ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২৭ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ঢাকায় ছাত্রজীবনের সূচনা (২৫ নবেম্বরের পর) ১৯৫২ সাল আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর ছিল। যদিও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় কিন্তু ১৯৫২ সালে সেটা তুঙ্গে পৌঁছে। সেই বছর মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়। ১৯৫২ সালের আগস্ট মাসে ইরানে মার্কিন ইরান তেল কোম্পানি জাতীয়করণ করেন ইরানের প্রধানমন্ত্রী ড. মোসাদ্দেক (১৮৮২-১৯৬৭)। অবশ্য এই জাতীয়করণ শেষ পর্যন্ত টিকতে পারল না। ইরানের শাহ চতুরতার সঙ্গে দেশ ছেড়ে যান এবং মার্কিন সহায়তায় অচিরেই মোসাদ্দেকের কর্তৃত্ব বাতিল করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। জুলাই মাসের ২৩ তারিখে মিসরে কর্নেল নেগিব (১৯০১-১৯৮৪) ক্ষমতা দখল করেন এবং রাজা ফারুককে বিতাড়ন করে সেখানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে কিন্তু আর কোন প্রতিবিপ্লব হলো না এবং ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গামাল আবদুল নাসের হন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তী সময় প্রায় দশকব্যাপী দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তার নেতৃত্বে ১৯৬০ থেকে ১০ বছরে আসওয়ান বাঁধ নির্মিত হয়। ১৯৫২ সালেই মার্কিন বিজ্ঞানী জোনাস সালক পোলিও টিকা আবিষ্কার করেন। এই বছরে ১৬ মে-তে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদ জমিদারি বিলোপ আইন পাস করে; যদিও তার বাস্তবায়নে আরও প্রায় তিন বছর বিলম্ব হয়। এই বছরেই পূর্ববাংলায় প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপসু) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বছরেই ফেব্রুয়ারি মাসে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে আরোহণ করেন যদিও তার অভিষেক হয় পরবর্তী বছরে। সিলেটে একজন প্রিয় প্রগতিশীল জননেতা পীর হাবিবুর রহমান এক বক্তব্যে বা লেখায় আমাকে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় বেশ কৃতিত্ব প্রদান করেন। আমি বিষয়টা তাকে বুঝিয়ে বলি এবং তিনি তখন স্বীকার করেন যে তিনি ভুল করেছেন। সিলেটে ১৯৫১ সালের নবেম্বর মাসে ফেঞ্চুগঞ্জে একটি ছাত্র সম্মেলন হয়, সেখানে সিলেট ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা পায়। পরের বছর ২৬ এপ্রিলে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয় এবং নবেম্বর মাসে এক ছাত্র সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়। প্রথম সভাপতি হন মোহাম্মদ সুলতান এবং সম্পাদক হন মোহাম্মদ ইলিয়াস। পীর হাবিব বলেন, আমি ছাত্র ইউনিয়নের মূল প্রতিষ্ঠাতা। তার ভুল হয় একটি কারণে। ১৯৫০ সালে গঠিত সিলেট ছাত্র শিক্ষা কমিটি যার আহ্বায়ক ছিলাম আমি সেই সংগঠনটি নবেম্বরের ফেঞ্চুগঞ্জ সম্মেলনটি আহ্বান করে। ফেঞ্চুগঞ্জ সম্মেলন ছিল নানাভাবে নাটকীয়। শিক্ষা কমিটি সম্মেলনটি ডাকে একটি শূন্যতা পূরণের উদ্দেশ্যে। যদিও ১৯৪৯ সালের ৪ জানুয়ারিতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (ইপিএমএসএল) প্রতিষ্ঠা পায় কিন্তু সেটা মাঠ পর্যায়ে কোন শক্তি সঞ্চয়ে ব্যর্থ হয়, তাদের সাফল্য ছিল একটি ক্ষেত্রে। অল ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ (এইপিএমএসএল) শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে একেবারেই মুসলিম লীগের বংশোদ্ভূত একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গিয়েছিল এবং মাঠে তাদের কোন অস্তিত্ব না থাকলেও তারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে মুসলিম লীগের জয়গানে ছিল উচ্চকণ্ঠ। ইপিএমএসএল এইপিএমএসএলের অবস্থানটিকে চ্যালেঞ্জ করে অচিরেই তাদের একটি কাগুজে সরকারী দালাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। যাই হোক সিলেটের সম্মেলনে মুসলিম লীগের আবুল হাশেম ও সংবাদ সম্পাদক খায়রুল কবিরের মতো নেতারা আমন্ত্রিত হন এবং একই সঙ্গে আমন্ত্রিত হন ছাত্রনেতা এমাদুল্লাহ এবং অন্যান্য প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দ। সিলেটের পুলিশ সুপার সিরাজুল হক চৌধুরীর ছিল বিশেষ কম্যুনিস্ট ফোবিয়া। তিনি ছাত্রমহলে সর্বত্র কম্যুনিস্ট কার্যকলাপ সন্দেহ করতেন। তিনি জানালেন যে, শিক্ষা কমিটির ছাত্র সম্মেলন একটি সরকারবিরোধী কম্যুনিস্ট উদ্যোগ। তাই মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এই সম্মেলনে না আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু সংগঠকরা সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। সরকার প্রথমে সিলেটে সম্মেলন অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। সম্মেলনকারীরা গোলাপগঞ্জে সম্মেলনের আয়োজন করলে সেখানেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। তখন সংগঠকরা সম্মেলনে আগত অতিথিদের দক্ষিণ সিলেটে রেল স্টেশনে সমবেত হওয়ার জন্য অনুরোধ করল। এই উদ্যোগটায় নেতৃত্ব দেন যুগ্ম-সম্পাদক খন্দকার রুহুল কুদ্দুস এবং ছাত্রনেতা সাব্বির চৌধুরী ও তারা মিয়া। সম্মেলনের দিন যখন সবাই রেল স্টেশনে সমবেত হলেন তখন উদ্যোক্তারা তাদের নিয়ে ট্রেনে করে গেলেন ফেঞ্চুগঞ্জে যেখানে সম্মেলন অনুষ্ঠানের গোপন প্রস্তুতি নেয়া হয়। সেখানে সম্মেলন শুরু হলো এবং কিছুক্ষণ পরেই পুলিশও এসে সেখানে হাজির হলো, ১৪৪ ধারায় সভা-সমিতি বন্ধ করার হুকুম দিল। সম্মেলনকারীরা তখন একটি চমৎকার পন্থা অবলম্বন করে বলল যে, আমরা সম্মেলন শেষ করছি কিন্তু তার আগে আমরা মোনাজাত করতে চাই। দোয়া শুরু করলেন একজন অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন ছাত্রনেতা যিনি ধর্মকর্মেও অত্যন্ত শীর্ষস্থানে অবস্থান করতেন। তার দোয়াটি ছিল একান্তই রাজনৈতিক। তিনি তার দোয়ায় ফেঞ্চুগঞ্জের সম্মেলনে যা কিছু আলোচনা হলো তার সারাংশ উল্লেখ করে বললেন যে, আল্লাহ তুমি আমাদের মকসুদ পূর্ণ কর। তারপরে তিনি, এই সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেসব আবৃত্তি করলেন। শেষে তিনি বললেন যে, আল্লাহ আমরা যে উদ্যোগই নিলাম তাকে তুমি সফল কর এবং আরও প্রার্থনা করলেন যে, যে সমিতি আমরা গঠন করলাম সেই সমিতিকে তুমি কবুল কর এবং তারপর তিনি দোয়া সম্পন্ন করলেন। এরপর সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলো। এই যে সম্মেলন হলো সেটা সহ-সম্পাদক রুহুল কুদ্দুসই আহ্বান করেন এবং আমার পক্ষেই তিনি তার বিজ্ঞপ্তি জারি করেন সে কারণে একটি ভুল ধারণা হয় যে, আমি বুঝি সিলেট ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম উদ্যোক্তা। আসলে সম্মেলন ডাকার আগেই আমি ঢাকায় যাই। তাই এই সম্মেলন ডাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং আমি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণও করিনি। এমনকি এ সম্বন্ধে অবহিতও ছিলাম না। আমার অবস্থান স্পষ্ট করার পর অবশ্য এ নিয়ে আর কোন জটিলতা থাকেনি। ১৯৫২ সাল সাদামাটা বছর হিসেবে শুরু। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ব্যস্ততা বাড়ল এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সালটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বছর এবং উপমহাদেশের ভবিষ্যত নির্মাণে একটি যুগান্তকারী সময়। ক্ষমতাশীল মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয় ঢাকায় ২৪ থেকে ২৬ জানুয়ারি। এই অধিবেশন শেষে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ঢাকা ভ্রমণে আসেন। অধিবেশন শেষে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দানকালে ২৭ জানুয়ারি তিনি বলেন যে, জাতির পিতার ইচ্ছানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং একমাত্র উর্দু। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন হল নির্বাচন, নতুন কমিটির অভিষেক এইসব নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও ২৮ ও ২৯ জানুয়ারিতে কলা ভবনের আমতলায় প্রতিবাদ সভা হলো। সুপ্ত ১৯৫০ সালের কার্যকরী ভাষা সংগ্রাম কমিটি আবার নড়েচড়ে উঠল। ৩০ জানুয়ারি কলাভবনে সভা শেষে মহানগরব্যাপী শোভাযাত্রা ও পথে পথে সভা হলো কিন্তু সবচেয়ে চমৎকার বিষয়টি ছিল এসব কর্মকাণ্ডে এত উত্তেজনা সত্ত্বেও শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা পুরোপুরি বহাল থাকল। কোথাও খোলা দোকান বা চলন্ত যানবাহনের কোন ধরনের ক্ষতিসাধন করা হলো না। শোভাযাত্রা হাইকোর্ট, পুরানা পল্টন, নবাবপুর, সদরঘাট, পাটুয়াটুলি, বাবুবাজার, আরমানিটুলা, নাজিমুদ্দিন রোড হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শেষ হলো। আমার জীবনে ৩০ জানুয়ারির শান্তিপূর্ণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ শোভাযাত্রা ও প্রতিবাদ আর কখনও দেখেছি অথবা তাতে অংশ নিয়েছি বলে মনে পড়ে না। আমার সঙ্গে সাইকেল ছিল বলে আমরা ছিলাম শোভাযাত্রার একেবারে শুরুতে। অবশ্য আমরা সাইকেল নিয়ে হেঁটেই সারা পথ অতিক্রম করি। চলবে...
×