ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন

পদ্মা সেতুর মূল পাইলিং ও নদী শাসনের কাজ পুরোদমে শুরু হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৬ নভেম্বর ২০১৫

পদ্মা সেতুর মূল পাইলিং ও নদী শাসনের কাজ পুরোদমে শুরু হচ্ছে

মীর নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ থেকে ॥ মাওয়ায় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নতুন অগ্রগতি যুক্ত হতে যাচ্ছে। সেতুটির মূল পাইলিং এবং নদী শাসনের কাজ পুরোদমে শুরু হচ্ছে। আর এই কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই দিনটি হচ্ছে ১২ ডিসেম্বর। মুন্সীগঞ্জ মুক্ত দিবসের পরদিন। তাই এ নিয়ে প্রশাসনের চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। প্রধানমন্ত্রীর আগমনের খবরে কর্মযজ্ঞের গতি গেছে বেড়ে। দেশী-বিদেশী কয়েক হাজার মানুষের হরদম কাজের ছন্দে বিশেষ পরিস্থিতি চলছে মাওয়ায়। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের জন্য পদ্মা সেতু সার্ভিস এরিয়া মাওয়ায় ভিভিআইপি কটেজ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ১০ নম্বর কটেজটি ইতোমধ্যে প্রসস্তুত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এদিন সকাল ১০টায় জাজিরা ল্যান্ডিং পয়েন্টে পদ্মা সেতুর নদী শাসনের কাজের উদ্বোধন করবেন। এর পরে তিনি চলে আসবেন মুন্সীগঞ্জের লৌজংয়ের মাওয়ার কাছে পদ্মা নদীতে। এখানে সাত নম্বর পিলারে পাইলিং কাজের উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধন শেষে তিনি মাওয়াতে একটি জনসভায় বক্তব্য রাখবেন। মাওয়ায় মধ্যাহ্নভোজো ব্যবস্থা থাকছে। পরে তিনি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন শেষে হেলিকপ্টারযোগে বিকেলে ঢাকায় ফিরবেন। আর এসব নিয়েই এখন প্রশাসন ব্যস্ত। বুধবার বিকেলে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সরজমিনে পদ্মা সেতুর এ প্রান্ত মাওয়া এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এর আগে সেতু সচিব আনোয়ারুল ইসলাম, প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম ও চায়না মেজর ব্রিজের উর্ধতন প্রকৌশলীরা পাইলিং এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ঘুরে গেছেন পুলিশের আইজি শহীদুল হক। পদ্মা সেতুকে ঘিরে সেনাবাহিনীর জন্য ক্যান্টনমেন্ট তৈরি ছাড়াও দু’পারে তৈরি হবে দু’টি থানা। বুধবার সরজমিনে পদ্মা সেতুর মাওয়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের বিশাল ওয়ার্কশপ থেকে বের করা হচ্ছে বড় বড় পাইল। রেললাইনের ন্যায় ক্রেন লাইনে করে সেই পাইল স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামছে পদ্মার পাড়ে নোঙর করা জাহাজে। সেখান থেকে পাইলিংয়ের বিশাল পাইলগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পিলার তৈরির স্থানে। বুধবার থেকে শুরু হয়েছে পদ্মা নদীর উপর পাইল সাজানোর কাজ। মাওয়া ঘাট থেকে এক কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদীর উপরে সাত নম্বর পিলারের কাছে প্রথম পাইলিং শুরু হবে। এজন্য সেখানে জড়ো করা হচ্ছে পাইলিং কাজের সরঞ্জামাদি। মঙ্গলবার থেকেই পিলারের আশপাশ ঘিরে শুরু হয়েছে নানা প্রস্তুতি। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরই মূল পাইল ড্রাইভিং শুরু হবে। রাক্ষুসী পদ্মা এখন শান্ত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে পদ্মায় এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন সেতু কর্তৃপক্ষ। চলছে রড, সিমেন্ট ও কংক্রিটের মহা কর্মযজ্ঞ। ব্যস্ততা বেড়েছে চীনা প্রকৌশলী, সেতু কর্মকর্তাসহ নির্মাণ শ্রমিকদের। সাত নম্বর পিলারে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ভারি ক্রেন রাখা হয়েছে। যা দিয়ে পাইল ওঠা-নামার কাজ করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের জন্য ওয়ার্কশপ এলাকার ভেতরে গড়ে তোলা পাইল ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডের ভেতর সুনিপুণভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে এক একটি পাইল। সেখান থেকে ঠিক রেললাইনের উপর চাকায় ভর করে পদ্মামুখী হয়ে ভিড়ছে তীরের দিকে। বিশাল গোলাকৃতির পাইল মূল ইয়ার্ড থেকে ছড়িয়ে পড়েছে নদী তীরেও। সেখান থেকে যাচ্ছে মাঝপদ্মায়। আর পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের ওয়ার্কসপে এই পাইলগুলো তৈরির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন চীনা নারীরা। পদ্মা সেতু প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মোঃ আব্দুল কাদের জানান, বুধবার থেকেই পাইলিং কাজের সরঞ্জামাদি প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছে। প্রথমে ছয়টি সাপোর্ট পাইল স্থাপন করে প্লটফর্ম নির্মাণ করা হবে। তারপর পাইল ড্রাইভিংয়ের জন্য পিলারের কাছে ড্রাইভ ক্রেন স্থাপন করা হবে। শেষে পাইল বসিয়ে হ্যামার দিয়ে ড্রাইভ শুরু হবে। আর তা হবে ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মাধ্যমে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের ৪২টি পিলারের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ এই সেতু। এছাড়া দেড় কিলোমিটার করে উভয় পাড়ে তিন কিলোমিটার সংযোগ সেতুর জন্য আরও ২৪টি পিলার হবে। সেতুর ৪২টি পিলারে ৬টি করে ২৪০টি এবং দু‘পাড়ের ১২টিতে দুটি করে ২৪টি পাইল বসানো হবে। সর্বমোট ২৬৪টি পাইল হবে। এ কাজে জার্মানি থেকে তৈরি করে আনা ৩ হাজার টন চাপের হ্যামারটি ব্যবহৃত হবে। যার দৈর্ঘ ১২০ ও ব্যাস ৩ মিটার। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, পাইলিংয়ের যন্ত্রপাতি সাজানোর কাজ চলছে। পাইল ড্রাইভিংয়ের পরই পদ্মা সেতুর সুপার স্ট্রাকচারের (উপরের অংশ) কাজ শুরুর জন্য প্রস্তুতি চলছে। এজন্য ওয়ার্কশপ পাইল ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডের পাশেই আরেকটি ইয়ার্ড তৈরি করা হচ্ছে। এদিকে নদীর দুই পাড়ে কয়েক লাখ ব্লক তৈরি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নদী শাসনের কাজের জন্য। নদী শাসনের কাজও এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে। প্রায় ১৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি হয়েছে ১৬ শতাংশ। সব মিলিয়ে সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে ২৭ শতাংশ। এদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক শহীদুল হক মাওয়া পদ্মা সেতু এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন। পদ্মা সেতুতে কর্মরত বিদেশীদের নিরাত্তায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের জন্য পুলিশ, সেবা সদস্য নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত রয়েছে। কাজের সুবিধার্থে ও বিদেশীদের নিরাপত্তার জন্য পদ্মা সেতুর দু’প্রান্তে দু’টি থানা তৈর করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। অপর দিকে পদ্মা পারে স্বপ্নের ঝিলিক মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছে। উন্মোচিত হতে শুরু করেছে সম্ভাবনারদ্বার। সেতুর দুই প্রান্তে হংকংয়ের মতো অধুনিক নগরী গড়ে তোলতে সরকার হাতে নিচ্ছে মহাপরিকল্পনা। পদ্মার চরে বেশ কয়েকটি স্টেডিয়ামের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হবে অলিম্পিক ভিলেজ। থাকবে ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও বিশ্বমানের অধুনিক স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের মতো বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গড়ে তোলা হবে আধুনিক শিল্প নগরী। পর্যটকদের আধুনিক সুযোগ সুবিধা দিতে গড়ে তোলা হবে বিশ্বমানের পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র। বাদ যাবে না মসজিদ মাদ্রাসাও। আন্তর্জতিক মানের কনভেনশন সেন্টার তৈরির মাধ্যমে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাও এ পদ্মা পারের নগরীতে করার পরিকল্পনা করছে সরকার। আর এ সকল কিছুই হচ্ছে দেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ্মা সেতুকে ঘিরে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পদ্মা পারে সরকার ভিন্ন ভিন্ন নগরী গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। জনসাধারণের বসবাসের জন্য গড়ে তোলা হবে আধুনিক আবাসিক শহর। আবার শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য গড়ে তোলা হতে অধুনিক অসংখ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। শিল্প ও নগরায়ন শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক থাকবে না। ঢাকা শহরকে আরও বড় আকারে ছড়িয়ে দিতে সরকার এ মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন শহরে সব ধরনের অধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ থাকবে মসজিদ-মাদ্রাসা। পদ্মাপারে গড়ে তোলা হবে পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে থাকবে দৃষ্টিনন্দন লেক বা পুকুর। যা সহজেই পর্যটকদের মন জুড়িয়ে দেবে। আর এসব ঘিরে সৃষ্টি হবে বিপুল কর্ম সংস্থানের। তাই পদ্মা সেতুর কাজের পাশাপাশি পদ্মা পারের এ শহর ও সেতু এলাকায় দ্রুত যাতায়াতের জন্য সরকার রাজধানী ঢাকার শান্তিনগর ও জিরো পয়েন্ট থেকে বাবু বাজার ব্রিজের হয়ে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল আবাসিক এলাকার ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ ফ্লাইওভার হলে ঢাকাবাসী পদ্মা পারের এ শহরে আসতে তথা দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার মানুষকে তাদের শহরে যেতে ঢাকায় আর যানজটে পড়তে হবে না। তাছাড়া রেল লাইনও তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতুকে ঘিরে। দক্ষিণবঙ্গের সাথে রেল পথে সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুতে রাখা হয়েছে রেল যাতায়াত ব্যবস্থা। সরকারের কথা অনুয়ায়ী ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু খুলে দিলে কয়েক কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তির আবসান হবে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। আর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে দ্বিতল এই সেতুর পুরোটা হবে স্টিল আর কংক্রিট স্ট্রাকচারে। সেতুর উপরের তলায় থাকবে চার লেনের মহাসড়ক আর নিচ দিয়ে যাবে রেল লাইন। রেলের গতি হবে ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গসহ মুন্সীগঞ্জবাসীর জন্য আশির্বাদ বয়ে আনবে মনে করছেন এলাকাবাসী। এ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ ও স্থানীয় সাংসদ অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি জানান, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় মনবল আর যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই সকল ষড়যন্ত্র পেরিয়ে এখন পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। এ সরকার উন্নয়নে বিশ্বাসী। তাই দেশ ও জাতির কল্যাণে এই সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাঙালী যে তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বীরের জাতি প্রধানমন্ত্রী তারই প্রমাণ দিলেন। পদ্মা সেতুর জন্য নিজেদের বাপ-দাদা তথা পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি বিজড়িত বহু গুরুত্বপূর্ণ জমি তার নির্বাচনী এলাকার মানুষ ছেড়ে দিয়েছে উল্লেখ করে বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন গোটা দেশ ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, স্বপ্নের এই সেতৃ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে। মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল জানান, প্রধানমন্ত্রীর আগমন দেশের সর্ব বৃহত প্রকল্প পদ্মা সেতুর অগ্রগতি আরও বেগবান হবে। সেভাবেই সব কিছু পরিচারিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর ঘিরে সব রকম প্রস্তুতি চলছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর আগমনের খবরে এলাকায় বিশেষ এক আমেজ বিরাজ করছে। দেশী-বিদেশী কয়েক হাজার মানুষের কর্মযঞ্জের গতি গেছে বেড়ে।
×