনে দাফন ॥ গ্রেফতার ৫

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীতে হিরোই মিয়াতা নামের এক জাপানী নারীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর গোপনে মুসলমান পরিচয়ে কবর দেয়ার ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের ৪ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে ঢাকার সিএমএম আদালত। উত্তরা পূর্ব থানা পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মামলার এজাহারনামীয় এক আসামি পলাতক রয়েছে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে কবর থেকে লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করার অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে পুলিশ। আগামীকাল ঢাকার সিএমএম আদালতে এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। রহস্যজনক এমন ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে মঙ্গলবার বেলা এগারোটায় ঢাকার মহানগর পুলিশের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের ডাক দেয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অনিবার্য কারণবশত তা বাতিল ঘোষণা করে ঢাকা মহানগর পুলিশ। বাংলাদেশস্থ জাপান দূতাবাসের অনুরোধে সংবাদ সম্মেলন বাতিল করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। পুলিশ জানায়, গত ১৯ নবেম্বর বাংলাদেশস্থ জাপান দূতাবাসের ভাইস কনস্যুলার কসোকি মাতসুনাগা উত্তরা পূর্ব থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। যার নম্বর-৯৩৫। ডায়েরিতে বলা হয়, জাপানী নাগরিক মিস ম্যাকিকো হিরাবায়াসি বাংলাদেশস্থ জাপান দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। হিরাবায়াসি গত ৪ নবেম্বর দূতাবাসকে জানান, তার মেয়ে মিয়াতার পাসপোর্ট নম্বর-টিজেড-০৪৪৫৭৭৮। জন্ম ১৯৫৫ সালের ১৬ জুলাই। সে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে আছে। মেয়ের সঙ্গে নিয়মিত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হতো। কিন্তু গত ২৬ অক্টোবরের পর মেয়ের সঙ্গে তিনি আর যোগাযোগ করতে পারছেন না। কারণ মেয়ের মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি দ্রুত মেয়ের অবস্থান জানানোর পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দূতাবাসকে অবহিত করেন। মিয়াতা ঢাকার উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ১৩/বি নম্বর সড়কের সিটি হোমসের ৪ নম্বর বাড়িতে ভাড়ায় বসবাসরত বলেও হিরাবায়াসি জানান। সাধারণ ডায়েরিটির তদন্ত শুরু হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা উত্তরা পূর্ব থানার পরিদর্শক (অপারেশনস) মিজানুর রহমানের তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত ২৩ নবেম্বর এ সংক্রান্ত উত্তরা পূর্ব থানায় দায়েরকৃত মামলায় বলা হয়, মিয়াতা সিটি হোমস আবাসিক হোটেলে কয়েক বছর ধরে বসবাস করছিলেন। তাকে কথিত বাংলাদেশী ব্যবসায়িক পার্টনার মোঃ জাকির পাটোয়ারী রতন (৪২), পিতা-মোতালেব হোসেন পাটোয়ারী, গ্রাম-আসটা, থানা-ফরিদগঞ্জ, জেলা-চাঁদপুর, বর্তমান ঠিকানা-বাড়ি নং-৫১, সড়ক নম্বর-৬/এ, সেক্টর-১২, উত্তরা, ঢাকা এবং মারুফুল ইসলাম (৩০), পিতা- সাইদুর রহমান, গ্রাম-ভগিরহাট, থানা-অভয়নগর, জেলা-যশোর, বর্তমান ঠিকানা-বাড়ি নম্বর-৩৩, সড়ক নম্বর-১২, সেক্টর-১২, উত্তরা, ঢাকা। এ দুজন দেখভাল করত। এছাড়াও রাশেদুল হক বাপ্পী (৪২), পিতা-ফরহাদুল হাসান (মৃত), বালুশাহী নরসিংদী সদর মাঝে মধ্যেই ওই জাপানী মহিলার সঙ্গে হোটেলে গিয়ে দেখা সাক্ষাত করত। গত ২৬ আগস্ট বিকেল ৫টার দিকে রাশেদুল হক বাপ্পী জাপানী নারীকে হোটেল থেকে কৌশলে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর তাঁকে এ তিন ছাড়াও আসামি ফখরুল ইসলাম (২৭), পিতা-মোঃ নুরুল আমিন, গ্রাম-কাটাছড়া, থানা-মীরসরাই, চট্টগ্রামের সহযোগিতায় রাজধানীর ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ১২ নম্বর সড়কের ২৮৮ নম্বর প্লটের কৃষ্ণচূড়া নামের ৬ নম্বর বাড়িতে আটকে রাখে। তাঁর কাছে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতে চাপ সৃষ্টি করে। এ সময় আসামিরা লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানাধীন শেফালীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা স্বর্গীয় হরে কৃষ্ণ শীলের ছেলে ডাঃ বিমল চন্দ্র শীলকে ডেকে নিয়ে আসে। ৫ জন মিলে গত ২৯ অক্টোবর মিয়াতাকে হত্যা করে। হত্যার পর আসামি জাকির পাটোয়ারীর প্রাইভেটকারযোগে লাশটি অপর আসামি মারুফুল ইসলামের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আরেক আসামি জাহাঙ্গীর (২৮), পিতা-মোতালেব হোসেন পাটোয়ারী, গ্রাম-আসটা, থানা-ফরিদগঞ্জ, জেলা-চাঁদপুরসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের সহযোগিতায় মিয়াতার নাম পরিবর্তন করে হালিমা খাতুন, স্বামী-বাবুল মৃধা (মৃত), গ্রাম-পোতপাড়া, থানা-অভয়নগর, জেলা-যশোর, মুসলিম পরিচয়ে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের সিটি কর্পোরেশনের কবরস্থানে গত ২৯ অক্টোবর বিকেলে দাফন করে। আসামিরা মিয়াতার ব্যক্তিগত ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী লুটে নেয়। পরবর্তীতে বাপ্পীর কাছ থেকে মিয়াতার ল্যাপটপটি উদ্ধার করা হয়। দায়েরকৃত মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণের পর হত্যাসহ লাশ গুমের অভিযোগ করা হয়। মামলার এজাহারনামীয় ৬ আসামির মধ্যে একমাত্র জাকির পাটোয়ারী রতন ছাড়া ৫ জনকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত ২৩ নবেম্বর মিয়াতার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে কবর থেকে লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করার অনুমতি চেয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে আবেদন করেন মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা। আদালত আবেদন আমলে নিয়ে আগামীকাল শুনানির দিন ধার্য করেন। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, মিয়াতার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে গ্রেফতারকৃত ৫ আসামি মারুফ, রাশেদ, ফখরুল, জাকির পাটোয়ারী ও ডাঃ বিমল চন্দ্র শীলকে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোর্পদ করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা উত্তরা পূর্ব থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আবু বকর মিয়া। শুনানি শেষে ম্যাজিস্ট্রেট স্নিগ্ধা রানী সাহা আসামিদের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মিয়াতা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বসবাস করে আসছিলেন। কিন্তু ২০০৬ সালে তাঁর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করে আসছিলেন। তিনি বাংলাদেশে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া জাপান সরকারের পেনশনও পেতেন তিনি। গ্রেফতারকৃতদের দাবি, হোটেলে বসবাসের কারণে মিয়াতার অনেক টাকা বিল জমে যায়। টাকা দিতে পারছিলেন না মিয়াতা। এমন পরিস্থিতিতে তারা মিয়াতাকে আড়াই মাস আগে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে মারাত্মক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন মিয়াতা। মিয়াতার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার ফলে তিনি স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের অবৈধ নাগরিক হয়ে যান। অবৈধ বিদেশী নাগরিককে হাসপাতালে ভর্তি করানো ঝামেলা হতে পারে ভেবে তারা মিয়াতাকে বাসায়ই চিকিৎসা দেন। কিন্তু কোনক্রমেই মিয়াতা সুস্থ হচ্ছিল না। এরপর তাদের পরিচিত চিকিৎসক ডাঃ বিমল চন্দ্র শীলকে লক্ষ্মীপুর থেকে ডেকে এনে চিকিৎসা করান। তাতেও ফল হয়নি। এক পর্যায়ে গত ২৯ অক্টোবর মিয়াতার মৃত্যু হয়। অবৈধ নাগরিক হিসেবে মিয়াতার লাশ জাপানে পাঠানো ঝামেলা মনে করে, তাঁকে মুসলিম পরিচয়ে বাংলাদেশেই দাফন করা হয়। পুলিশ বলছে, আসামি ও মিয়াতার বাংলাদেশে পরিচিতজনদের দেয়া বক্তব্যে ফাঁক রয়েছে। কারণ লক্ষ্মীপুর থেকে চিকিৎসককে ঢাকায় এনে মিয়াতাকে চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন নেই। ঢাকা থেকেই কোন চিকিৎসককে দিয়ে এবং কোন সরকারী বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব ছিল। এছাড়া বিষয়টি পুলিশকে জানানো প্রয়োজন ছিল। সেক্ষেত্রে পুলিশ নিজেই দায়িত্ব নিয়ে মিয়াতার চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করত। প্রয়োজনে পুলিশের তরফ থেকে বাংলাদেশস্থ জাপান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যেত। বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধু দেশ জাপানের একজন নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় তিনি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন, সরকার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অতটা নির্দয় নয়। এটি অত্যন্ত মানবিক ও স্পর্শকাতর বিষয়। অনায়াসে আসামিরা পুলিশকে বিষয়টি খোলাসা করে বলতে পারত। কিন্তু তারা সেটি করেননি। আসামিদের বক্তব্য যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। পুলিশ অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তদন্ত করেই অপহরণের পর হত্যা এবং হত্যার পর লাশ গুমের অভিযোগ এনে মামলাটি দায়ের করেছে। সার্বিক দিক তদন্ত করেই পুলিশ হত্যা মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, মিয়াতার মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটন করতে পুলিশ গুরুত্বের সঙ্গে গভীরভাবে মামলাটি তদন্ত করছে। মিয়াতার মৃত্যু সংক্রান্ত সার্বিক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশস্থ জাপান দূতাবাসের সঙ্গে বিভিন্ন চ্যানেলে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দলের নির্ধারিত বাংলাদেশ সফর বাতিলের কয়েক ঘণ্টা পরেই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকার গুলশান-২ নম্বর কূটনৈতিক পাড়ার ৯০ নম্বর সড়কের মাথায় ফিল্মি স্টাইলে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলাকে (৫০) গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় হত্যাকা-ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলসহ যুবদলের ৩ ক্যাডারসহ ৫ জন গ্রেফতার হয়। তাভেলা নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এনজিও আইসিসিও কোঅপারেশন বাংলাদেশের প্রফিটেবল অপরচ্যুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ছিলেন। এনজিওটি ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে পানি, সেনিটেশন, রিফিওজি সমস্যা ও পুনর্বাসনসহ নানা সমাজসেবামূলক কাজ করে আসছে। এমন ঘটনার পর পরই চলতি বছরের ৩ অক্টোবর রংপুরে তাভেলার মতো একই কায়দায় গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় জাপানী নাগরিক হোশি কুনিওকে (৪৮)। পুলিশ এ ঘটনায় বিএনপির দুই নেতা ও শিবিরের ৫ নেতাকর্মীসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়া পাবনার ঈশ্বরদীর ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গড’-এর ফাদার লুক সরকারকে (৫০) ঈশ্বরদীর বাসায় গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে তিন সন্ত্রাসী। গত ৫ নবেম্বর উত্তরায় বসবাসরত তাইওয়ানের দম্পতি ব্যবসায়ী ওয়াং মিং চি (৫৪) ও তার স্ত্রী লিও লি হুয়াকে (৪৮) বাসায় ঢুকে তার ব্যবসায়িক পার্টনাররা ছুরিকাঘাতে আহত করে। পুলিশ কয়েকজনকে আটক করেছে। এছাড়া দিনাজপুরে এক ইতালীয় নাগরিক পিয়েরোকে (৫৭) লক্ষ্য করে দিনদুপুরে বাসস্ট্যান্ডে ফিল্মি স্টাইলে মোটরসাইকেলযোগে ৩ সন্ত্রাসী গুলি চালায়। ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ বিদেশীকে তাৎক্ষণিকভাবে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়। তিনি এখন আশঙ্কামুক্ত।
×