ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণ কি দুরূহ কাজ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৮ নভেম্বর ২০১৫

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণ কি দুরূহ কাজ

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করার প্রস্তাব উত্থাপন করছি। বর্তমান-ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এটা খুব জরুরী। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর মহামারির অভিশাপ মুছে শ্যামল বাংলা আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোথাও ভাতের অভাব নেই, কাপড়ের অভাব নেই, বাঙালী এখন মাছে-ভাতে ভাল আছে। শ্রীলঙ্কায় চাল রফতানি করছে। চিলমারী, নীলফামারীর মানুষ এখন পেট ভরে ভাত খেয়ে ভাটিয়ালি গাইতে গাইতে ক্ষেতে কাজ করছে, ফসল ফলাচ্ছে, কাজ শেষে বাড়ি ফিরে টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখছে। সাকিব কত রান করল, মুস্তাফিজ একটার পর একটা উইকেট নিয়ে হাততালি দিতে দিতে উইকেটকিপারকে জড়িয়ে ধরছে। আনন্দ আর ধরে না যেন, তারা নিজেরাই একেকজন সাকিব-তামিম-মুশফিক-মুস্তাফিজ তাসকিন...। ‘মঙ্গা’, ‘দুর্ভিক্ষ’ শব্দ দুটি আজ আর শোনা যায় না, মাঠে নেই, ডিকশনারিতে ঢুকে গেছে। কিন্তু একজন আছেন যিনি এই এগিয়ে যাওয়া মানতে পারছেন না। তিনি খালেদা জিয়া। একজন শেখ মুজিবের জন্ম হয়েছিল বলে বাঙালী স্বাধীনতা লাভ করেছিল এবং তাঁকে হত্যা করার পর তারই কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হাল ধরেছিলেন বলেই আজ আমরা বুক চিতিয়ে বলি আমরা মধ্যম আয়ের গ্রুপে পা রেখেছি। আমাদের জিডিপি অর্ধযুগ ধরে ৬+, আমাদের খাদ্য উৎপাদন চার কোটি টন, বিদ্যুত উৎপাদন ১৩০০০ মেগাওয়াট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, মাথাপিছু আয় ১,৪০০ ডলার, আমাদের শিক্ষার হার ৬৭, গড় বয়স ৭০, নারীর ক্ষমতায়ন ও ডিজিটাইজেশন বিশ্বনন্দিত, আমাদের বার্ষিক রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট তিন লাখ কোটি টাকা; অর্থাৎ এমজিডি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল), এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) বাস্তবায়নে এ অঞ্চলের সবাইকে পেছনে-পাশে ফেলে বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম দারুণভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ ধারণকারী মেধাবী, সাহসী, উচ্চাভিলাষী। এসব ম্যাডামের ভাল্লাগে না। আর ভাল্লাগে না টিভি-সেমিনারের টকশোর কিছু সুশীল আর তথাকথিত মানবাধিকার ব্যবসায়ীর। বস্তুত এদের মনোজগতে এখনও পাকিস্তান। তবে এরা প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক। সহজেই উচ্চ শিক্ষালয়ে ভর্তি কিনতে পারে, চাকরি কিনতে পারে, যে কোন দলের পদও অনায়াসে খরিদ করতে পারে, এমনকি গুলি-চাপাতি ভাড়া করতে পারে, জীবননাশের হুমকি দিতে পারে, বিলিয়ন ডলার খরচ করে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করতে পারে, আল-জাজিরার মতো মিডিয়াকে দিয়েও সাকা-মুজাহিদদের যুদ্ধাপরাধীর বদলে ইসলামিস্ট লিডার বলাতে পারে। ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে এসব তুলে ধরে একটা ভীতিকর সমাজ গড়তে চায়। সাকা-মুজাহিদের জন্য কেউ উহ্্ করলেন না, করলেন ম্যাডাম। মুখপাত্রের মাধ্যমে বলালেন, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সাকার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এ নিয়ে হাসাহাসি কম হচ্ছে না। না, বিষয়টি হাসির নয়। খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের সঙ্গে পাকিস্তানও সাকা-মুজাহিদের ফাঁসির সমালোচনা করেছে। যদিও তাদের এই অনধিকার চর্চা বাংলাদেশ সহজভাবে গ্রহণ করেনি। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনারকে ডেকে ওয়ার্নিং দিয়ে দিয়েছে। অবশ্য পাকিস্তানের প্রখ্যাত মানবাধিকার নেত্রী আসমা জাহাঙ্গীরের মন্তব্যও পাকিস্তানের গালে চপেটাঘাতের মতো। তিনি বলেছেন, সাকা-মুজাহিদ বাংলাদেশে পাকিস্তানের এজেন্ট হিসাবে কাজ করত। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন আগন্তক ইমরান খান, ক্রিকেটার হিসেবে যার খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। স্বাভাবিকভাবেই তিনি উদার হবেন, প্রগতিবাদী হবেন এবং সর্বোপরি বিশ্বজনীন হবেন। কিন্তু তিনিও পাকিস্তানের আইএসআই’র খপ্পর থেকে বেরোতে পারলেন না। কথা নেই, বার্তা নেই বলে বসলেন সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি মোটেই ঠিক হয়নি। বাংলাদেশের সমালোচনা করলেন। আমার ধারণা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে সব মিলিটারি হায়েনা বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে, নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, এই ইমরান খানের শরীরে তাদের কারও রক্ত বইছে। হায়েনাদের কারও ভাই, কারও সন্তানও হতে পারেন তিনি। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। মিলিটারি জিয়ার শেষের দিকের ঘটনা। ইমরান খান বাংলাদেশে এলেন ক্রিকেট খেলতে। সম্ভবত খেলাটি হচ্ছিল চট্টগ্রামের মাঠে। ইমরান খান এসেছেন, তরুণ-তরুণী, এমনকি বয়স্কদের মধ্যে উচ্ছ্বাস। ইমরান চলছেন, দু’পাশে মানুষ। হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘বাচ্চু জয় বাংলা বোলো’। এ ধরনের ব্যঙ্গ উপস্থিত অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। ঢিল-সেন্ডেল হাতের কাছে যে যা পেয়েছে ছুড়ে মেরেছে। খবরটি সংবাদপত্রে ছাপা হলো পরদিন। এর প্রতিবাদ জানিয়ে তখনকার যুব মুসলিম লীগের নেতা (সম্ভবত সভাপতি) এক বিবৃতিতে বললেন, ‘ইমরান খান বিশ্ববরেণ্য ক্রিকেটার, বাংলাদেশের মেহমান, তার সঙ্গে এ ধরনের আচরণ মোটেই ঠিক হয়নি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া উচিত।’ যদ্দুর মনে পড়ে তার বিবৃতিটি এ রকমই এবং তাও পরদিন কাগজে ছাপা হলো। বিবৃতিটি ছাপা হওয়ার পর দেখা গেল শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যান্ডেজ এবং প্লাস্টার করা অবস্থায় পত্রিকা অফিসে ঘুরছেন নিউজ ছাপানোর জন্য। ইমরানের পক্ষে কথা বলায় একদল ‘বেআড়া’ তরুণ তাকে উত্তম-মধ্যম দিয়েছে। অবশ্য তার আর কোন খবর ছাপা হয়নি এবং বিগত চার দশক ধরে তার আর কোন বিবৃতি চোখে পড়েনি। আমি মনে করি, ‘বেআড়া’ তরুণরা গায়ে হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে দিলে ভাল হতো। লেখাটি শুরু করেছিলাম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উপস্থাপন করে। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন হঠাৎ কেন এই প্রস্তাব করলাম। যদিও এটি হঠাৎ নয়। বহু আগে আমি এমন প্রস্তাব আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উত্থাপন করেছিলাম। আমার প্রস্তাব ছিল বাংলাদেশের কাউকে নিয়ে নয়। বরং গান্ধী নির্মাণ করার জন্য যেমন বিলেত থেকে বেন কিংস্লেকে আনতে হয়েছিল গান্ধীর চরিত্রে রূপ দেয়ার জন্য, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে চিত্রিত করার জন্যও বিদেশ থেকে কাউকে আনা যায় কি-না ভেবে দেখা যেতে পারে। এরই মধ্যে ঢাকায় ‘ব্রেভ-হাট’ নামে একটি ইংরেজী ছবি দেখলাম, যাতে কেন্দ্রীয় চরিত্রের চিত্রায়ন করলেন মেল গিবসন নামে একজন শক্তিশালী অভিনেতা। বঙ্গবন্ধুর মতো তারও দরাজ কণ্ঠস্বর, দীর্ঘাঙ্গী। তাকে আনলে খুব একটা মেকাপও লাগবে না। তাছাড়া ভদ্রলোক এতই মেধাবী যে, অভিনয়, পরিচালনা থেকে শুরু করে পাঁচটি ক্ষেত্রে অনবদ্য পারফর্মেন্সের জন্য পাঁচটি অস্কার পুরস্কার পেয়েছিলেন। আমার প্রস্তাব ছিল প্রফেসর সালাহউদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদ, প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, আওয়ামী লীগের ডাঃ এসএ মালেক, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, আবদুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখকে এবং তাদের সঙ্গে মেল গিবসনকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট রচনা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে মেল গিবসনকে বঙ্গবন্ধুকে রূপায়ণের সঙ্গে সঙ্গে পরিচালনার দায়িত্বও দেয়া যেতে পারে। সে প্রায় তিন দশক আগের কথা। এরই মধ্যে প্রায় অনেকেই ইন্তেকাল করেছেন। মেল গিবসন বেঁচে আছেন কি-না জানি না। তবে প্রফেসর আনিসুজ্জামান, ডাঃ এসএ মালেক, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক এখনও বেঁচে আছেন। সাংবাদিক তোয়াব খানের মতো ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করেছেন। তাদের সঙ্গে প্রফেসর মুনতাসীর মামুন, প্রফেসর সৈয়দ মঞ্জরুল ইসলাম রয়েছেন তাদের কয়েকজনকে নিয়ে এখনও আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়। মিউজিকের জন্য এআর রহমান যোগ্য ব্যক্তিত্ব। হ্যাঁ এটা ঠিক, এভাবে বাইরের লোক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর ছবি নির্মাণ করতে গেলে স্থানীয় নির্মাতা-অভিনেতা-পরিচালকগণ মনক্ষুণœ হতে পারেন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদেরও বুঝতে হবে ভারতে বাঘা বাঘা নির্মাতা-অভিনেতা-পরিচালক থাকা সত্ত্বেও বেন কিংস্লেকে ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি হতে হবে বিশ্বমানের এবং প্রাথমিকভাবে ভাষা হবে ইংরেজী। এরপর থাকে ফাইন্যান্স বা অর্থায়নের ব্যাপারটি। জাতির পিতার ওপর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র হবে- এটা সরকারের চলচ্চিত্র অধিদফতরই যোগান দিতে পারে। তাছাড়া সরকারের বাইরে জনগণের কাছ থেকেও ফান্ড যোগাড় করা যায়। গত দুই দশকে কত লোক শিল্প, বিদ্যুত, কনস্ট্রাকশন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ নিয়েছে, টিভি লাইসেন্স নিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, সেলিব্রিটি হয়েছে, তাদেরও তো নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। সকলেরই কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা দরকার। তাছাড়া সব টাকা সবাই কি ভোগ করতে পারে? আমরা তো দেখেছি এক/এগারোর পর রাস্তায় টাকার বস্তা পড়ে থাকতে, পেট্রোল-পাজেরো, পোলশে-জাগোয়ারের মতো কোটি কোটি টাকা দামের গাড়ি বেওয়ারিশ পড়ে থেকেছে দিনের পর দিন। একটা ব্যাপার মানতেই হবে আমরা কোথায় ছিলাম আর এখন কোথায় আছি। বুকে হাত দিয়ে একবার নিজেকে প্রশ্ন করলে উত্তর পাবÑ বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে আমরা আজকের অবস্থানে আসতে পারতাম কি? পেরেছে কি সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ? পারেনি। কারণ সেসব এলাকায় বঙ্গবন্ধু জন্মাননি। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পঁচাত্তরের পর জাতি ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব গ্রহণ না করলে বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে উঠে আসতে পারত কি? পারত না। কারণ বঙ্গবন্ধুর মতোই শেখ হাসিনা অদ্বিতীয়া। যারা এতদিন দুই নেত্রী দুই নেত্রী করে গলা ফাটাচ্ছিলেন তাদের জন্য এটি একটি শিক্ষা, জবাব। সর্বশেষ যে কথাটি বলব- বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা আমাদের সবই করে দিলেন, পিতা স্বাধীন করে পুনর্গঠন-পুনর্বাসন কাজ করে গেলেন আর কন্যা সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আজকের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং বিশ্ব দরবারে ঈর্ষণীয় বাংলাদেশ গড়ার নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। পশ্চিমা শক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পদ্মা সেতু করছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও করলেন। শেখ হাসিনা তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। এবার বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের ঋণ শোধ করতে হবে। ঢাকা , ২৬ নবেম্বর ২০১৫ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব ই-মেইল-নধষরংংযধভরয়@মসধরষ.পড়স
×