ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এরাই হত্যার হুমকি দেয় ॥ বিশিষ্টজনের প্রাণ সংহারের হুমকি দিত জামায়াত শিবির

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৬ নভেম্বর ২০১৫

এরাই হত্যার হুমকি দেয় ॥ বিশিষ্টজনের প্রাণ সংহারের হুমকি দিত জামায়াত শিবির

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিশিষ্ট নাগরিকদের হত্যার হুমকি, কয়েকটি হত্যাকাণ্ড এবং এর দায় স্বীকার করে আইএসের নামে বিবৃতি দেয়ার ঘটনায় সরাসরি জামায়াত-শিবির জড়িত। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকটি জঙ্গী সংগঠন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া এই প্রক্রিয়ারই অংশ। আন্তর্জাতিকভাবে সরকারকে চাপে রাখতে এবং মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পরিকল্পিতভাবে এমন অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। বিশিষ্ট নাগরিকদের হত্যার হুমকিদাতা এবং আইএসের নামে বিবৃতিদাতা দু’জনকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে বের হয়ে আসে এমন তথ্য। হত্যার হুমকির অভিযোগে মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হয় জামায়াত ক্যাডার আবদুল হককে। আইএসের দায়িত্ব স্বীকার করার অভিযোগে একই দিনে গ্রেফতার করা হয় শিবিরকর্মী নাহিদকে। গোটা প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্য বের করার জন্য দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। বুধবার দুুুুুুপুরে গ্রেফতারকৃতদের সম্পর্কে তথ্য জানান মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুজ্জামান। মিন্টু রোডে অবস্থিত গোয়েন্দা পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম ও মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম, মাহবুব আলম, সাজ্জাদুর রহমান ও মুনতাসিরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ কমর্কতারা জানান, মোবাইল ফোন নম্বর ক্লোন করে একের পর এক শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-লেখক-মন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হুমকি দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রের ১৫৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হুমকি দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এ সংক্রান্ত অভিযোগও দায়ের হয়েছে। মূলত যেসব মোবাইল নম্বর ক্লোন করে হুমকি দেয়া হচ্ছে, সেসব নম্বরের মালিকরা তা জানেন না। সম্প্রতি কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যার দায় স্বীকার করে একই কায়দায় আইএস ও বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের নামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আইএস-এর তরফ থেকে এমন দায় স্বীকার করার কোন ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্পুফিং বা ক্লোন করে শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-লেখক-ইতিহাসবিদ, মন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হুমকি দেয়ার সঙ্গে জড়িত জামায়াত কর্মী এবং সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস-এর নামে বিবৃতিদাতা শিবিরকর্মী গ্রেফতারের পর প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে, গ্রেফতারকৃতরা ঠিকমতো ধর্ম পালন করেন না। এমনকি তারা নিয়মিত নামাজও পড়েন না। উপরন্তু নানা অনৈতিক কর্মকা-ে তারা জড়িত। আইএস বা আল কায়েদার সঙ্গে যোগাযোগ থাকার ন্যূনতম কোন তথ্যও মেলেনি তাদের জিজ্ঞাসাবাদে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ১৫৩ জনকে হুমকির বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেসব অভিযোগের তদন্ত চলছে। তদন্তের ধারাবাহিকতায় পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (গোপনীয়) মোঃ মনিরুজ্জামান ও ডিবির পশ্চিম বিভাগের উপ-কমিশনার মোঃ সাজ্জাদুর রহমানের নির্দেশনায় ডিবির পশ্চিম বিভাগের এডিসি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে সিনিয়র সহকারী কমিশনার মোঃ যায়েদ শাহ্রীয়ার ও মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে গ্রেফতার হয় জামায়াত কর্মী আব্দুল হক। তিনি নিজের পরিচয় গোপন করে ফাইজুর রহমান, সালেহ আহম্মেদ ফোয়াদ ও মাওলানা সাদ নামে আইডি খোলেন। এ তিন জনের মোবাইল ফোন নম্বর স্পুফিংয়ের মাধ্যমে ব্যবহার করে আসছিল। স্পুফিং এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে অন্যের মোবাইল নম্বর থেকে ফোন বা হুমকি দেয়া সম্ভব। কিন্তু মোবাইল নম্বরটির প্রকৃত মালিক তা জানতেই পারবে না। তিন জনের মোবাইল ফোন থেকে আব্দুল হক হুমকি দেয়। পরবর্তীতে মোবাইল ফোন নম্বরের সূত্র ধরে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ এবং প্রযুক্তিগত পর্যালোচনায় দেখা যায়, যে তিন জনের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে, তারা বিষয়টি জানেন না। গভীর তদন্তে ধরা পড়ে এমন কৌশলী হুমকি দেয়ার সঙ্গে আবদুল হক জড়িত। পরবর্তীতে আবদুল হকও গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও তার অপরাধ স্বীকার করে। আবদুল হক এমন পদ্ধতিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বুদ্ধিজীবী ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন, বুদ্ধিজীবী, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহম্মেদ, দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান ছাড়াও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। গত ১৬ নবেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক জানিয়েছিলেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে যে নম্বর থেকে হুমকি দেয়া হয়েছিল, তার মালিককে আটক করেছিল পুলিশ। পরে তদন্তে দেখা যায়, ওই ব্যক্তি নির্দোষ। তার নম্বর ক্লোন করে আরেকজন ওই হুমকি দিয়েছে। ডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আবদুল হক মোহাম্মদপুরের একটি মাদ্রাসার খ-কালীন শিক্ষক। পাশাপাশি তিনি সিলেটের জকিগঞ্জের একটি কওমী মাদ্রাসার কম্পিউটার শিক্ষক। প্রযুক্তি জ্ঞান ও ইংরেজীতে তার ব্যাপক দখল। তার লেখা অনেক বইও রয়েছে। ছাত্র জীবনে আবদুল হক ও তার স্ত্রী এবং ফাইজুর রহমান সহপাঠী ছিল। প্রেম করে বান্ধবীকে বিয়ে করে। আবদুল হক ও তার স্ত্রী সহপাঠী হওয়ায় ফাইজুর নিয়মিত আবদুল হকের বাসায় যাতায়াত করত। পেশাগত কারণে আবদুল হক বিভিন্ন সময় নানা জায়গায় অবস্থান করতেন। অন্তত বছরখানেক আগ থেকেই যাতায়াতের সূত্রধরে স্ত্রীর সঙ্গে ফাইজুরের অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে বলে সন্দেহ আবদুল হকের। সেইসূত্র ধরে ফাইজুরের সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এরই সূত্র ধরে আবদুল হক ফাইজুরের এক বোনকে অপহরণ করে ৫ দিন আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালায় বলে ফাইজুরের অভিযোগ। দুই বন্ধুর এমন একে অন্যকে দোষারোপের বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করতে গিয়ে বিপদে পড়েন ফোয়াদ ও মাওলানা সাদ। আবদুল হক তিন জনকেই ফাঁসিয়ে দিতে এবং জামায়াতের হয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রাখতে তাদের মোবাইল নম্বর স্পুফিং করে সমাজের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের হুমকি দেন। তিনি অর্থমন্ত্রীকেও ফাইজুরের নম্বর স্পুফিং করে হুমকি দিয়েছিল। ওই ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। এতে একদিকে ব্যক্তিগত জেদ রক্ষা হচ্ছিল, আরেক দিকে দেশের খ্যাতিমান মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যা দেশের ভাবমূর্তিকে দেশ-বিদেশের প্রশ্নের মুখে ফেলে। অর্থমন্ত্রীকে হুমকি দেয়ার কারণে ফাইজুরকে জেল খাটতে হয়েছিল। অথচ ফাইজুর এর আদ্যোপান্ত কিছুই জানত না। সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্ত হয় ফাইজুর। এরপর আবার ফাইজুরকে ফাঁসিয়ে দেয় আবদুল হক। ঘটনার সঙ্গে নানাভাবে জড়িতরা সবাই সিলেটের বাসিন্দা। ডিবির দলটি মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর বাড্ডা থানাধীন হোসেন মার্কেটে অভিযান চালায়। অভিযানে বাংলাদেশের কথিত জিহাদি জন পরিচয়ে আইএস-এর হয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে বিবৃতিদাতা শিবিরকর্মী নাহিদকে গ্রেফতার হয়। সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম জানান, নাহিদ ফেসবুকে আইএস-এর লোগোসহ ইসলামিক স্টেট-দাওলা আল ইসলামিয়া নামে একটি পেজ খোলে। এরপর কথিত আইএস- এর পক্ষে বাংলায় বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে আসছিল। ওই পেজের সে এডমিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল। এই ফেসবুক পেজে থেকেই সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ব্লগার, প্রকাশক, লেখক ও বিদেশী হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস-এর নামে বাংলায় দায় স্বীকার করে। ফেসবুক এ্যাকাউন্টে বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে এই গ্রুপের অন্যদের আইএস-এর বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করত। এর আগে সে শিয়া কাফের নামে একটি ফেসবুক পেজের এডমিন হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছে। সেখানে শিয়া সম্প্রদায় সম্পর্কে বিভিন্ন উস্কানিমূলক মন্তব্য প্রচার করা হতো। এছাড়া খালিদ বিন ওয়ালিদ, জিহাদি জন ও আর্মি ক্যাপ্টেন এ্যাট খিলাফত নামে আইডি খুলে বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে আসছিল। নাহিদ পরিকল্পিতভাবে এসব পেজ খুলে কথিত আইএস-এর নামে অনলাইনে নানা কার্যক্রম চালিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœসহ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছিল। সম্প্রতি লেখক অভিজিৎ রায়, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলা চালিয়ে প্রকাশক ও দুই লেখককে হত্যাচেষ্টা, ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা ও রংপুরে জাপানী নাগরিক হোশি কুনিওসহ কিছু চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। এসব হত্যার দায় স্বীকার করে ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আইএস, আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের শাখা (একিউআইএস), নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এ ব্যাপারে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে আইএস বা একিউআইএস-এর কোন তৎপরতা নেই। তবে এসব সংগঠনের অনুসারী রয়েছে। অনুসারী সংগঠনের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত একটি বিশেষ ইসলামী দল রয়েছে। এ দলটির সমমনা কিছু দল ছাড়াও বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবি ও হিযবুত তাহরীর রয়েছে। এসব দল বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার পক্ষে। এরা আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বিভিন্ন সময় নানা অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা এবং নানা নাশকতামূলক কর্মকা- চালাচ্ছে। মূলত দেশকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রাখতে এবং দেশবাসীকে আতঙ্কিত করতেই তারা এমন অপতৎপরতা চালিয়ে আসছে।
×