ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অদেখা অলৌকিক রস আস্বাদনে সমুদ্রস্নান রাধাকৃষ্ণের স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৬ নভেম্বর ২০১৫

অদেখা অলৌকিক রস আস্বাদনে সমুদ্রস্নান রাধাকৃষ্ণের স্মৃতি

মোরসালিন মিজান ॥ একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো/ লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা/ ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি/ ভিতরে রাস-উৎসব...। এই বঞ্চিতের ব্যথা আর কারও নয়, প্রিয় কবি সুনীলের। রাস উৎসবে যোগ দেয়া হয়নি তাঁর। তবে এতে অংশগ্রহণ করার যে আকাক্সক্ষা, তাঁর কবিতায় দারুণভাবে প্রকাশিত। এমন আকাক্সক্ষাই বলে দেয়, রাস কতটা আকর্ষণীয়! এটি মূলত মণিপুরীদের উৎসব। হলে কী হবে? আরও অনেক ধর্মীয় উৎসবের মতোই অসাম্প্রদায়িক চেহারা পেয়েছে। এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে রাস উৎসব বা মেলার আয়োজন করা হয় সেখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই বেশি। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাস একটি অতি প্রাচীন উৎসব। একই উৎসব রাসলীলা নামে পরিচিত। বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণের আধ্যাত্মিক রাসলীলার অনুকরণে রাসমেলার আয়োজন করা হয়। লোক সংস্কৃতির গবেষক ড. শেখ গাউস মিয়ার মতে, ‘রস’ থেকে ‘রাস’। রস অর্থ সার, নির্যাস, আনন্দ, অমৃত। বৈষ্ণব দর্শনে রস বলতে মধুর রসকে বোঝায়। উপনিষদে ব্রহ্মাকে রসস্বরূপ বিবেচনা করা হয়। এই অদেখা অলৌকিক রস যখন মূর্তিরূপ পরিগ্রহ করে তখন তা হয় রাস। রস-আস্বাদনের লক্ষ্যে রাস উৎসব উদ্যাপিত হয়। যতদূর তথ্য, ১৯২৩ সালে হরিচাঁদ ঠাকুরের বনবাসী ভক্ত হরিভজন এ মেলা শুরু করেন। আবার অনেকের মতে, শত বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ কার্তিকের পূর্ণিমা রাতে গঙ্গাস্নানের আদেশ পান। পাপমোচন ও পুণ্যলাভের আশায় এই স্নান শুরু হয়। তখন থেকেই রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আরও মত আছে। যেমনÑ কার্তিকের পূর্ণিমা রাতে শ্রীকৃষ্ণ বনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাসলীলা করেছিলেন। সেই থেকে রাস মেলা। এখন তা সার্বজনীন উৎসবে রূপলাভ করেছে। কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সে অনুযায়ী, এরই মাঝে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়ে গেছে উৎসব। মঙ্গলবার থেকে সুন্দরবনের দুবলার চরে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী রাস উৎসব। মংলা থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি আহসান হাবিব হাসান জানান, এবারও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগে ভাগেই উৎসবস্থলে আসতে শুরু করেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ। রাজধানী ঢাকা থেকে যোগ দিয়েছেন প্রচুর পর্যটক। আছেন বিদেশীরাও। সনাতন বিশ্বাস মতে, ভোরে সাগরের প্রথম জোয়ারের জলে স্নান করলে পাপামাচন হয়। এ বিশ্বাস থেকে সূর্য ওঠার আগেই পুজো সামগ্রী নিয়ে সাগর পাড়ে বসছেন পুণ্যার্থীরা। সূর্য ওঠার পর জোয়ার শুরু হলে জল পুণ্যার্থীদের ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আর তার পর তাঁরা সাগরে স্নান করতে নামছেন। এর বাইরেও চলছে পূজা-অর্চনা, কীর্তনসহ নানা আচার অনুষ্ঠান। আকর্ষণীয় পণ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে মেলার স্টলসমূহ। বর্তমানে আলোরকোলসহ আশপাশের বিভিন্ন চর উৎসবে মুখরিত। আজ বৃহস্পতিবার ভোরে পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে রাসমেলা। সুন্দরবনে মাছ ধরার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন এই মেলার মাধ্যমে হয় বলেও জানায় স্থানীয়রা। সুন্দরবনের একদিন পর বুধবার রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে মৌলভী বাজারের কমলগঞ্জে। সেখানকার নিজস্ব সংবাদদাতা সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন জানান, স্থানীয় মণিপুরী সম্প্রদায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে উৎসবটি উদ্যাপন করে আসছে। মণিপুরী সমাজে রাস উৎসবের প্রবর্তন করেন মণিপুরের রাজা মহারাজ জয়সিংহ। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ১৭৬৪-১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ। বাংলাদেশে মণিপুরীরা স্থায়ী বসতি স্থাপনের পর ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়াম-পে এ উৎসব আয়োজন করা হয়ে আসছে। এবারও উসব শুরু হয়ে যায় বিকেল থেকে। এ সময় ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী পোশাক পরে অদ্ভুত সুন্দর রাখাল নাচ পরিবেশন করে শিশুরা। রাতে তরুণীরা অংশ নেয় রাসনৃত্যে। মণিপুরী সঙ্গীত ও নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে কৃষ্ণ-অভিসার, রাধা-গোপী অভিসার, রাগ আলাপন ইত্যাদি তুলে ধরা হয়। এখানেও হাজার হাজার মানুষ। দেশী-বিদেশী অতিথিদের উপস্থিতিতে সরব ছিল গোটা এলাকা। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতসহ আরও বেশ কিছু এলাকায় রাস উৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে। এভাবে নতুন প্রাণ পাচ্ছে শত শত বছর আগের পুরনো রাস উৎসব।
×