মমতার মমতায় পেলবতার অম্লরস না থাকলেও শিমুলের সমীকরণে খানিকটা ত্রুটি ছিল। ছেলেটি যদি সমকালীন রাজনীতির কুটিল প্যাঁচে অজ্ঞ না হতো, যদি সমাজ বাস্তবতার ধারাপাত ঠিকঠাক মুখস্থ করতে ব্যর্থ না হতো, তবে পদে-পদে আর হোঁচট খেতে হতো না; কিংবা ভেঙে-যাওয়া স্বপ্নগুলো পুনঃপুনঃ জোড়া লাগানোর প্রয়োজন পড়ত না।
অথচ তাই হচ্ছে, বাজিতপুরের মাটিতে যা হওয়ার নয় তাই হচ্ছে আজ। একদিকে কচি-সবুজ বৃক্ষের চোখরাঙানী অন্যদিকে ঝরাপাতাদের দীর্ঘশ্বাস। আমজনতা বলতে যা বোঝায় তারাও থেমে নেই। কোন না কোন পক্ষকে লতাগুল্মের মতো জড়িয়ে ধরেছে।
গ্রামের রাস্তায় যেন পা দেয়ার জো নেই; সর্বত্রই কান কথার উড়াউড়ি। শিমুলের কাছে মনে হয়, ছোট্ট এই গ্রামটিই যেন অখ- বাংলাদেশ! কি নেই এখানে; রাজা, উজির, পাইক, পেয়াদা, রং, রংমহল, রংবাজ সব আছে, সব। প্রতিপক্ষ থাকার কথা না থাকলেও ইতিমধ্যে তা মাঠে ময়দানে কাঁটার মতো বিছিয়ে পড়েছে।
তাছাড়াও মহব্বত আলীই বা কম যায় কিসে! চাকরি নিয়ে যাও-বা সংশয় ছিল, এখন আর তা নেই। কেননা, গোলাম আলী বিশ্বাস তার আশ্বাসের মর্যাদায় একবিন্দু অমর্যাদা করেনি। ইউপি নির্বাচনের ওয়াদা অনুযায়ী মহব্বত আলী এখন খাস-ইমাম। এই এলাকায় চেয়ারম্যান ছাড়া আর কাউকেই সে তোয়াক্কা করে না। কথায়-কথায় হুংকার ছাড়ে, ভয় দেখিয়ে আত্মসিদ্ধি হাসিল করে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে নিত্য-নতুন ফতোয়া।
মমতার চোখের তারায় মরে যাওয়া স্বপ্নগুলো শিমুলের মধ্যে নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। বেচারা তখন নড়েচড়ে বসে। আরও খানিকটা পথ হাঁটার প্রেরণা পায়। কিন্তু চেয়ারম্যানের নামটা মুখে আসতেই মনটা বিস্বাদে ভরে ওঠে। তার সুখের গালিচায় যেন সাপের আনাগোনা বেড়ে যায়!
একটা সাপ।
দুইটা সাপ।
তিনটা সাপ।
অসংখ্য সাপ যেন কিলবিল করছে!
ভোটের দিনগুলোতে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে শিমুল নিজেও চেয়ারম্যানের পিছন পিছন কিলবিল করে ঘুরে বেড়িয়েছে। চকহরাদি, গোপিনাথপুর, ফুলবাড়িয়া, আসাননগর, রাজনগর, আবুরি, মালিহাদ, ঝুটিয়াডাঙাসহ প্রায় ১৩টি গ্রামে মিছিল-মিটিং করেছে; নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার করেছে; দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা করেছে।
পোস্টার, মাইক, বিড়ি-সিগারেট, উহ, দিনরাত কাজ আর কাজ! ক্লান্তির ভরে গোলাম আলী বিশ্বাস নুয়ে পড়লেও শিমুল ছিল লক্ষ্যে অবিচল। দিনের কাজ সারতে-সারতে অনেক রাত হয়ে যেত, তবুও কোন কোন দিন চোখের পাতায় ঘুম ধরা দিত না। কতিপয় সম্ভাবনা মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারতো- একটা পাঠশালা হবে, শিক্ষার হার বাড়বে, নতুন-নতুন রাস্তা-ঘাট তৈরি হবে, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হবে, শহরের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে, বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থান হবে ...
চেয়ারম্যান নিজেও এ বিষয়ে তাকে আশ্বস্ত করত, চিন্তা করু না বাপ, তুমরা যেরাম করি খাটচু, তাতে আমাক ইবার ঠেকায় কিডা! আর আমি চিয়ারম্যান হলি তুমার খুয়াব পুরুন হতি আর কতক্ষুণ!
একগুচ্ছ ভাবনা।
বহুমুখী সম্ভাবনা।
অপেক্ষার দ্বীর্ঘশ্বাস।
অথচ কি আশ্চর্য, যোগফল শূন্য!
জোট-মহাজোটের রাজনীতির মতোই অভিন্ন ধারা। নদী পার হয়ে চেয়ারম্যান গোলাম আলী বিশ্বাস তার ডিঙি নৌকাটি অথৈই জলে ডুবিয়ে দিয়েছে। ভুলে গেছে আর-আর সব প্রতিশ্রুতি। ভোটের আগে খুলে ফেলা কাঠের চশমাটি পুনরায় চোখে পড়ে নিয়েছে।
অবশ্য এমন সম্ভাবনার কথা আগেও কেউ-কেউ শুনিয়েছে। শিমুলকে সতর্ক করে জানিয়েছে, তুমি ভুল কচ্চু দাদা, ভিলেজ পলিটিক খুব খারাপ জিনিস। আর চিয়ারম্যান লোকটা সুবুদির না; দুমুকি সাপ, তলে আসে তলে যায়। ঘরে-ঘরে ন্যাটা বাদাইনি উর আসল কাজ। তুমি উর সাথে থাকু না। নিজির মত নিজি চল। তাছাড়া উড়ুশাল নিয়ার দরকারই বা কি!
দিনের আলোয় কথাগুলো সেদিন অবিশ্বাস করলেও আজ আর পারে না। কৃষ্ণপক্ষের রাতের মতই তার জীবনে নিবিড় অন্ধকার। তল খুঁজে হাতড়ে বেড়ায় কিন্তু তলের ঠিকানা অধরা।
আনমনা মুহূর্তে কেউ-কেউ তার নাম ধরে ধ্যান ভাঙায়, ও শিমুলদা বইসি বইসি তুমি কি ভাবচু; আরে চিন্তা করুনা তো, আমরা আছি না! জিত তুমারি হবে। আরে বাবা, যুবক সমাজের পাওয়ারই আলাদা। ওই পাওয়ারের সামনে কুনু শালা টেকপেনানে। ল্যাজ গুটিনি পলি সুমুর পাবে নানে।
চেয়ারম্যনের প্রতি ইঙ্গিত করে কেউ-কেউ আবার শিমুলকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
সপ দোষ তো তুমার; তুমার জন্যই চিয়ারম্যানকে ফেল করাইনি গেল না। চিয়ারম্যান ফেল কল্লি দেকতি মজা, মহব্বত আলীর তোতামুখ ভুতা হইয়ি যাতু। বড় বড় নিকচার নিয়া বেরি যাতু। শালার ইমামতি পদডাই থাকতু কিনা সন্দ!
এ কথার স্বপক্ষে অন্য আরেকজন অকাঠ্য যুক্তি উপস্থাপন করে, তুমি ঠিকই কয়ুচ গো দাদা, চিয়ারম্যান লোকটাই নষ্টের গুড়া। ইর আগে আইনদ্দি মিয়া যকুন চিয়ারম্যান ছিলু মহাব্বত আলী তকুন ম্যাউ-ম্যাউ করি বেড়াতু। মুকির উপর কতা বুলার ক্ষেমতা থাকতু না। আর একুন, একুন শালা আমাগের সাথে গাদ্দারি কচ্চে; বড় বৌ সাজিচে! ইর পরিণাম কিন্তু ভালো হবে নান। মাতা বিগড়ি গেলি কি কত্তি কি করবুন তার ঠিক-ঠিকানা নি।
এত সব কথা শিমুল গা করে না। সবকিছু নিরর্থক মনে হয়। যত সব আলগা ফুটানি। মৌলভী যেদিন তার দলবল আর লাঠিসোঁটা নিয়ে স্কুলঘরটা গুড়িয়ে দিল সেদিন কোন শালা এগুইনি। কারো টিকিটি পর্যন্ত কর্ণিয়ার ক্যানভাসে দৃষ্টিগোচর হয়নি। বোধহয় আলতামাখা পায়ে ফুলসজ্জায় খোয়াব দেখছিলো; কিংবা কাঁকড়ার গর্তে গা ঢাকা দিয়েছিল!
মমতাদির বাড়ির পথেই স্কুলঘরটি। শেষ চিহ্ন হিসেবে টিনের চালাটি পিরামিডের মতো এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। আঘাতে-আঘাতে টিনের আষ্টেপৃষ্ঠে ক্ষতচিহ্ন। ওই ক্ষত শুধু চালায় না, শিমুল তার নিজের মধ্যেও অনুভব করে। দূর থেকে ভাঙা চালাটার পানে তাকালে তির-তির করে বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়, হাত দুটো নিশপিশ করে। এই অজপাড়াগাঁ-এ একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা হলে কি এমন ক্ষতি হতো!
হিসেবের গরমিল।
চেয়ারম্যান কথা রাখেনি।
জোতদাররা এগুইনি।
মহাব্বত গঙ কলকাঠি নাড়িয়েছে।
অথচ, স্কুলের পথচলা থেমে থাকেনি। সাধারণ মানুষ শিমুলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম-প্রথম বেশ ভালয় সাড়া পেয়েছিল। এতসব কর্মযজ্ঞ দেখে মমতাও আপ্লুত হয়েছিল। চার দেওয়ালের বাঁধন মাড়িয়ে স্কুলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, খানিকটা হলেও মৃত স্বামীর আত্মা শান্তি পাবে। একাত্তরের দিনগুলোতে যে আলো ফরহাদের চোখে উজান বাইতো শিমুলের ছোঁয়ায় সেই আলোই হয়তো ভাটির পথে টান ধরবে।
ফরহাদ ও ফরহাদরা নেই অথচ, দ্রোহের মশাল ঠিকই প্রজ্বলিত। শিমুলদের হাতের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসবে মুঠো-মুঠো আলোকরশ্মি।
স্কুল নিয়ে মমতার মধ্যেও উন্মাদনার কমতি ছিল না। উচ্ছ্বাস তরঙ্গে শিমুলকে ভাসিয়ে দিত, আরে দাদাভাই, তুমি তো খুবই ভাগ্যবান!
কৌতূহলের চিহ্ন এঁকে শিমুল জিজ্ঞেস করত, কেন, দিদি, এর মধ্যে আবার সৌভাগ্যের কি দেখলে?
সৌভাগ্য না তো কি; গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা কি মুখের কথা! আজকাল শিক্ষিত মানুষ গ্রামে থাকতে চায় না, নাক সিটকিয়ে শহরে পালায়। অথচ, তুমি শহর ছেড়ে গ্রামে; সমাজের হয়ে মানুষের জন্য কাজ করছো, কতিপয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছো। এমন ভাগ্য কি সবার হয়, হয় না। ফরহাদও চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি।
ফরহাদ।
ফরহাদ আহমেদ।
স্বপ্নময় এক যুবক।
’৭১-এর দিনগুলোতে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে।
দেওয়ালে টাঙানো ফরহাদের সাদা কালো ছবির পানে তাকালে মমতার মনের মধ্যে এক-একদিন তোলপাড় শুরু হয়। আবেগের স্রোতে ভাসতে-ভাসতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়।
জানো শিমুল, দেশের জন্য যারা যুদ্ধ করেছে, শহীদ হয়েছে, তাদেরও একটা স্বপ্ন ছিল, লক্ষ্য ছিল।
কি স্বপ্ন দিদি?
মুক্তির।
কিসের মুক্তি?
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা শেষে কাঁপা-কাঁপা গলায় মমতা উত্তর দেয়, পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার মুক্তি, অশিক্ষার বিরুদ্ধে শিক্ষার মুক্তি, মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের। ওরা সুখি-সমৃদ্ধ একটি সমাজ গড়তে চেয়েছিল, যেখানে বিভেদের কোন দেওয়াল থাকবে না।
ফরহাদ।
হায়রে ফরহাদ!
বেচারা কেবলই আজ ছবির মানুষ। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নিখোঁজ হয়েছিল। তারপর আর ফিরে আসেনি। বোধহয়, অজ্ঞাত কোন বদ্ধভূমিতে ফুঁসে ওঠার অপেক্ষায়...
স্কুল বিষয়ক ভাবনায় নিমজ্জিত হলে কোন-কোনদিন শিমুল তার চোখের পাতা এক করতে পারত না। মমতার বারান্দায় ঝুপ ধরে বসে থাকত। বোবা দৃষ্টিতে রাত্রির বিচিত্র রূপ উপভোগ করত। বাতাসের ডানা ছুঁয়ে ভেসে আসত শিউলি ফুলের মাদকতা।
ফরহাদের নিজহাতে লাগানো শিউলি গাছ।
কত যতœ করেছে গাছটিকে; পেট পুরে পানি দিয়েছে, ফুলের অপেক্ষায় প্রহর গুনেছে।
কি আশ্চর্য, ফরহাদ নেই অথচ গাছটি আজও দাঁড়িয়ে!
আচ্ছা, পচা-গলা গন্ধ মাড়িয়ে ফুলের এই ঘ্রাণ কি ফরহাদের কাছে পৌঁছাতে পারে ! চোয়াল শক্ত করে মমতা আনমনে মাথা ঝাঁকায়। তার মনের মধ্যে অহর্নিশ ভাঙাগড়ার খেলা। আশা-নিরাশার দোলাচাল। ধরা গলায় শামিমের দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে।
তোমাকে পারতেই হবে দাদাভাই, যে কোন মূল্যে ওই স্কুলটি দাঁড় করাতে হবে। ফোটাতে হবে আলোর ফুল। আমিও আছি তোমার সঙ্গে; বল, পারবে না!
অর্ধশিক্ষিত ওই মহিলার মনের জোর দেখে শিমুল অবাক না হয়ে পারত না। খুব ভাল লাগত। মমতা তার রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়। তবুও এক চিলতে ¯েœহের আশায় ছুটে আসে, ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে।
দোচালা ঘরটির পরিণতির মধ্যে শুধুমাত্র স্কুল নয়, আরও কিছু ইঙ্গিত দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। শিমুলের ধারণা তার নিজেরও মাজা ভেঙ্গে গেছে। আকাশ থেকে পাতালে পতিত হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নানামুখী তৎপরতা। নিত্য-নতুন অপপ্রচার- সে নাকি ভারতের দালাল, ইসলামের শত্রু! জুম্মার নামাজ শেষে মৌলবী নিজ মুখে বলেছে, ভাইসপ বাপদাদার ভিটিত এদ্দিন তো ভালুই ছিলাম, আর মনে হয় থাকা হবে নানে।
যেন কিছুই জানে না এমন ভঙ্গিতে মৌলবীর এক চেলা জিজ্ঞেস করে, কেন হুজুর কি হয়িচে!
মৌলবীর মুখে ক্ষেদোক্তি, কি আর হবে রে ভাই, আমাগের শেকের বিটা, কি যিন নাম তার?
হ হুজুর শিমুল। কি করি সে?
ছেলিডা তো দালাল। ইন্ডিয়ার গুপ্তচোর। আমাগের সমাজডাক নষ্ট কচ্চে। মোছলমান সুমাজে হিন্দুর কায়দা চালু কচ্চে।
কলিম।
রুগ্ণ চেহারা।
খোঁচা-খোঁচা দাড়িগোঁফ।
মৌলবীর একান্ত সহচর সে।
মসজিদের মধ্যেই হুঙ্কার ছাড়ে, ঐ নাফরমান ছেলিডা কি করিচে হুজুর?
ওই মিয়া ওই, কি করিছে মানে; তামেশা করো না, কি করিনি সেডি আগে কও!
ভাবখানা এমন যে, মহব্বত আলীর সব রাগ সহচর কলিমের ওপর আছড়ে পড়ছে। মুসল্লিরা নির্বাক। মহব্বত আলী পরম আদরে দাড়িতে হাত বোলায় আর এক-এক করে সবার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। উঠতি বয়সের কয়েকজন ছেলে ঘাড় গুঁজে বসে আছে। তাদের বিশেষ কোন একজনের চোখে চোখ পড়তেই মৌলবী মুখ টিপে হাসে; বিজয়ের হাসি।
ওই মইজদ্দির বিটা, তুমি উটি দাঁড়াউ।
শফিকুলের শরীরের মধ্যে বিশেষ এক ধরনের কাঁপুনি অনুভূত হয়। চোখের পলকে মসজিদ থেকে পালাতে পারলে বোধহয় ভাল হতো। এত মানুষ থাকতে তাকেই বা হুজুর দাঁড়াতে বলবে কেন! আস্থিরচিত্তে ছেলেটি জিজ্ঞেস করে, আমি আবার কি কল্লাম হুজুর!
ঝাঁঝ মেশানো কণ্ঠে মহব্বত আলী বলে, তুমি তাক দাদা বুলি ডাকো ক্যান, সে কি তুমার দাদির সুয়ামী হয়?
শফিকুল নিরুত্তর থাকলেও মসজিদের মধ্যে হাসাহাসির ফল্গুধারা বয়ে যায়। মহব্বত আলী পুনরায় ধমকায়, দাঁত কেলায়ু না মিয়ারা, তাক আগে ঠেকাউ। তা না হলি ধর্ম-কর্ম সপ যাবেনে।
এতকিছুর পরেও মৌলভী সুস্থির হতে পারে না। ছাইচাপা আগুনের মতো তার ভিতরটা জ্বলেপুড়ে একসার। উত্তেজনা দমন করতে অনুচ্চস্বরে মুখ খেঁচায়, বেফাঁস ছেলি কনেকার! লজ্জাশরম কিচ্চু নি। কত্তোবড় বুকির পাটা, বেগুনা মেয়িগের দিদি বুলি ডাকে, পানিক আবার জল কয়; পানজামির নাম দিচে কুত্তা! ইস কি আমার হাউস, গিরামে পাটশালা বানাবে!
বিষয়টি শুধুমাত্র মসজিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বাজিতপুরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। পক্ষে-বিপক্ষে নানাবিধ মতানৈক্য। মিলাদ মাহফিলে মহব্বত আলী কৌশলে শিমুল প্রসঙ্গে কান ভাঙায়। পাঠশালার চাইতে বড় অপরাধ নাকি আল্লাহর ঘর মাদ্রাসা অবমাননা করায়!
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা না করে শিমুল নাকি আল্লাহর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে!
মহব্বত আলী দাউ বুঝে কোপ মারে, বিচার না কল্লি এই গিরামে গজপ নাজেল হবে, আল্লার বরকত উটি যাবে, মাটে-ঘাটে ফসল ফলবেনানে!
চেয়ারম্যান গোলাম আলী বিশ্বাসও বিচলিত। হুজুরের কথাগুলো সে অবিশ্বাস করতে পারে না। মুসল্লিদের সঙ্গে দফায়-দফায় বৈঠক করে। মৌলভীর পরামর্শে জনতার সম্মুখে শিমুলকে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু শিমুল তার নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল। চেতনাগত জিদ তার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। ভাঙবে তবু মচকাবে না। এমনকি চেয়ারম্যানকেও পরোয়া করতে নারাজ সে। সমবেত জনতার উপচেপড়া কোলাহল ভেদ করে ছেলেটি তার অবস্থান পরিষ্কার করতে চেয়েছে, কিন্তু কে শোনে কার কথা!
স্বউদ্যোগী হয়ে চেয়ারম্যান গোলাম আলী বিশ্বাস শিমুলের বাবাকে ডেকে পাঠায়। ঘটনার আদ্যপান্ত বয়ান করে যুতসই পরামর্শ চায়। কিন্তু আকবার আলী কি পরামর্শই বা দেবে; ঘটনার আকস্মিকতায় সে নিজেও ঝড়ে বিধ্বস্ত ডানাভাঙা পাখি যেন-বা! পাঠশালা প্রতিষ্ঠার জন্য ছেলে শিমুল যেদিন একখ- জমি চেয়েছিল আকবার আলীর মাথার মধ্যে সেদিন এতসব ভাবনা খেলা করেনি; বরং খুশিই হয়েছিল। ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখচ্ছবির পাশাপাশি লাল-সবুজের একটা পতাকাও মনের মধ্যে উঁকি মেরেছিল।
চেয়ারম্যানের খাসকামরায় বসে থাকতে খুবই অস্বস্তি লাগে তার। স্কুল জীবনের স্মৃতি হাতড়াতে-হাতড়াতে শুধুমাত্র সবুজসাথী বইটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐ বইটির ভার বইতে না পারার জন্য আজ আর তার আক্ষেপ নেই। কেননা বইয়ের জন্যই তো যত ঝামেলা; সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠা!
আকবার আলীর কানের কাছে মুখ এনে চেয়ারম্যান সাহেব ধীরে-ধীরে বলে চলে, বুজলেন কিনা ভাইসায়েপ, আপনি আমার নিজির লোক। ভোট দিয়ি চিয়ারম্যান বানায়িছেন। খুদা রাজি থাকলি আবারু বানাবেন।
কথার এই পর্যায়ে অকারণ একগাল হেসে চেয়ারম্যান খানিকটা থামে। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে পুনরায় বলে, তাই কচ্চি, ছেলিডাক ইট্টু থামান, শাসন করেন। আমার সাতে কাজ কত্তি বোলেন। তাতে দুটু পয়সা আসপেনে। আর ইবার যেদি পাস কত্তি পারি তালি উক কুনু এট্টা মাদ্রাসায় ঢুকি দেবোনে।
আকবার আলীর রাঁ নেই।
চেয়ারম্যানের সামনে থেকে ধীরপায়ে বেরিয়ে আসে। নিজের গ্রামটিকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখে। আগে দেখা দৃশ্যের সঙ্গে কোনই মিল নেই। বাতাসের বুকে কান পেতে আরও বেশি বিচলিত হয়। চারদিকে কানকথার উড়াউড়ি। শিমুল একা না, এই মিছিলে মমতার নামটিও যুক্ত হয়েছে। তার জন্যই নাকি শিমুলের এই অধঃপতন! রকমারি কথার ভিড়ে কোনটা সত্য আর কোনটা যে মিথ্যে বুঝে ওঠাই দায়! কারো-কারো মধ্যে আবার ঐ চেষ্টাটাও পরিলক্ষিত হয় না, বাহুল্য মনে হয়। বরং যে যার মতো কথার পিঠে কথা লাগিয়ে কাহিনীতে রঙের প্রলেপ মারে। ঘটতে থাকে একটার পর একটা অনাহূত ঘটনা।
মমতা নেই।
রাতের আঁধারে হারিয়ে গেছে!
ফরহাদের শিউলী গাছটিও প্রাণহীন।
সূর্যের আড়ালে নীরব অন্ধকার।
বাতাসের বুকে হাহাকার।
রাস্তার মোড়ে-মোড়ে নীরবতা।
আকবার আলীর উঠোনে উত্তেজনা।
ধৈর্যের বাঁধ আর ধরে রাখতে না পেরে, বাঁধার প্রাচীর ডিঙিয়ে শিমুল রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। বুক ভরে কয়েকবার শ্বাস নেয়। নিজের মধ্যে যেন অসুরের শক্তি অনুভূত হয়! হাতের পেশীগুলোও আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্ত। লম্বা-লম্বা পা ফেলে ছেলেটি সম্মুখে এগিয়ে চলে।
এক পা।
দুই পা।
তিন পা...
ভেঙেপড়া চালাঘরটির চোখে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়ায় সে। চোখেমুখে বিভ্রম; দূর থেকে মনে হয় চালাঘর নয়, মাথা উঁচু করে একটি শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে...