ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ নুরুজ্জামান

জনসনের আবেগময় অবসর

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৫ নভেম্বর ২০১৫

জনসনের আবেগময় অবসর

টাইফুন, হারিকেন, সুনামি- নাহ্, বল হাতে গতির ঝড় তোলা জনসনের জন্য যুতসই বিশেষণ খুঁজে পাওয়া ভার। পল রাইফেলের কথা মনে আছে? দ্রতগতির জন্য যাকে কেবল ‘রাইফেল’ ডাকতেই পছন্দ করতেন সতীর্থরা, মিচেল জনসনকে বলতেন ‘মিসাইল!’ বাস্তবের এই যুদ্ধাস্ত্র যেমন ভেঙে চুরমার কর দিয়েছে শত্রুশিবির, তেমনি বল হাতে অবলীলায় প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের জীবন সংহার করেছেন জনসন। দুরন্ত সাফল্যে ক্রিকেটবিশ্বের সবটুকো আলো কেড়ে নিয়েছেন ৩৪ বছরের কুইন্সল্যান্ড হিরো। হুট করেই ক্রিকেট ছাড়লেন সেই ‘মিসাইল’। বয়স, ফর্ম কোন বিচারেই অন্তত ‘বিদায়’ বলার সময় আসেনি। কিন্তু ইঙ্গিতের সঙ্গে মিলিয়ে ঘোষণার বেলায়ও চরম পেশাদারিত্বের পরিচয় দিলেন তিনি! এই হলো অস্ট্রেলীয় মানসিকতা। এ্যাশেজ চলাকালেই মনের কোণে ভাবনাটা উঁকি দিয়েছিলে, যখন মিছিলের অগ্রভাগে মাইকেল ক্লার্কসহ ছয় ক্রিকেটার। কেবল সাদা পোশাকের টেস্ট নয়, সকল ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেই অবসর নিলেন আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার সফলতম এই পেসার। বিদায়ের ঘোষণা দিয়ে জনসন বলেন, ‘আমি অনেক ভাগ্যবান যে এমন দুর্দান্ত একটা ক্যারিয়ার পেয়েছি। দেশের হয়ে খেলার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেছি। এই পথ চলাটা ছিল অসাধারণ। তবে বাস্তবতা মেনে একদিন শেষ টানতেই হতো, তারজন্য ওয়াকার (পার্থের ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট গ্রাউন্ড) চেয়ে ভাল জায়গা আর কি হতে পারত।’ আগের এ্যাশেজ (২০১৪) এবং ততপরবর্তী সময়ের কথা ক্রিকেটপ্রেমীদের নিশ্চই মনে আছে। বল হাতে দুর্দান্ত সাফল্যের সঙ্গে গোঁফ রাখায় চেহারায় একটা ‘ডেনিস লিলি’ ভাব চলে এসেছিল! মজার ব্যাপার, জনসন নামের এই ‘সোনার টুকরা’ চিনতে পারা প্রথম জহুরি কিন্তু লিলিই। সে দিকটি মনে করিয়ে দিয়েই জনসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। একজন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারের জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে। জনসনকে উদ্দেশ করে লেখা বিবৃতিতে সিএ জানায় ‘ডেনিস লিলিই সর্বপ্রথম জনসনকে অস্ট্রেলিয়ার ভবিষ্যত বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি পুরোপুরি সঠিক ছিলেন। গোঁফওয়ালা জনসন অনেকদিক দিয়েই সর্বোচ্চ শিখরে থাকা, টগবগে লিলির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। সেটি কেবল চেহারা-বেশভুষায় নয়, মাঠে লিলির মতো ভয়ঙ্কর ফার্স্ট বল করে।’ পার্থে দ্বিতীয় টেস্ট শুরু হওয়ার আগেই গুঞ্জন ওঠে, ‘অবসরে যাচ্ছেন জনসন।’ খেলার তৃতীয় দিনে সেই গুঞ্জন আরও ডালপালা মেলে যখন দেখা যায় ড্রেসিংরুমে জনসনের রাজ্য দলের ম্যানেজারকে। পরদিন সেটিরই বাস্তবায়ন ছোট্ট এক ঘোষণায়, যখন জনসন বললেন, ‘অবসরের জন্য এটাই সবচেয়ে ভাল সময়।’ তবে বল হাতে সময়টা খুব একটা ভাল যাচ্ছিল না। জীবনের শেষ এই টেস্টে তো একটা অস্বস্তির রেকর্ডেই নিজের নাম জড়িয়ে গেছে। প্রথম ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের ১ উইকেট শিকারের জন্য খরচ করেছেন ১৫৭ রান। ওয়াকা গ্রাউন্ডে আর কোন বোলারকে এত রান খরচ করতে হয়নি। জনসন খরুচে ছিলেন ব্রিসবেনের প্রথম টেস্টেও। ৪ উইকেট পেলেও ক্যারিয়ারের অভিষেক ভেন্যুতে বল হাতে দিয়েছিলেন ১৬৩ রান। তবে দুটি টেস্ট দিয়ে কি আর ‘সোনার টুকরা’ এক পেসারকে বিচার করা যায়? রেকর্ডই তার প্রমাণ। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি জনসন। আট বছরের ক্যারিয়ারে মাত্র ৭২ টেস্টে নিয়েছেন ৩১১ উইকেট (পার্থে দ্বিতীয় ইনিংস বাদে)। অস্ট্রেলীয়দের মধ্যে উইকেট শিকারে তার চেয়ে এগিয়ে কেবল শেন ওয়ার্ন (৭০৮), ডেনিস লিলি (৫৬৩) ও গ্লেন ম্যাকগ্রা (৩৫৫)। এর মধ্যে ওয়ার্নই কেবল স্পিনার। পরিসংখ্যানকে যারা গাধার সঙ্গে তুলনা করতে চান, তাদের জন্য তথ্য, সেটি বাদ দিলেও জনসন তার আগ্রাসী মনোভাবের জন্য ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন। গোলার মতো বুক সমান বাউন্সার, কিংবা রিভার্স সুইং, অথবা দুরন্ত ইয়র্কারে ব্যাটসম্যানের স্টাম্প উপড়ে দেয়া দারুণ সব দৃশ্যের জন্ম তো তিনিই দিয়েছেন। জনসনের ভয়ঙ্কর এই রূপটা সবচেয়ে বেশি দেখেছে চিরশত্রু ইংল্যান্ড। ২০১৩ এ্যাশেজে তো বলতে গেলে প্রতিপক্ষকে একাই ধসিয়ে দিয়েছেন। ৫ টেস্টে নিয়েছিলেন ৩৭ উইকেট। এমন একজনের আচমকা অবসরে কিছুটা বিস্মিত স্টিভেন স্মিথ। স্টিভেন স্মিথ বলেন, ‘সত্যি বিস্মিত হয়েছি। তবে আমি তার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। জনসন ছিল অসি পেসাদারিত্বের চরম এক উদাহরণ। ব্যাগিগ্রীন ক্যাপে সর্বশেষ সে ৩শ’ উইকেটের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। মাঠে ওর সঙ্গী হতে পেরে আমরাও গর্বিত’ টেস্ট দিয়ে বিদায় বললেও জনসন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছিলেন ওয়ানডে দিয়ে। ২০০৫ সালে। ১৫৩ ওয়ানডেতে নিয়েছেন ২৩৯ উইকেট। ফিলিপ হিউজের অকাল মৃত্যু অনেকের মতো জনসনকেও বদলে দিয়েছিল। ফার্স্ট বোলার হিসেবে একটা সময় যেখানে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের দিকে বাউন্সার দিয়ে তৃপ্ত হতেন জনসন, হিউজের মৃত্যুর পর সেই তৃপ্তিটাই পরিণত হয় আতঙ্কে। বন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি আর বাউন্সার দিয়ে আনন্দ পেতেন না, উল্টো মনে হতো, প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের জায়গায় হিউজকে বসিয়ে এক ধরনের দুঃখবোধ পেয়ে বসত তাঁকে। এই ব্যাপারটিই নাকি এক বছরের মাথায় ঠেলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে। হিউজের মৃত্যুর পর একজন ফার্স্ট বোলার হিসেবে ক্রিকেট খেলাটা তাঁর কাছে অর্থহীনই মনে হয়েছে। ‘ফিলের মৃত্যু আমাকে ?দুঃখ ও বেদনাবোধে ভারাক্রান্ত করে। তাঁর মৃত্যু গোটা বিশ্বেই ক্রিকেটারদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। ওর মৃত্যু কিন্তু ক্রিকে?ট খেলার ধরনে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এনেছে।’ প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর পর থমকে গিয়েছিলেন জনসন। ক্রিকেট বলের দিকে তাকালেই এক ধরনের আতঙ্কবোধ কাজ করত তাঁর মনে। মনে হতো, এমনই একটি বলের আঘাতেই তো ফিল ওপারে চলে গেছে। প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক ফার্স্ট বোলার হয়েও বোলিংয়ের ধরনে পরিবর্তন এনেছিলেন বলে গতিও কমিয়ে দিয়েছিলেন। মাঝে-মধ্যে অভ্যাসবশত দুই-একটা শর্ট পিচ বল হয়ে গেলেই প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের জন্য মায়া অনুভব করতেন। ভাবতেন, সে হয়ত আমার প্রতিপক্ষ। কিন্তু ওর তো একটা পরিবার আছে। পরিবারের সবাই হয়ত সারাক্ষণ তাকিয়ে আছে ওর দিকে, ‘আমি ব্যাটসম্যানদের শরীরে যে দুই-একবার বল লাগিয়েছি। তাতে আমার ওদের প্রতি মায়া লেগেছে। ওদের পরিবারের কথা মনে হয়েছে। চিন্তা করেছি, শরীরে বল লাগিয়ে আমি মোটেও ঠিক কাজ করছি না। এটা কখনোই ক্রিকেটীয় চেতনার পরিপূরক নয়।’
×