ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যয় হবে ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ॥ ক্রুড অয়েল ও ফিনিশড পণ্য আমদানিতে সময় অর্থ ও সিস্টেমলস কমবে

চীনের আর্থিক সহায়তায় চট্টগ্রামে তৈরি হচ্ছে সিঙ্গেল মুরিং টার্মিনাল

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৮ নভেম্বর ২০১৫

চীনের আর্থিক সহায়তায় চট্টগ্রামে তৈরি হচ্ছে সিঙ্গেল মুরিং টার্মিনাল

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ চট্টগ্র্রামে তৈরি হচ্ছে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল ও ডবল পাইপ লাইন। ফলে জ্বালানি সরবরাহের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল এবং ফিনিশড প্রোডাক্ট (এইচএসডি) সহজে, নিরাপদে, স্বল্প খরচে ও স্বল্প সময়ে খালাশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি এটি বাস্তবায়িত হলে লাইটারেজ অপারেশনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল ও ফিনিশড প্রোডাক্ট আমদানিতে যে সিস্টেম লস হয় তা কমানো যাবে এবং দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা হবে। উদ্যোগটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিল থেকে ৯২০ কোটি ৮৭ লাখ, বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ১১১ কোটি ৯০ লাখ এবং চায়না এক্সিম ব্যাংকের ঋণ থেকে ৩ হাজার ৯০৩ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিষয়ে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদার হিসেবে চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ব্যুরো (সিপিপি) কাজ করবে বলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশেন (বিপিসি) এবং সিপিপির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সম্প্রতি চীনের এক্সিম ব্যাংক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যা বাংলাদেশে অবস্থিত চীনের দূতাবাস এক পত্রের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক ওই বাণিজ্যিক চুক্তি পর্যালোচনা করে প্রকল্পে তাদের অর্থায়ন চূড়ান্ত করবে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য এসএম গোলাম ফারুক পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে বলেছেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির ওপর গত ২৬ অক্টোবর পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ প্রতিপালন সাপেক্ষে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে ইতোমধ্যেই সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল এবং ফিনিশড প্রোডাক্টের সিস্টেম লস কমবে। বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়,ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এবং দেশের একমাত্র পেট্রোলিয়াম অয়েল রিফাইনারি। ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের বাার্ষিক ক্রুড অয়েল প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা দেড় মিলিয়ন টন। চলমান ইউনিট-টু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ইআরএল’র ক্রুড অয়েল প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা প্রতিবছর সাড়ে ৪ মিলিয়ন টন হবে। অন্যদিকে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রতিবছর ৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন এইচএসডি আমদানি করা প্রয়োজন। এছাড়া আন্তঃদেশীয় এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আরও বেশি পরিমাণ এইচএসডি আমদানির প্রয়োজন পড়বে। চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামোতে বড় ক্রুড ভেসেল হ্যান্ডেল করা সম্ভব নয়। কেননা, কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলের নাব্য কম (মাত্র ৮ থকে ১৪ মিটার)। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে বড় ক্রুড ভেসেলগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করা হয়। এর পর লাইটারেজ ভেসেলের মাধ্যমে ক্রুড আনলোডিং করা হয়। এভাবে ১১ দিনে একটি এক লাখ ডিডব্লিউ ট্যাঙ্কার খালাস করা হয়। সুতরাং, লাইটারেজ অপারেশনের মাধ্যমে বেশি পরিমাণ ক্রুড ইনলোড করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এসব সমস্যা হতে উত্তরণের জন্য একটি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১০ সালে ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল মুরিং (এসপিএম) শীর্ষক একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দেয়। সে সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৫৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিলের ৪৭ কোটি ৮২ লাখ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) ঋণ ৯০৪ কোটি ৪১ লাখ এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার ২ কোটি ৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব চলতি বছরের ৬ মার্চ পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ২৪৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিলের ৮০২ কোটি ৭৮ লাখ, বৈদেশিক সহায়তা ৩ হাজার ৩০০ কোটি এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ১৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়। বৈদেশিক সহায়তার অংশে আইডিবি হতে ইতোপূর্বে গৃহীত ঋণের ৩৪ কোটি ২৫ লাখ এবং অবশিষ্ট অর্থ চায়না এক্সিম ব্যাংক হতে ঋণ গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়। প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে আইডিবির ঋণ সীমার অতিরিক্ত হওয়ায় এবং প্রকল্পের ডিজাইনে ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ায় আইডিবি সংশোধিত প্রকল্পের অর্থায়নে অপারগতা প্রকাশ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের ব্যয় ৩৩৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) কর্তৃক ব্যয় যৌক্তিকীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তীতে আইএমইডির সুপারিশ অনুযায়ী পরিকল্পনামন্ত্রীর দিক নির্দেশনা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত ২৪ আগস্ট পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল পূর্বের গৃহীত প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করে নতুন করে প্রকল্প হাতে নেয়ার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে এবং ৯৪ কিলোমিটার পাইপলাইন যুক্ত করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ইতোমধ্যেই প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণ শেষ হয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির আগামী সভায় অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) পক্ষে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)। প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে, পাইপলাইন এবং সিঙ্গেল মুরিং টার্মিনাল তৈরি। অফশোরে ১৪৬ কিলোমিটার ও অনশোরে ৭৪ কিলোমিটার, সর্বমোট ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন (এর মধ্যে ৩৬ ইঞ্চি ব্যসের ৩২ কিলোমিটার এবং ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের ১৮৮ কিলোমিটার) স্থাপন। মহেশখালী দ্বীপে ট্যাঙ্ক ফার্ম ও পাম্প স্টেশন স্থাপন, স্কাডা সিস্টেম স্থাপন, ভূমি অধিগ্রহণ, অধিযাচন ও ক্ষতিপূরণ, বিশেষজ্ঞ সেবা এবং ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ও সংশ্লিষ্ট পূর্ত কাজ করা হবে।
×